সাহাবীদের সংখ্যা যে কত তা সঠিকভাবে
নির্ণয় করা যায় না। ইমাম আবু যারআ আর-রাযী বলেছেন, রাসূল (সাঃ) যখন ইনতিকাল
করেন, তখন যারা তাঁকে দেখেছেন এবং তাঁর কথা শুনেছেন এমন লোকের সংখ্যা
নারী-পুরুষ মিলে এক লাখেরও ওপরে। তাঁদের প্রত্যেকেই রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হাদীস
বর্ণনা করেছেন। তাহলে যে সকল সাহাবী কোন হাদীস বর্ণনা করেননি তাঁদের
সংখ্যা যে কত বিপুল তা সহজেই অনুমেয়। আবু যার’আর একথার সমর্থন পাওয়া যায়
বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হযরত কা’ব ইবন মালিকের একটি বক্তব্য দ্বারা। তিনি
তাবুক অভিযান বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘মানুষের সংখ্যা অনেক। কোন দফতর বা
দিওয়ান তা গণনা করতে পারবে না।’’
সাহাবীদের যথাযথ হিসেব কোনভাবেই সম্ভব নয়।
কারণ, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) জীবনের শেষ দিকে মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে
তাঁর হাতে বাইয়াত হয়। কেউ কেউ বলেছেন, হিজরী দশম সনে মক্কা এবং তায়েফে
একজনও অমুসলিম ছিল না। সকলে ইসলাম গ্রহণ করে বিদায় হজ্জে অংশগ্রহণ করে।
এমনিভাবে আরবের বহু গোত্র সম্পূর্ণরূপে মুসলমান হয়ে যায়। তাদের অধিকাংশ ছিল
মরুবাসী। তাদের হিসেব সংরক্ষণ করা কোনভাবেই সম্ভব ছিলনা। তাছাড়া হযরত আবু
বকরের (রাঃ) খিলাফতকালে ভণ্ড নবী ও ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানকালে অসংখ্য
সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। তাঁদের অনেকের পরিচয় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াত ও অসংখ্য হাদীসে সাহাবীদের মর্যাদা ও ফজীলত বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি আয়াতের অর্থ উদ্ধৃত হলোঃ
‘‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল; তার সহচরগণ,
কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। আল্লাহর
অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবে। তাদের
মুখমণ্ডলে সিজদার চিহ্ন থাকবে, তাওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপই এবং
ইন্জীলেও।’’ [সূরা আল–ফাতহঃ ২৯]।
‘‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম
অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের প্রতি
প্রসন্ন এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন
জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। এটা মহা
কামিয়াবী।’’ [সূরা আত–তাওবাঃ ১০০]।
‘‘এ সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য
যারা নিজেদের ঘরবাড়ী ও সম্পত্তি হতে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও
সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাহায্য করে। তারাই তো
সত্যাশ্রয়ী। মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা এই নগরীতে (মদীনা) বসবাস করেছে ও
ঈমান এনেছে তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে এবং মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে তার
জন্য তারা অন্তরে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না, আর তারা তাদেরকে নিজেদের ওপর
প্রাধান্য দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও।’’ [সূরা আল–হাশরঃ ৮ - ৯]। এ আয়াতে প্রথমে মুহাজির ও পরে আনসারদের প্রশংসা করা হয়েছে।
এমনিভাবে সূরা আল ফাত্হঃ ১৮, সূরা আল ওয়াকিয়াঃ ১০, এবং সূরা আল আনফালের ৬৪ নাম্বার আয়াতসহ বিভিন্ন আয়াতে কোথাও প্রত্যক্ষ আবার কোথাও পরোক্ষভাবে সাহাবায়ে কিরামের প্রশংসা এসেছে।
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজেও তাঁর
সাহাবীদের শানে বক্তব্য রেখেছেন। তাঁদের সম্মান, মর্যাদা ও স্থান নির্ধারণ
করে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ
‘‘আমার উম্মাতের মধ্যে সর্বোত্তম লোক
হচ্ছে আমার যুগের লোকেরা। তারপর তার পরের যুগের লোকেরা, তারপর তার পরের
যুগের লোকেরা। তারপর এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে যাদের কসম হবে তাদের
সাক্ষ্যের অগ্রগামী। তাদের কাছে সাক্ষী চাওয়ার আগেই তারা সাক্ষ্য দেবে।’’
‘‘তোমরা আমার সাহাবীদের গালি দেবেনা, কসম
সেই সত্তার যাঁর হাতে আমার জীবন, তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও
ব্যয় করো তবুও তাদের যে কোন একজনের ‘মূদ’ বা তার অর্ধেক পরিমাণ যবের
সমতুল্য হবে না।’’
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে ইবন আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেনঃ ‘‘তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাবের যা কিছু দেওয়া হয়েছে, তার ওপর
আমল করতে হবে। তা তরক করা সম্পর্কে তোমাদের কারো কোন ওজর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য
হবে না। যদি আল্লাহর কিতাবে কোন সিদ্ধান্ত না পাওয়া যায় তাহলে আমার
সুন্নাতে খোঁজ করতে থাক। যদি তাতেও না পাওয়া যায় তাহলে আমার সাহাবীদের কথায়
তালাশ করতে হবে। আমার সাহাবীরা আকাশের তারকা সদৃশ। তার কোন একটিকে তোমরা
গ্রহণ করলে সঠিক পথ পাবে। আর আমার সাহাবীদের পারস্পরিক ইখতিলাফ বা
মতপার্থক্য তোমাদের জন্য রহমত স্বরূপ।’’
সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ
‘‘আমার পরে আমার সাহাবীদের পারস্পরিক
মতপার্থক্য সম্পর্কে আমার ‘রব’- প্রভুকে জিজ্ঞেস করলাম। আল্লাহ আমার কাছে
ওহী পাঠালেনঃ হে মুহাম্মাদ, তোমার সাহাবীরা আমার কাছে আকাশের তারকা সদৃশ।
তারকার মত তাঁরাও একটি থেকে অন্যটি উজ্জ্বলতর। তাঁদের বিতর্কিত বিষয়ের কোন
একটিকে যে আঁকড়ে থাকবে, আমার কাছে সে হবে হিদায়াতের ওপরে।’’
ইমাম শাফেঈ হযরত আনাস ইবন মালিকের সনদে
একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ আমাকে ও আমার
সাহাবীদেরকে মনোনীত করেছেন। তাদের সাথে আমার বৈবাহিক সম্পর্ক কায়েম করে
দিয়েছেন এবং তাদেরকে আমার আনসার বানিয়ে দিয়েছেন। শেষ যামানায় এমন একদল
লোকের আবির্ভাব হবে যারা তাদের অবমাননা করবে। সাবধান, তোমরা তাদের
ছেলে-মেয়ে বিয়ে করবে না, তাদের কাছে ছেলে-মেয়ে বিয়েও দেবে না। সাবধান, তাদের
সাথে নামায পড়বে না, তাদের জানাযাও পড়বে না। তাদের ওপর আল্লাহর লা’নত।
মিশকাত শরীফে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ আমার উম্মাতের মধ্যে একটি ফিরকাই নিশ্চিত জান্নাতী হবে।
জিজ্ঞেস করা হলো, তারা কে? বললেনঃ যারা আমার ও আমার সাহাবীদের আদর্শের ওপর
প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
অন্য একটি হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ ‘আমার উম্মাতের মধ্যে সাহাবীদের স্থান তেমন, যেমন খাবারের মধ্যে লবণের স্থান।’
সাহাবীদের সমাজ ছিল একটি আদর্শ মানব সমাজ।
তাঁদের কর্মকাণ্ড মানব জাতির জন্য একটি উৎকৃষ্টতম নমুনা স্বরূপ। জীবনের
প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁদের সততা, বিশ্বস্ততা, ভদ্রতা, আত্মত্যাগ ও সদাচরণ
তুলনাবিহীন। তাঁরা ছিলেন একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিশীল। গরীব ও
মুহতাজ শ্রেণীর প্রয়োজন ও চাহিদাকে তাঁরা সবসময় অগ্রাধিকার দিতেন। বীরত্ব ও
সাহসিকতায় তাঁরা ছিলেন নজীরবিহীন। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ইত্তেবা বা অনুসরণ ছিল
তাঁদের জীবনের মূল লক্ষ্য। তাঁদের জীবন-মরণ উভয়ই ছিল ইসলামের জন্য।
হযরত রাসূল করীম (সাঃ) যে সর্বোত্তম সমাজের
ভিত্তি রেখেছিলেন, সাহাবায়ে কিরাম হচ্ছেন সেই সমাজের প্রথম নমুনা। রাসূল
পাকের (সাঃ) সুহবতের বরকতে তাঁরা মহান মানবতার বাস্তব রূপ ধারণ করেছিলেন।
‘আদল, তাকওয়া, দিয়ানাত, ইহসান এবং খাওফে খোদার তাঁরা ছিলেন সমুজ্জ্বল
প্রতীক। তাঁদের মধ্যে এই অনুভূতি সদা জাগ্রত ছিল যে, এই পৃথিবীতে তাঁদের
আগমণ ইসলামের ঝাণ্ডা সমুন্নত করা ও মানব জাতির মধ্যে সমতা ও ন্যায় বিচার
প্রতিষ্ঠার জন্য। এখানে তাঁদেরকে খিলাফতে ইলাহিয়ার আমীন বা বিশ্বাসী রূপে
আল্লাহর উদ্দেশ্য পূরণ করতে হবে।
পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতা তাঁদের মধ্যে এমন
পরিচ্ছন্ন হৃদয় ও ন্যায়ের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছিল যে, হক ও
ইনসাফের ব্যাপারে তাঁরা যেমন নিজেদেরকে দায়িত্বশীল মনে করতেন, তেমন মনে
করতেন অন্যদেরকেও। তাঁরা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও নিজেদের সন্তান ও
আত্মীয়-বন্ধুদের শরয়ী বিধানের শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারেননি, বাঁচাতে
চেষ্টাও করেননি।
মোটকথা ঈমান ও বিশ্বাস তাদের সামগ্রিক
যোগ্যতাকে আলোকিত করে দিয়েছিল। তাঁরা খুব অল্প সময়ে বিশ্বের সর্বাধিক অংশ
প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁদের সামরিক ও সাংগঠনিক যোগ্যতার ভুরিভুরি নজীর
ইতিহাসের পাতায় বিদ্যমান।
সাহাবায়ে কিরামের আদর্শ সমাজের অনুরূপ
সমাজ যদি আজ আমরা গড়তে চাই, আমাদের অবশ্যই তাঁদের সম্পর্কে জানতে হবে।
তাঁদের মত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। বর্তমানে মুসলিম
উম্মাহর মধ্যে কুরআনী সমাজ গড়ার যে চেতনা দেখা যাচ্ছে, তাকে সঠিক লক্ষ্যের
দিকে নিয়ে যেতে হলে সাহাবীদের জীবনীর ব্যাপক চর্চা হওয়া দরকার। তাঁদের জীবন
থেকেই দিক নির্দেশনা নিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাঙ্গালী
মুসলিম সমাজে সাহাবীদের জীবনের চর্চা খুব কম। এখানে পীর-আওলিয়ার জীবনের
কাল্পনিক কিস্সা-কাহিনী যে পরিমাণে আলোচিত হয় তার কিয়দংশও সাহাবীদের
জীবনীর আলোচনা হয়না।
আরবী-উর্দুসহ পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায়
সাহাবীদের জীবনীর ওপর বহু বড় বড় গ্রন্থ রচিত হয়েছে। ইসলামী সাহিত্যের
অন্যান্য শাখার ন্যায় এক্ষেত্রেও বাংলা ভাষায় উল্লেখযোগ্য তেমন কোন গ্রন্থ
রচিত হয়নি। মাসিক ‘পৃথিবী’-র নির্বাহী সম্পাদক ও বাংলাদেশ ইসলামিক
সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক নাজির আহমদ তার পত্রিকার মাধ্যমে সাহাবীদের
জীবনের কিছু কথা পাঠকদের কাছে তুলে ধরার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মূলতঃ তারই
উৎসাহে আমি ধারাবাহিকভাবে ‘পৃথিবী’র পাতায় লিখতে থাকি। ‘পৃথিবী’র পাতার
লেখাগুলিই ‘আসহাবে রাসূলের জীবনকথা’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হচ্ছে।
ধারাবাহিকভাবে লেখা ও বই আকারে প্রকাশের ব্যাপারে অধ্যাপক নাজির আহমদের
উৎসাহ ও ভূমিকা না থাকলে হয়তো আমি কখনো লিখতাম না এবং বই আকারে প্রকাশও
হতো না। তাই দু’আ করি, আল্লাহ তা’আলা তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
‘আসহাবে রাসূলের জীবনকথা’র প্রথম খণ্ডে
মোট তিরিশজন সাহাবীর জীবনের আলোচনা এসেছে। তাঁরা সকলেই মুহাজিরীন তাবকার
অন্তর্ভুক্ত। তাঁদের মধ্যে ‘আশারা মুবাশ্শারা’র সেই গৌরবান্বিত দশ জন
সাহাবীও সন্নিবেশিত হয়েছেন। লেখাগুলো সংক্ষিপ্ত হলেও তথ্যসমূহ আরবী-উর্দুর
মূল সূত্রসমূহ থেকে গৃহীত হয়েছে। বিতর্কিত বিষয় যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা
করেছি।
পরিশেষে, পাঠকবৃন্দ এই লেখা থেকে
বিন্দুমাত্র উপকৃত হলে আমার কষ্ট সার্থক বলে মনে করবো। কোথাও কোন
ভুল-ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তা আমার গোচরে আনার জন্য পাঠকদের প্রতি অনুরোধ
জানাচ্ছি।
প্রকাশনার সাথে জড়িত ভাই কামরুল ইসলাম সহ
সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আল্লাহ পাক আমার এ সামান্য শ্রমটুকু
কবুল করুন। আমীন।
২৭-২-১৯৮৯ ইং
লেখকঃ ড. মুহাম্মাদ আবদুল মাবুদ
আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
(বইঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা–প্রথম
খন্ড)
No comments:
Post a Comment