আবু উসামা যায়িদ নাম। হিব্বু রাসূলিল্লাহ (রাসূলুল্লহার প্রীতিভাজন) তাঁর উপাধি, পিতা হারিসা এবং মাতা সু’দা বিনতু সা’লাবা।
সু’দা বিনতু সা’লাবা তাঁর শিশু পুত্র যায়িদকে সঙ্গে করে পিতৃ গোত্র বনী
মা’নের নিকট যাওয়ার জন্য যাত্রা করলেন। পিতৃ-গোত্রে পৌঁছার পূর্বেই একদিন
রাতে বনী কায়নের লুটেরা দল তাঁদের তাঁবু আক্রমণ করে ধন সম্পদ, উট ইত্যাদি
লুণ্ঠন এবং শিশুদের বন্দী করে নিয়ে যায়। এই বন্দী শিশুদের মধ্যে তাঁর পুত্র
যায়িদ ইবন হারিসাও ছিলেন।
যায়িদের বয়স তখন আট বছর। লুটেরা দল তাঁকে
বিক্রির উদ্দেশ্যে ‘উকাজ’ মেলায় নিয়ে যায়, হাকীম ইবন হিযাম ইবন খুয়াইলিদ
নামে এক কুরাইশ নেতা চার শো’ দিরহামে তাঁকে খরীদ করেন। তাঁর সাথে আরো কিছু
দাস খরীদ করে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন।
হাকীম ইবন হিযামের
প্রত্যাবর্তনের খবর শুনে তাঁর ফুফু খাদীজা বিনতু খুয়াইলিদ দেখা করতে আসেন।
ফুফুকে তিনি বলেনঃ ফুফু উকাজ থেকে আমি বেশ কিছু দাস খরীদ করে এনেছি। এদের
মধ্যে যেটা আপনার পসন্দ হয় বেছে নিন। আপনাকে হাদিয়া হিসাবে দান করলাম।
হযরত খাদীজা দাসগুলির চেহারা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করার পর যায়িদ ইবন
হারিসাকে চয়ন করলেন। কারণ, তিনি যায়িদের চেহারায় তীক্ষ্ণ মেধা ও বুদ্ধির
ছাপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি তাঁকে সঙ্গে করে বাড়ীতে নিয়ে এলেন।
এ
ঘটনার কিছু দিন পর মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহর সাথে খাদীজা পরিণয় সূত্রে
আবদ্ধ হন। তিনি স্বামীকে কিছু উপহার দেওয়ার ইচ্ছা করলেন। প্রিয় ক্রীতদাস
যায়িদ ইবন হাসিরা অপেক্ষা অধিকতর সুন্দর কোন জিনিস তিনি খুঁজে পেলেন না। এ
ক্রীতদাসটিকেই তিনি স্বামীর হাতে তুলে দিলেন।
এ সৌভাগ্যবান বালক
ক্রীতদাস মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহর তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হতে লাগলেন।
তাঁর মহান সাহচর্য লাভ করে উত্তম চারিত্রিক সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণের সুযোগ
পেলেন। এ দিকে তাঁর স্নেহময়ী জননী পুত্র শোকে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর
চোখের পানি কখনও শুকাতো না। রাতের ঘুম তাঁর হারাম হয়ে গিয়েছিল। তাঁর বড়
দুঃখ ছিল, তাঁর ছেলেটি বেঁচে আছে না ডাকাতদের হাতে মারা পড়েছে, এ কথাটি
তিনি জানতেন না। তাই তিনি খুব হতাশ হয়ে পড়তেন। তাঁর পিতা হারিসা সম্ভাব্য সব স্থানে হারানো ছেলেকে খুঁজতে থাকেন। পরিচিত অপরিচিত, প্রতিটি মানুষের
কাছে ছেলের সন্ধান জানতে চাইতেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবের একজন বিশিষ্ট
কবি। এ সময় রচিত বহু কবিতায় তাঁর পুত্র হারানোর বেদনা মূর্ত হয়ে উঠেছে।
এমনি একটি কবিতায় তিনি বলেনঃ
‘‘যায়িদের জন্য আমি কাঁদছি, জানিনে তার কি হয়েছে,
সে কি জীবিত?
তবে তো ফেরার আশা আছে, নাকি মারা গেছে?
আল্লাহর কসম! আমি জানিনে, অথচ জিজ্ঞেস করে চলেছি।
তোমাকে অপহরণ করেছে সমতল ভূমির লোকেরা, না পার্বত্য ভূমির?
উদয়ের সময় সূর্য স্মরণ করিয়ে দেয় তার কথা, আর যখন
অস্ত যায়, নতুন করে মনে করে দেয়।
আমি দেশ থেকে দেশান্তরে তোমার সন্ধানে
উট হাঁকিয়ে ফিরবো, কখনও আমি ক্লান্ত হবো না,
আমার বাহন উটও না। আমার জীবন থাকুক বা মৃত্যু আসুক।
প্রতিটি মানুষই তো মরণশীল- যত আশার পেছনেই দৌড়াক না কেন।’’
এই হজ্জ মৌসুমে যায়িদের গোত্রের কতিপয় লোক হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কায় এলো।
কা’বার চতুর্দিকে তাওয়াফ করার সময় তারা যায়িদের মুখোমুখি হলো। তারা পরস্পর
পরস্পরকে চিনতে পেরে কুশল বিনিময় করলো। লোকগুলি হজ্জ আদায়ের পর গৃহে
প্রত্যাবর্তন করে যায়িদের পিতা হারিসাকে তার হারানো ছেলের সন্ধান দিল।
ছেলের সন্ধান পেয়ে হারিসা সফরের প্রস্তুতি নিলেন। কলিজার টুকরা, চোখের
পুত্তলি যায়িদের মুক্তিপণের অর্থও বাহনে উঠালেন। সফরসঙ্গী হলেন হারিসার ভাই
কা’ব। তাঁরা মক্কার পথে বিরামহীন চলার পর মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহর কাছে
পৌঁছলেন এবং বললেনঃ
‘ওহে আবদুল মুত্তালিবের বংশধর! আপনারা আল্লাহর
ঘরের প্রতিবেশী। অসহায়ের সাহায্যকারী, ক্ষুধার্তকে অন্নদানকারী ও
আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দানকারী। আপনার কাছে আমাদের যে ছেলেটি আছে তার
ব্যাপারে আমরা এসেছি। তার মুক্তিপণও সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আমাদের প্রতি
অনুগ্রহ করুন এবং আপনার ইচ্ছামত তার মুক্তিপণ নির্ধারণ করুন।’
মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেনঃ ‘আপনারা কোন্ ছেলের কথা বলছেন?
– আপনার দাস যায়িদ ইবন হারিসা।
– মুক্তিপণের চেয়ে উত্তম কিছু আপনাদের জন্য নির্ধারণ করি, তা-কি আপনারা চান?
– কী তা?
– আমি তাকে আপনাদের সামনে ডাকছি। স্বেচ্ছায় সে নির্ধারণ করুক, আমার সাথে
থাকবে, না আপনাদের সাথে যাবে, যদি আপনাদের সাথে যেতে চায়, মুক্তিপণ ছাড়া
তাকে নিয়ে যাবেন। আর আমার সাথে থাকতে চাইলে আমার করার কিছুই নেই।
তারা সায় দিয়ে বললঃ আপনি অত্যন্ত ন্যায় বিচারের কথা বলেছেন।
মুহাম্মাদ (সাঃ) যায়িদকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেনঃ এ দু’ব্যক্তি কারা?
বললঃ ইনি আমার পিতা হারিসা ইবন শুরাহবীল। আর উনি আমার চাচা কা’ব।
বললেনঃ ‘তুমি ইচ্ছা করলে তাঁদের সাথে যেতে পার, আর ইচ্ছা করলে আমার সাথেও থেকে যেতে পার।’
কোন রকম ইতস্ততঃ না করে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেনঃ ‘আমি আপনার সাথেই থাকবো।’
তাঁর পিতা বললেনঃ ‘যায়িদ, তোমার সর্বনাশ হোক! পিতা-মাতাকে ছেড়ে তুমি দাসত্ব বেছে নিলে?’
তিনি বললেনঃ ‘এ ব্যক্তির মাঝে আমি এমন কিছু দেখেছি, যাতে আমি কখনও তাকে ছেড়ে যেতে পারিনে।’
যায়িদের এ সিদ্ধান্তের পর মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর হাত ধরে কা’বার কাছে নিয়ে
আসেন এবং হাজরে আসওয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে উপস্থিত কুরাইশদের লক্ষ্য করে ঘোষণা
করেনঃ ‘ওহে কুরাইশ জনমণ্ডলী! তোমরা সাক্ষী থাক, আজ থেকে যায়িদ আমার ছেলে।
সে হবে আমার এবং আমি হবো তার উত্তরাধিকারী।’
এ ঘোষণায় যায়িদের
বাবা-চাচা খুব খুশী হলেন। তারা তাঁকে মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহর নিকট রেখে
প্রশান্ত চিত্তে দেশে ফিরে গেলেন। সেই দিন থেকে যায়িদ ইবন হারিসা হলেন
যায়িদ ইবন মুহাম্মাদ। সবাই তাঁকে মুহাম্মাদের ছেলে হিসেবেই সম্বোধন করতো।
অবশেষে আল্লাহ তা’আলা সূরা আহযাবের- ‘তাদেরকে তাদের পিতার নামেই ডাক’- এ
আয়াত নাযিল করে ধর্মপুত্র গ্রহণের প্রথা বাতিল করেন। অতঃপর আবার তিনি যায়িদ
ইবন হারিসা নামে পরিচিতি লাভ করেন।
যায়িদ নিজের পিতা-মাতাকে ছেড়ে
মুহাম্মাদকে (সাঃ) যখন বেছে নিয়েছিলেন, তখন জানতেন না কি জিতই না তিনি
জিতেছেন। স্বীয় পরিবার-পরিজন ও গোত্রকে ছেড়ে যে মনিবকে তিনি চয়ন করলেন,
তিনিই যে, সাইয়্যেদুল আওয়ালীন ওয়াল আখিরীন এবং সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রতি
প্রেরিত আল্লাহর রাসূল, এর কোন কিছুই তিনি জানতেন না। তার মনে তখন একটি
বারের জন্যও এ চিন্তা উদয় হয়নি যে, এ বিশ্বে এমন একটি রাষ্ট্র কায়েম হবে যা
পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সর্বত্র কল্যাণ ও ন্যায়বিচারে পূর্ণ হয়ে যাবে
এবং তিনিই হবেন সেই কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। না, এর কোন কিছুই তখন
যায়িদের চিন্তা ও কল্পনায় আসেনি। সবই আল্লাহর অনুগ্রহ। যাকে ইচ্ছা তিনি
অঢেল দান করেন।
এ ঘটনার মাত্র কয়েক বছর পর মুহাম্মাদ (সাঃ) নবুওয়াত
লাভ করেন। যায়িদ হলেন পুরুষ দাসদের মধ্যে প্রথম বিশ্বাসী। পরবর্তীকালে তিনি
হলেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বিশ্বাসভাজন আমীন, তাঁর সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার এবং
তাঁর অনুপস্থিতিতে মদীনার অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক।
যায়িদ যেমন
পিতা-মাতাকে ছেড়ে রাসূলকে (সাঃ) বেছে নেন, তেমনি রাসূলও (সাঃ) তাঁকে
গভীরভাবে ভালোবাসলেন এবং তাঁকে আপন সন্তান ও পরিবারবর্গের মধ্যে শামিল করে
নেন। যায়িদ দূরে গেলে তিনি উৎকণ্ঠিত হতেন, ফিরে এলে উৎফুল্ল হতেন এবং এত
আনন্দের সাথে তাঁকে গ্রহণ করতেন যে অন্য কারো সাক্ষাতের সময় তেমন দেখা যেত
না। কোন এক অভিযান শেষে হযরত যায়িদ মদীনায় ফিরে এলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)
তাঁকে যেভাবে গ্রহণ করেছিলেন, তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন হযরত আয়িশা (রাঃ)। তিনি বলেনঃ
‘যায়িদ ইবন হারিসা মদীনায় ফিরে এলো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন আমার ঘরে। সে
দরজার কড়া নাড়লো। রাসূল (সাঃ) প্রায় খালি গায়ে উঠে দাঁড়ালেন। তখন তাঁর দেহে
নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত একপ্রস্থ কাপড় ছাড়া কিছু ছিল না। এ অবস্থায় কাপড়
টানতে টানতে দরজার দিকে দৌড়ে গেলেন। তাঁর সাথে গলাগলি করলেন ও চুমু খেলেন।
আল্লাহর কসম, এর আগে বা পরে আর কখনও রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) এমন খালিগায়ে আমি
দেখিনি।’
যায়িদের প্রতি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) গভীর ভালোবাসার কথা
মুসলিম জনতার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে লোকে তাকে ‘যায়িদ আল হুব্ব’ বলে
সম্বোধন করতো এবং তাঁর উপাধি হয় ‘হিব্বু রাসূলিল্লাহ’ বা রাসূলুল্লাহর
প্রীতিভাজন।
হযরত হামযা (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূল (সাঃ) তাঁর
সাথে যায়িদের ভ্রাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। তাঁদের দু’জনের মধ্যে গভীর
সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এমন কি হামযা কখনও সফরে গেলে তাঁর দ্বীনি ভাই যায়িদকে
অসী বানিয়ে যেতেন।
‘উম্মু আয়মন’ নামে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) এক দাসী
ছিলেন। একদিন তিনি সাহাবীদের বললেনঃ কেউ যদি কোন জান্নাতী মেয়েকে বিয়ে করতে
চায়, সে উম্মু আয়মনকে বিয়ে করুক। হযরত যায়িদ আল্লাহর রাসূলকে (সাঃ) খুশী
করার জন্য তাঁকে বিয়ে করেন। তাঁরই গর্ভে প্রখ্যাত সেনানায়ক হযরত উসামা ইবন
যায়িদ মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন।
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের পর তিনি
হযরত কুলসুম ইবন হিদ্মের মেহমান হন। হযরত উসাইদ ইবন হুদাইবের (রাঃ) সাথে
তাঁর ভ্রাতৃ-সম্পর্ক কায়েম হয়। এত দিন তিনি নবী পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে
একসঙ্গে থাকতেন। এখানে আসার পর তাঁকে পৃথক বাড়ী করে দেওয়া হয় এবং
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আপন ফুফাতো বোন জয়নব বিনতু জাহাশের সাথে তার বিয়ে হয়।
কিন্তু যয়নবের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় তিনি তালাক দেন। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যয়নবকে বিয়ে করেন।
হযরত
যায়িদ ছিলেন তৎকালীন আরবের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীরন্দায। বদর থেকে মূতা
পর্যন্ত সকল অভিযানেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। একমাত্র ‘মাররে ইয়াসী’ অভিযানে
যোগদান করতে পারেননি। এ যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে মদীনায়
স্থলাভিষিক্ত করে যান।
হিজরী অষ্টম সনে একটি মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেল।
এ বছর রাসূল (সাঃ) ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত একটি পত্রসহ হারিস ইবন উমাইর
আল-আযদীকে বসরার শাসকের নিকট পাঠান। হারিস জর্দানের পূর্ব সীমান্তের ‘মূতা’
নামক স্থানে পৌঁছলে গাস্সানী সম্রাটের একজন শাসক শুরাহ্বীল ইবন আমর পথ
রোধ করে তাঁকে বন্দী করে। তারপর তাঁকে হত্যা করে। রাসূল (সাঃ) ব্যাপারটি
অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেন। কারণ, এর আগে আর কোন দূত এভাবে নিহত
হয়নি। রাসূল (সাঃ) মূতায় অভিযান পরিচালনার জন্য তিন হাজার সৈন্যের এক
বাহিনী প্রস্তুত করলেন এবং পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন হযরত যায়িদ ইবন হারিসার
হাতে। রওয়ানার পূর্ব মুহূর্তে রাসূল (সাঃ) উপদেশ দিলেনঃ ‘যদি যায়িদ শহীদ
হয়, দলটির পরবর্তী পরিচালক হবে জা’ফর ইবন আবী তালিব। জা’ফর শহীদ হলে
পরিচালক হবে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা। সেও যদি শহীদ হয় তাহলে তারা নিজেদের
মধ্য থেকে একজনকে পরিচালক নির্বাচন করে নেবে।’
যায়িদের নেতৃত্বে
বাহিনীকে মদীনা থেকে যাত্রা করে জর্দানের (জর্ডানের) পূর্ব সীমান্তে ‘মায়ান’ নামক
স্থানে পৌঁছলো। রোম সম্রাট হিরাক্ল গাস্সানীদের পক্ষে প্রতিরোধের
উদ্দেশ্যে এক লাখ সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলো। তার সাথে যোগ
দিল পৌত্তলিক আরবদের আরও এক লাখ সৈন্য। এ সম্মিলিত বাহিনী মুসলিম বাহিনীর
অনতি দূরে অবস্থান গ্রহণ করলো। ‘মায়ানে’ মুসলিম বাহিনী দু’রাত অবস্থান করে
করণীয় বিষয় সম্পর্কে পরামর্শ করলেন। কেউ বললেন, পত্র মারফত শত্রু বাহিনীর
সংখ্যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে অবহিত করে পরবর্তী নির্দেশের প্রতীক্ষায় থাকা
উচিত। কেউ বললেন, আমরা সংখ্যা, শক্তি বা আধিক্যের দ্বারা লড়াই করিনা। আমরা
লড়াই করি এ দ্বীনের দ্বারা। যে উদ্দেশ্যে তোমরা বের হয়েছো, সেজন্য এগিয়ে
চলো। হয় কামিয়াবী না হয় শাহাদাত- এর যে কোন একটি সাফল্য তোমরা লাভ করবে।
অতঃপর এই দুই অসম বাহিনী মুখোমুখি সংঘর্ষে অবতীর্ণ হলো। দু’লাখ সৈন্যের
বিরুদ্ধে মাত্র তিন হাজার সৈন্যের বীরত্ব ও সাহসিকতা দেখে রোমান বাহিনী
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। তাদের অন্তরে ভীতিরও সঞ্চার হলো।
যায়িদ ইবন
হারিসা রাসূলুল্লাহর (সাঃ) পতাকা সমুন্নত রাখার জন্য যে বীরত্ব সহকারে লড়াই
করেন তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। তীর ও বর্শার অসংখ্য আঘাতে তাঁর দেহ
ঝাঁঝরা হয়ে যায়। অবশেষে, তিনি রণক্ষেত্রে ঢলে পড়েন। তারপর একে একে জাফর ইবন
আবী তালিব ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা পতাকা তুলে নেন এবং বীরত্বের সাথে
শাহাদাত বরণ করেন। অতঃপর মুসলিম বাহিনীর সম্মিলিত সিদ্ধান্তে খালিদ ইবন
ওয়ালিদ কমাণ্ডার নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন নও মুসলিম। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম
বাহিনী অনিবার্য পরাজয় ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। এভাবে নবম হিজরীতে
৫৪ অথবা ৫৫ বছরে বয়সে হযরত যায়িদ শাহাদাত বরণ করেন।
মূতার দুঃখজনক
সংবাদ রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট পৌঁছলে তিনি এতই শোকাতুর হয়ে পড়েন যে, আর
কখনও তেমন শোকাভিভূত হতে দেখা যায়নি। তিনি শহীদ কমাণ্ডারদের বাড়ী গিয়ে
তাদের পরিবারবর্গকে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। যায়িদের বাড়ী পৌঁছলে তাঁর ছোট্ট
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে রাসূলকে (সাঃ) জড়িয়ে ধরে এবং রাসূল (সাঃ) উচ্চস্বরে
কেঁদে ফেলেন। তাঁর এ অবস্থা দেখে সা’দ ইবন উবাদা বলে ওঠেনঃ ‘ইয়া
রাসূলাল্লাহ, একি?
তিনি বলেনঃ ‘এ হচ্ছে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।’
রাসূল (সাঃ) বিদায় হজ্জ থেকে ফিরে যায়িদের অল্পবয়স্ক পুত্র উসামাকে পিতৃ
হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য এক বাহিনী সহকারে পাঠান। এত অল্পবয়স্ক ব্যক্তির
নেতৃত্ব অনেকের পছন্দ হলো না। রাসূল (সাঃ) একথা জানতে পেরে বললেনঃ ‘তোমরা
পূর্বে তার পিতার নেতৃত্বের সমালোচনা করেছিলে। এখন তার পুত্রের নেতৃত্বে
সন্তুষ্ট হতে পারছো না। আল্লাহর কসম। যায়িদ নেতা হওয়ার যোগ্য ছিল এবং সে
ছিল আমার সর্বাধিক প্রিয়। তারপর আমার সবচেয়ে প্রিয় তাঁর পুত্র উসামা।’
উসামা ছিলেন পিতার উপযুক্ত সন্তান। পিতৃহত্যার উপযুক্ত বদলা নিয়ে তিনি
মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) প্রতি ভক্তি,
ভালোবাসা, আনুগত্য ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনই ছিল হযরত যায়িদের জীবনের
একমাত্র ব্রত। তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনায় একথার প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত
উম্মু আয়মন (রাঃ) ছিলেন বেশী বয়সের প্রায় বৃদ্ধা, বাহ্যিক রূপহীনা এক নারী।
শুধু রাসূলকে (সাঃ) খুশী করার উদ্দেশ্যেই হযরত যায়িদ (রাঃ) তাঁকে বিয়ে
করেন। হযরত যয়নাবের (রাঃ) সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে তিনি নিজেই আবার
যয়নাবের (রাঃ) কাছে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বিয়ের পয়গাম উত্থাপন করেন।
শুধুমাত্র এজন্য যে, রাসূল (সাঃ) তাঁকে বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। এ
কারণে হযরত যয়নাবের (রাঃ) প্রতি সম্মানের খাতিরে তাঁর দিকে চোখ তুলে
তাকাননি। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শুধু প্রস্তাবটি পেশ করেছিলেন। [মুসলিম]।
হযরত যায়িদ ও তাঁর সন্তানদের প্রতি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সীমাহীন ভালোবাসা
লক্ষ্য করে হযরত আয়িশা (রাঃ) বলতেনঃ ‘যদি যায়িদ জীবিত থাকতেন, রাসূল (সাঃ)
মৃত্যুর পর হয়তো তাকেই স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন।’
লেখকঃ ড. মুহাম্মাদ আবদুল মাবুদ
আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
(বইঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – প্রথম খন্ড)
আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
(বইঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – প্রথম খন্ড)
No comments:
Post a Comment