তাঁর ইসলাম-পূর্ব যুগের নাম আবদুল কা’বা, মতান্তরে আবদুল উযযা। ইসলাম
গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর নাম রাখেন আবদুর রহমান। তাঁর ডাক নাম বা
কুনিয়াত তিনটিঃ আবু আবদিল্লাহ, তাঁর পুত্র মুহাম্মাদের নামানুসারে আবু
মুহাম্মাদ ও আবু উসমান। তবে আবু আবদিল্লাহ সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। পিতা প্রথম
খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও মাতা উম্মু রুমান বা উম্মু রূম্মান।
পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান এবং উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশার (রাঃ) সহোদর (উসুদুল
গাবা-৩/৩০৪-৩০৫)।
হযরত আবু বকর সিদ্দীকের সন্তানদের সকলে প্রথম
ভাগেই ইসলাম গ্রহণ করলেও আবদুর রহমান দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইসলাম থেকে দূরে
থাকেন। বদর যুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। যুদ্ধের মাঝামাঝি
পর্বে তিনি একটু সামনে এগিয়ে এসে মুসলমানদের প্রতি চ্যালেঞ্জের সুরে
বললেনঃ ‘হাল মিন মুবারিযিন’ – আমার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধের সাহস রাখে এমন কেউ
কি আছে? তাঁর এ চ্যালেঞ্জ শুনে পিতা আবু বকরের (রাঃ) চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল।
তিনি তাঁর সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন, কিন্তু
হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ) তাঁকে নিবৃত্ত করেন। উহুদের যুদ্ধেও তিনি মক্কার
কুরাইশদের সাথে ছিলেন। এ যুদ্ধে তিনি ছিলেন কুরাইশদের তীরন্দায বাহিনীর
অন্যতম সদস্য (উসুদুল গাবা-৩/৩০৫)। পরবর্তীকালে একদিন আবদুর রহমান পিতা আবু
বকরকে (রাঃ) বলেন উহুদের ময়দানে আমি আপনাকে পেয়েও এড়িয়ে গিয়েছিলাম। জবাবে
আবু বকর (রাঃ) বলেন, আমি তোমাকে দেখলে ছেড়ে দিতাম না (হায়াতুস
সাহাবা-২/৩১৩)।
হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় হযরত আবদুর রহমান ইসলাম
গ্রহণ করেন। তারপর মদীনায় হিজরাত করে পিতা আবু বকরের (রাঃ) সাথে বসবাস করতে
থাকেন। হযরত আবু বকরের (রাঃ) যাবতীয় কাজ কারবার তিনিই দেখাশুনা করতেন।
একবার রাত্রিবেলা হযরত আবু বকর (রাঃ) আসহাবে সুফফার কতিপয় লোককে দাওয়াত
করলেন। তিনি আবদুর রহমানকে বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) খিদমতে যাচ্ছি,
আমার ফিরে আসার পূর্বেই তুমি মেহমানদের খাইয়ে দেবে।’ পিতার নির্দেশমত আবদুর
রহমান যথাসময়ে মাহমানদের সামনে খাবার হাজির করলেন। কিন্তু তাঁরা মেযবানের
অনুপস্থিতিতে খেতে অস্বীকার করলেন। ঘটনাক্রমে সেদিন হযরত আবু বকর (রাঃ)
দেরীতে ফিরলেন। ফিরে এসে যখন জানলেন, মেহমানরা এখনও অভুক্ত রয়েছে, তিনি
অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আবদুর রহমানকে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তোকে আমি খাবার
দেব না।’ আবদুর রহমান ভয়ে জড়সড় হয়ে বাড়ীর এক কোণে বসে ছিলেন। একটু সাহস করে
তিনি বললেন, ‘আপনি মেহমানদের একটু জিজ্ঞেস করুন, আমি তাঁদের খাওয়ার জন্য
সেধেছিলাম কিনা।’ মেহমানরা আবদুর রহমানের কথা সমর্থন করলেন। তাঁরাও কসম
খেয়ে বললেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আবদুর রহমানকে খেতে না দেবেন, আমরা
খাবনা।’ এভাবে আবু বকরের রাগ প্রশমিত হয় এবং সকলে এক সাথে বসে আহার করেন।
আবদুর রহমান বলেন, “সেদিন আমাদের খাবারে এত বরকত হয়েছিল যে, আমরা
খাচ্ছিলাম, কিন্তু তা মোটেই কমছিল না। আমি সেই খাবার থেকে কিছু
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) জন্য নিয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বেশ কিছু সাহাবীসহ
তা আহার করেন (বুখারী)।”
স্বভাবগত ভাবেই হযরত আবদুর রহমান ছিলেন
অত্যন্ত সাহসী। তিনি ছিলেন দক্ষ তীরন্দায। হুদাইবিয়ার সন্ধির পর থেকে
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যত যুদ্ধ হয়, তিনি প্রত্যেকটিতে
অংশগ্রহণ করে বীরত্ব ও সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। খাইবার অভিযানে
তিনি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সহযাত্রী হন এবং খাইবারের গনীমাত থেকে চল্লিশ
‘ওয়াসাক’ খাদ্যশস্য লাভ করেন (সীরাতু ইবন হিশাম ২/৩৫২)। বিদায় হজ্জেও তিনি
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সফরসঙ্গী ছিলেন। হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ) তাঁকে হযরত
আয়িশার (রাঃ) সাথে ‘তানয়ীমে’ পাঠিয়েছিলেন নতুন করে ইহরাম বাঁধার জন্য।
উল্লেখ্য যে হযরত আয়িশা (রাঃ) এ সফরে ঋতুবতী হওয়ার কারণে হজ্জের কিছু অবশ্য
পালনীয় কাজ স্থগিত রেখে ইহরাম ভেঙ্গে ফেলেন। সুস্থ হওয়ার পরে রাসূলুল্লাহর
(সাঃ) নির্দেশে ‘তানয়ীমে’ গিয়ে পুনরায় ইহরাম বেঁধে স্থগিত কাজগুলি সম্পাদন
করেন (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৬০২)।
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ইনতিকালের পর
আরব উপদ্বীপের চতুর্দিকে যে বিদ্রোহ দেখা দেয় তা দমনে তিনি অন্যদের সাথে
সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ভণ্ড-নবী মুসাইলামা আল কাজ্জাবের সাথে ইয়ামামার
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তিনি চরম বীরত্বের পরিচয় দেন। এ যুদ্ধে তিনি শত্রুপক্ষের
সাতজন বিখ্যাত বীরকে একাই হত্যা করেন। ইয়ামামার শত্রুপক্ষের দুর্গের এক
স্থানে ফেটে ছোট্ট একটি পথ হয়ে গিয়েছিল। মুসলিম মুজাহিদরা বার বার সেই
ছিদ্র পথ দিয়ে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিল। কারণ, শত্রুপক্ষের
মাহকাম ইবন তুফাইল নামক এক বীর সৈনিক অটলভাবে পথটি পাহারা দিচ্ছিল। হযরত
আবদুর রহমান তার সিনা তাক করে একটি তীর নিক্ষেপ করেন এবং সেই তীরের আঘাতে
সে মাটিতে ঢলে পড়ে। মুসলিম মুজাহিদরা সাথে সাথে মাহকামের সঙ্গীদের পায়ে
পিষতে পিষতে ভেতরে প্রবেশ করে দুর্গের দরজা খুলে দেন। এভাবে দুর্গের পতন
হয়। হযরত উসমানের শাহাদাতের পর হযরত আলী ও হযরত আয়িশার (রাঃ) মধ্যে ভুল
বোঝাবুঝির কারণে যে উটের যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধে আবদুর রহমান বোনের পক্ষে যোগ
দিয়েছিলেন (আল-ইসাবা-২/৪০৮)।
হযরত আমীর মুয়াবিয়া তাঁর জীবদ্দশাতেই
পুত্র ইয়াযিদকে স্থলাভিষিক্ত করার প্রচেষ্টা শুরু করেন। তিনি স্বীয়
উত্তরাধিকারী হিসেবে ইয়াযিদের নামে মদীনায় জনগণের বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথ
নেয়ার জন্য মদীনার ওয়ালী মারওয়ানকে নির্দেশ দিলেন। তাঁর এ নির্দেশ মদীনার
মসজিদে সমবেত লোকদের পাঠ করে শুনানোর কথাও বললেন। মারওয়ান মুয়াবিয়ার এ আদেশ
যথাযথভাবে পালন করলেন। তিনি মসজিদে মদীনার জনগণকে সমবেত করে আমীর
মুয়াবিয়ার নির্দেশ পাঠ করে শুনালেন। তাঁর পাঠ শেষ হতে না হতেই হযরত আবদুর
রহমান ইবন আবী বকর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং মজলিসের নীরবতা ভঙ্গ করে
গর্জে উঠলেন। “আল্লাহর কসম! তোমরা উম্মাতে মুহাম্মাদীর মতামতের পরোয়া না
করে খিলাফতকে হিরাকলী পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করছো। এক হিরাকলের মৃত্যু হলে আর
এক হিরাকল তার স্থলাভিষিক্ত হবে।” অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, মারওয়ান বলেনঃ
এ তো আবু বকর ও উমার প্রবর্তিত পদ্ধতি। আবদুর রহমান প্রতিবাদ করে বলেনঃ
না, এটা হিরাকল ও কায়সারের পদ্ধতি। পিতার পর পুত্রকে সিংহাসনে বসানোর
পদ্ধতি। আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর এবং হুসাইন ইবন আলীও আবদুর রহমানকে দৃঢ়ভাবে
সমর্থন করেন (আল-ইসাবা-২/৪০৮, উসুদুল গাবা-৩/৩০৬)।
মারওয়ান তখন
অত্যন্ত উত্তেজিত কন্ঠে আবদুর রহমানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেনঃ বন্ধুগণ! এ
সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে কুরআনের এ আয়াত নাযিল হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি তার
পিতা-মাতাকে বলে, তোমাদের জন্য আফসুস” অর্থাৎ পিতা-মাতার আনুগত্য না করার
জন্য আল্লাহ তার নিন্দা করেছেন, সূরা আহকাফ-১৭। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা
(রাঃ) তাঁর হুজরা থেকে তার এ কথা শুনলেন। তিনি উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেনঃ
‘আল্লাহর কসম! না, আবদুর রহমানের শানে নয়। যদি তোমরা চাও, কোন ব্যক্তির
শানে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল, আমি তা বলতে পারি (আল-ইসাবা ৪/৪০৮, উসুদুল
গাবা-৩/৩০৬)।
হযরত আবদুর রহমান সেদিন উপলব্ধি করেছিলেন, মুয়াবিয়ার এ
ইচ্ছা পূর্ণ হলে মুসলিম উম্মাহ এক মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হবে। তিনি
নিশ্চিতভাবে বুঝেছিলেন, এটা ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা উৎখাত করে মুসলিম
উম্মাহর ওপর কায়সারিয়্যাহ বা কিসরাবিয়্যাহ চাপিয়ে দেয়ার একটি ষড়যন্ত্র।
হযরত আবদুর রহমান হযরত মুয়াবিয়ার এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জোর গলায় প্রতিবাদ
জানাতে লাগলেন। হযরত মুয়াবিয়া এবার ভিন্ন পথ অবলম্বন করলেন। তিনি আবদুর
রহমানের কন্ঠরোধ করার জন্য এক লাখ দিরহামসহ একজন দূত তাঁর কাছে পাঠালেন।
হযরত সিদ্দীকে আকবরের পুত্র আবদুর রহমান দিরহামের থলিটি দূরে নিক্ষেপ করে
দূতকে বললেনঃ ‘ফিরে যাও। মুয়াবিয়াকে বলবে, আবদুর রহমান দুনিয়ার বিনিময়ে
দ্বীন বিক্রি করবে না (আল-ইসতিয়াব, উসুদুল গাবা-৩/৩০৬, হায়াতুস
সাহাবা-২/২৫৪, রিজালুন হাওলার রাসূল-৫২৮)।’
এ ঘটনার পর হযরত আবদুর
রহমান যখন জানতে পেলেন হযরত মুয়াবিয়া সিরিয়া থেকে মদীনায় আসছেন, তিনি সাথে
সাথে মদিনা ছেড়ে মক্কায় চলে যান। সেখানে শহর থেকে দশ মাইল দূরে ‘হাবশী’
নামক স্থানে বসবাস করতে থাকেন এবং সর্বাধিক সঠিক মতানুযায়ী হিজরী ৫৩ সনে
ইয়াযিদের বাইয়াতের পূর্বেই ইনতিকাল করেন। অত্যন্ত আকস্মিকভাবে তাঁর মৃত্যু
হয়। মৃত্যুর দিন সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় প্রতিদিনের মত যথারীতি শুয়ে পড়েন;
কিন্তু সেই ঘুম থেকে আর জাগেননি। হযরত আয়িশার মনে একটু সন্দেহ হয়, কেউ হয়তো
তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছে। এর কিছুদিন পরে এক সুস্থ সবল মহিলা হযরত
আয়িশার (রাঃ) নিকট আসে এবং নামাযে সিজদারত অবস্থায় মারা যায়। এ ঘটনার পর
তাঁর মনের খটকা দূর হয়ে যায়। হযরত আবদুর রহমানের সঙ্গী-সাথীরা তাঁর লাশ
মক্কায় এনে দাফন করে।
হযরত আয়িশা (রাঃ) ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে
হজ্জের নিয়তে মক্কায় যান এবং কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
কান্নার মধ্যে কবি মুতাম্মিম ইবন নুওয়াইরাহ রচিত একটি শোক গাঁথার শ্লোক বার
বার আওড়াচ্ছিলেন। তারপর ভাইয়ের রূহের উদ্দেশ্যে বলেনঃ “আল্লাহর কসম! আমি
তোমার মরণ সময় উপস্থিত থাকলে এখন এভাবে কাঁদতাম না এবং যেখানে তুমি
মৃত্যুবরণ করেছিলে সেখানেই তোমাকে দাফন করতাম (মুসতাদরিক ৩/৪৭৬,
আল-ইসাবা-২/৪০৮)।”
হযরত আবদুর রহমান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে বেশ কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন। বহু সাহাবী ও তাবেঈ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।
লেখকঃ ড. মুহাম্মাদ আবদুল মাবুদ
আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
(বইঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – দ্বিতীয় খন্ড)
No comments:
Post a Comment