লোভ মানব
চরিত্রের অত্যন্ত নিন্দনীয় অভ্যাস। এটি মানব চরিত্রকে ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংস করে
দেয় দুনিয়া-আখিরাতের সুখময় আবাসকে।
হযরত কাব বিন
মালেক আনসারি (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে
ছাগল-পালের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া যতটা না বিপদজনক, মানুষের ঈমান আমলের জন্য লোভ-লালসা
তার চেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক।”[১]
লোভী ব্যক্তি
কখনোই সৎচরিত্রবান হতে পারে না। কেননা, পরশ্রীকাতরতা, কৃপণতা, গর্ব-অহংকার,
শত্রুতা, অন্যের অনিষ্ট কামনা, অন্যকে ঘৃণা করা, অন্যের উন্নতি ও সুখ সহ্য করতে না
পারা, ধন-সম্পদ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ, ভাই-বোনের সম্পর্ক নষ্ট, আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্কে
বিচ্ছেদ, পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে মামলা-মোকাদ্দমা এবং দুর্নীতিতে জড়িত হওয়া ইত্যাদি
লোভের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
আবূ হুরাইরাহ
(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন,
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
বলেছেনঃ তোমরা অবশ্যই পরশ্রীকাতরতা পরিহার করবে। কারণ আগুন যেভাবে কাঠকে বা ঘাসকে
খেয়ে ফেলে, তেমনি পরশ্রীকাতরতাও মানুষের নেক আমলকে খেয়ে ফেলে।[২]
সম্পদের প্রতি
আসক্তির কারণে লোভী ব্যক্তি অন্তরের দিক থেকে দরিদ্র্য হয়ে থাকে। আর প্রকৃত দরিদ্রতা
হল অন্তরের দরিদ্রতা।[৩] তাছাড়া লোভ ব্যক্তিকে সংকীর্ণ হৃদয়সম্পন্ন, ব্যক্তিত্বহীন
ও পরমুখাপেক্ষী করে তোলে। অর্থাৎ, সম্পদের মোহাবিষ্টতার কারণে আরো আরো সম্পদ
কুক্ষিগত করার নিমিত্তে সে যে কোনো ধরণের অন্যায়, হীন, নীচ কাজ করতে দ্বিধা করেনা।
ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে সে জনগণের স্বার্থহানি করে এবং নিজ প্রয়োজন
সাপেক্ষে কোনো ব্যক্তি বিশেষ বা গোষ্ঠীর কাছে নিজেকে মেরুদণ্ডহীনভাবে উপস্থাপন
করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনা।
ওমর ফারূক
(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি লোকদেরকে
উদ্দেশ্য করে বলেন, হে লোকেরা! মনে রাখবে লোভ লালসা এক রকমের মুখাপেক্ষিতা
(দরিদ্রতা)। আর মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষী থাকা, ধনী হবার লক্ষণ। মানুষ যখন অন্যের
কাছে কোনো কিছু আশা করা ত্যাগ করে, তখন সে স্বনির্ভর হয়।[৪] অর্থাৎ, লোভ করলে
আত্মা দরিদ্র হয়ে যায়। কল্ব মরে যায়। ইবাদতে স্বাদ পাওয়া যায় না।
আমাদের সমাজের
লোভী মানুষগুলোর আচরণ পর্যবেক্ষন করলে আমরা দেখতে পাই, একজন লোভী মানুষ প্রতিনিয়তই
নতুন নতুন ধারণা ও উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে নিজের লোভকে তুষ্ট করার চেষ্টায় রত
থাকে। অন্যকে ঠকিয়ে এবং বঞ্চিত করে সে আনন্দ অনুভব করে। সম্পদকে সে সম্মান ও
গৌরবের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে। নিজেকে সম্পদে সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে সে
বিভিন্ন অন্যায় অজুহাত উপস্থাপন, অবিশ্বাস্য জালিয়াতি এবং অকল্পনীয় মিথ্যার আশ্রয়
নেয়।
আবদুল্লাহ ইবন
আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
বলেছেনঃ তোমরা কৃপণতার ব্যাপারে সাবধান হও। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা কৃপণতার
কারনে ধ্বংস হয়েছে। অর্থলোভ তাদেরকে কৃপণতার নির্দেশ দিয়েছে, ফলে তারা কৃপণতা
করেছে, তাদেরকে আত্মীয়তা ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছে, তখন তারা তাই করেছে এবং
তাদেরকে পাপাচারে প্ররোচিত করেছে, তারা তাতে লিপ্ত হয়েছে।[৫]
নিচের ঘটনাটি
আমাদেরকে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে সম্পদের প্রতি লোভ তথা অন্যায় আগ্রহ থেকে বিরত
থাকতে এবং আমাদের লোভী মানুষিকতার সংস্কার করণের মাধ্যমে চিরস্থায়ী জান্নাত
অর্জনের প্রতিযোগীতায় প্রতিযোগী হতে সাহায্য করবে।
হ্যাঁ, ঘটনাটি
অবশ্যই আমাদেরকে সাহায্য করবে, যদি আমরা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস, আল্লাহর
রাসূল (সাঃ) এবং তাঁর আনীত দ্বীনের প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য, জাহান্নামকে ভয় এবং
আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা জান্নাত অর্জনের আন্তরিক ইচ্ছা নিয়ে ঘটনাটি পড়ি।
ঘটনাটির
বর্ণনাঃ
আবু হুরায়রা (রাঃ)
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির
নিকট থেকে একখণ্ড জমি ক্রয় করেছিল। যে ব্যক্তি জমি ক্রয় করে সে ঐ জমিতে একটি
স্বর্ণভর্তি কলসী পায়। সে বিক্রেতাকে বলে যে, আপনার স্বর্ণ আপনি নিয়ে নিন। আমি
তো আপনার নিকট থেকে শুধু জমিই ক্রয় করেছি। স্বর্ণ ক্রয় করিনি।
জমির মালিক
বলে, আমি জমি এবং জমির অভ্যন্তরস্থ সবকিছু আপনার নিকট বিক্রয় করেছি। তারা দু’জনে মীমাংসার জন্যে তৃতীয় এক ব্যক্তিকে সালিশ
নির্ধারণ করে। সে ব্যক্তি বলে, আপনাদের কোন ছেলে-মেয়ে আছে কি? একজন বললো, আমার
একটি পুত্র সন্তান আছে। অন্যজন বললো, আমার আছে একটি কন্যা সন্তান। মীমাংসাকারী
ব্যক্তিটি বললো, ঐ মেয়েকে ঐ ছেলেটির নিকট বিয়ে দিয়ে দিন। ঐ স্বর্ণ দু’জনের জন্যে ব্যয় করুন এবং ঐ দু’জনকে দান করে দিন।[৬]
বনী ইসরাঈলের
বর্ণনায় ইমাম বুখারী (রহঃ) এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। ইমাম মুসলিম (রহঃ)-ও হাদীসটি
উদ্ধৃত করেছেন। তিনি এও উল্লেখ করেছেন যে, বাদশাহ যুলকারনাইন-এর যুগে এ ঘটনাটি
ঘটেছিল। যুলকারনাইনের যুগ তো বনী ইসরাঈলের যুগের বহু পূর্বে ছিল। আল্লাহই ভাল
জানেন।[৭]
আরেকটি
বর্ণনায় ঘটনাটি এভাবে পাওয়া যায়ঃ
ইসহাক ইবন
বিশররে তাঁর আল মুরতাদা গ্রন্থে সাঈদ ইবন আবী আরুবাহ----হাসান (রহঃ) থেকে বর্ণনা
করেছেন যে, যুলকারনাইন নিজে তার অধীনস্থ রাজা-বাদশাহ এবং কর্মচারীদের অবস্থা
পর্যবেক্ষণ করতেন। কারো সম্পর্কে কোন বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনা তার গোচরে এলে তিনি সে
ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। নিজে সরাসরি অবগত না হয়ে কারো অভিযোগের
প্রেক্ষিতে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন না।
একদিন তিনি
ছদ্মবেশে এক শহরে ঘুরছিলেন। একাদিক্রমে কয়েকদিন তিনি এক বিচারকের আদালতে বসেন।
তিনি দেখলেন, কেউই বিচার প্রার্থী হয়ে ঐ বিচারকের আদালতে আসে না। বেশ কয়েকদিন
পর্যন্ত এ অবস্থা লক্ষ্য করার পর যুলকারনাইন যখন এ বিচারক সম্বন্ধে কিছুই জানতে
পারলেন না তখন তিনি ওখান থেকে ফিরে যেতে মনস্থ করেন। সেদিনই তিনি লক্ষ্য করলেন,
দু’জন লোক বিচারপ্রার্থী হয়ে উক্ত বিচারকের নিকট এসেছে। একজন আরজি পেশ করে বলে
যে, মাননীয় বিচারক! আমি ঐ ব্যক্তি থেকে একটি বাড়ি ক্রয় করে তা আবাদ করি। ঐ
বাড়িতে আমি গুপ্ত ধনের সন্ধান পাই। আমি তাকে এটি নিয়ে যেতে বলি। কিন্তু সে তা
নিয়ে যেতে অস্বীকার করে।
অপরজনকে
উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, এ ব্যাপারে তুমি কি বল? জবাবে সে বললো, আমি কখনো এ
মাটির নিচে কোন সম্পদ লুকিয়ে রাখিনি এবং এ গুপ্তধন সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
সুতরাং এটি আমার নয়। আমি তা গ্রহণ করব না। বাদী বলে, মাননীয় বিচারক। কাউকে আমার
নিকট থেকে তা নিয়ে আসতে আদেশ করুন। তারপর আপনার যেখানে খুশী তা ব্যবহার করবেন।
বিচারক বললেন, তুমি নিজে যে বিপদ থেকে রক্ষা পেতে চাও আমাকে তার মধ্যে জড়াতে
চাচ্ছো? তুমি আমার প্রতি সুবিচার করনি। আমি মনে করি, দেশের আইনেও এরূপ বিধান নেই।
বিচারক আরও বললেন, আচ্ছা, আমি কি এমন একটি ব্যবস্থা করব যাতে তোমাদের উভয়ের প্রতি
ইনসাফ হয়। তারা বললো, অবশ্যই।
বিচারক বাদীকে
উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার কি কোন পুত্র সন্তান আছে? সে বললোঃ জ্বী, হ্যাঁ।
অপরজনকে বললেন, তোমার কি কোন কন্যা সন্তান আছে? সে বললোঃ জ্বী, হ্যাঁ। তিনি বললেন, দু’জনেই যাও তোমার মেয়েকে তার ছেলের সাথে বিবাহ দিয়ে
দাও। এ সম্পদ থেকে তাদের বিবাহের ব্যয় নির্বাহ করবে। আর যা অবশিষ্ট থাকবে তা
তাদেরকে দিয়ে দেবে। সেটি দ্বারা তারা তাদের সংসার চালাবে। তাহলে দু’জনেই এ ধনের লাভ-ক্ষতির সমান অংশীদার হবে।
বিচারকের রায় শুনে বাদশাহ যুলকারনাইন মুগ্ধ হলেন। তারপর বিচারককে ডেকে বললেন, আপনার মত এমন
চমৎকার করে বিচার অন্য কেউ করতে পারে বলে আমার মনে হয় না। অন্য কোন বিচারক এমন
ফয়সালা দিতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। বিচারক বাদশাহকে চিনেননি। তিনি বললেন,
কেউ কি এছাড়া অন্য কোন রায় দিতে পারে? যুলকারনাইন বললেন, হ্যাঁ, দেয়ই তো। বিচারক বললেন, তারপরও ওদের দেশে কি বৃষ্টি বর্ষিত হয়? একথা শুনে বিস্মিত হলেন
যুলকারনাইন। তিনি মন্তব্য করলেন, এরূপ লোকের বদৌলতেই আসমান-যমীন এখনও টিকে রয়েছে।[৮]
ঘটনা থেকে
শিক্ষাঃ
১. সততা বান্দার এমন একটি শ্রেষ্ঠ গুণাবলি যার কারণে
আল্লাহ বান্দাকে দুনিয়াতে সম্মানিত করেন এবং আখেরাতে করবেন ব্যাপকভাবে পুরস্কৃত।
উক্ত ঘটনার দু’ব্যক্তির মাঝে আমরা সততার এক আদর্শস্থানীয়
দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। আমরা দেখতে পাই যে, দু’জন ব্যক্তিই তাদের জ্ঞান বহির্ভূত সম্পত্তি (মাটির
নিচ থেকে প্রাপ্ত স্বর্ণের কলসি) গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে যেহেতু তারা দু’জনই জানত যে উক্ত সম্পত্তি তাদের নয়।
২. উক্ত
ঘটনাটি আমাদেরকে পার্থিব সম্পদের মোহগ্রস্ততা থেকে বিমুখ হতে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত
করে।
মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো সে সম্পদকে ভালোবাসবে
এবং স্বর্ণ, রৌপ্য ও দুনিয়ার অন্যান্য
সম্পদে সম্পদশালী হতে চাইবে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনে বলছেনঃ নারী জাতি,
সন্তান সন্তুতি, কাঁড়ি কাঁড়ি সোনা রুপা, পছন্দসই ঘোড়া, গৃহপালিত জন্তু ও জমিনের
ফসলকে (সব সময়ই) মানব সন্তানের জন্যে লোভনীয় করে রাখা হয়েছে। এ সব হচ্ছে পার্থিব
জীবনেরে ভোগের সামগ্রী (মাত্র! স্থায়ী জীবনের) উৎকৃষ্ট আশ্রয় তো একমাত্র আল্লাহ
তায়ালার কাছেই রয়েছে। [সূরা আলে ইমরানঃ ০৩/১৪]।
এটা আবশ্যক নয়
যে, একজন মানুষ পার্থিব সম্পদের প্রতি তার ভালোবাসাকে ত্যাগ করবে। কিন্তু এটা
অত্যাবশ্যক যে, সে অবশ্যই সম্পদের প্রতি
তার ভালোবাসাকে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা তথা তাঁর আদেশ-নিষেদের আজ্ঞাধীন করবে। ফলে
সে হারাম উপায়ে সম্পদ উপার্জন থেকে বিরত থাকবে এবং হালাল উপায়ে সম্পদ উপার্জনের
ক্ষেত্রেও সে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করবে ও প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ ও সম্মান
উপার্জনের চেষ্টায় রত থেকে আল্লাহ প্রদত্ত অলঙ্গনীয় (ফরজ) আদেশ-নিষেদের প্রতি
অবজ্ঞা বা অবহেলা প্রদর্শন করবেনা।
৩. লোভের
কারণে স্বভাবতই মানুষের হৃদয় কৃপণ[৯] এবং কৃপণতা জান্নাতের পথে বড় অন্তরায়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেনঃ
যারা কৃপণতা করে এবং লোককে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহ হতে তাদেরকে যা দান করেছেন তা গোপন করে, (আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন না।) আর আমি অবিশ্বাসীদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্ত্তত করে রেখেছি। [সূরা আন-নিসাঃ ৪/৩৭]।
যারা কৃপণতা করে এবং লোককে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহ হতে তাদেরকে যা দান করেছেন তা গোপন করে, (আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন না।) আর আমি অবিশ্বাসীদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্ত্তত করে রেখেছি। [সূরা আন-নিসাঃ ৪/৩৭]।
আল্লাহ
তায়ালা নিজের অনুগ্রহ দিয়ে তাদের যে প্রাচুর্য দিয়েছেন যারা তা আল্লাহর পথে
ব্যয় করতে কার্পণ্য করে- তারা যেন কখনো এটা মনে না করে, এটা তাদের জন্যে কোনো
কল্যাণকর কিছু হবে; না, এ (কৃপণতা আসলে) তাদের জন্যে খুবই অকল্যাণকর; অচিরেই তা
দিয়ে তাদের গলায় বেড়ি পরিয়ে দেয়া হবে, আসমানসমূহ ও যমীনের উত্তরাধিকার আল্লাহ
তায়ালার জন্যেই, আর তোমরা যা করো আল্লাহ তায়ালা তা সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন।
[সূরা আলে-ইমরানঃ ৩/১৮০]।
হ্যাঁ, এ
হচ্ছো তোমরা! তোমাদেরই তো ডাকা হচ্ছে আল্লাহর পথে সম্পদ খরচ করার জন্যে, (অতপর)
তোমাদের একদল লোক কার্পণ্য করতে শুরু করলো, অথচ যারা কার্পণ্য করে তারা
(প্রকারান্তরে) নিজেদের সাথেই কার্পণ্য করে; কারণ আল্লাহ তায়ালা তো (এমনিই
যাবতীয়) প্রয়োজনমুক্ত এবং তোমরাই হচ্ছো অভাবগ্রস্তু, (তা সত্ত্বেও) যদি তোমরা
(আল্লাহর পথে) ফিরে না আসো, তাহলে তিনি তোমাদের জায়গায় অন্য (কোনো) এক জাতির
উত্থান ঘটাবেন, অতপর তারা (কখনো) তোমাদের মতো হবে না। [সূরা মুহাম্মাদঃ ৪৭/৩৮]।
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন,
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ প্রতিদিন ভোরে (আকাশ থেকে)
দু’জন মালাক (ফেরেশতা) নেমে আসে। এদের একজন দু’আ করে, হে আল্লাহ! দানশীলকে তুমি বিনিময় দাও। আর
দ্বিতীয় মালাক এ বদ দু’আ করে, হে
আল্লাহ! কৃপণকে ক্ষতিগ্রস্ত করো।[১০]
আবূ হুরাইরাহ
(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আমি
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তির
চরিত্রে কৃপণতা, ভীরুতা ও হীনমানসিকতা রয়েছে সে খুবই নিকৃষ্ট।[১১]
৪. ইসলামি শরীয়ত বহির্ভূত কাজকর্ম এবং সন্দেহজনক বস্তু ও আচরণ থেকে দূরে থাকা তাকওয়া বা আল্লাহভীতির পরিচয়। উক্ত ঘটনায় ক্রেতা-বিক্রেতা দু’জনের চরিত্রেই আমরা তাকওয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করি। আমরা দেখতে পাই দু’জন ব্যক্তিই মাটির নিচ থেকে প্রাপ্ত স্বর্ণের কলসীর মালিকানা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে যেহেতু তারা জানত উক্ত স্বর্ণের কলসির প্রকৃত মালিক তারা নয়।
৫. উক্ত
ঘটনাটি আমাদেরকে এ শিক্ষাও দেয় যে, আমরা যখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ছোট-বড় বিভিন্ন
বিষয়ে আমাদের মধ্যে মতানৈক্যে পৌঁছে যাই তখন যেন আমরা তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে আমাদের
মধ্যে বিচারক হিসেবে নিয়োগ করি। বিচারক অবশ্যই বিচার ফায়সালা করবেন ইসলামী শরীয়তের
ভিত্তিতে এবং তিনি হবেন একজন ঈমানদার, তাকওয়াবান ও জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি তার
জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করবেন এবং ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বিচার ফায়সালা
করবেন।
৬. লোভের কুফল
ও ভয়াবহতা সম্পর্কে কোরআনের বক্তব্যঃ
(I)
প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। যতক্ষণ না তোমরা (মরে)
কবরে উপস্থিত হও। কখনও নয়, তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে। আবার বলি, কখনও নয়, তোমরা
শীঘ্রই জানতে পারবে। সত্যিই, তোমাদের নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা জানতে (ঐ
প্রতিযোগিতার পরিণাম)। তোমরা তো জাহান্নাম
দেখবেই। আবার বলি, তোমরা তো ওটা দেখবেই চাক্ষুষ প্রত্যয়ে। এরপর অবশ্যই সেদিন তোমরা
সুখ-সম্পদ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে। [সূরা আত-তাকাসুরঃ ১০২/০১-০৮]।
(II) দুর্ভোগ
রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে, যে (মানুষদের) নিন্দা করে। যে (কাঁড়ি
কাঁড়ি) অর্থ জমা করে এবং তা গুনে গুনে রাখে। সে মনে করে, (তার এ) অর্থ তাকে (এ
দুনিয়ায়) স্থায়ী করে রাখবে। না, কখনো নয়,
অল্পদিনের মধ্যেই সে নির্ঘাত চূর্ণবিচূর্ণকারী আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। [সূরা আল-হুমাযাঃ
১০৪/১-৪]।
(III) অবশ্যই
সে ধন-সম্পদের আসক্তিতে অত্যন্ত প্রবল। [সূরা আদিয়াতঃ ১০০/৮]।
অর্থাৎ, মানুষ
ধন-সম্পদের ব্যাপারে অতি লালসা রাখে ও কৃপণতা বা বখীলী করে এবং এই মোহে পড়ে মানুষ
আল্লাহর পথে আসতে অনীহা প্রকাশ করে।
(IV) তার
(রাশি রাশি) ধনসম্পদ তার কাজে লাগবে না যখন তার পতন হবে। [সূরা আল-লাইলঃ ৯২/১১]।
(V) আর যারা
অন্তরের সংকীর্ণতা হতে মুক্ত, তারাই সফলকাম। [সূরা আত-তাগাবুনঃ ৬৪/১৬; সূরা
আল-হাশরঃ ৫৯/৯]।
এখানে আরবী
'শুহ' শব্দটি দ্বারা লোভ, কৃপণতা ও পরশ্রীকাতরতাসহ মানব মনের সব ধরণের সংকীর্ণতাকে
বুঝানো হয়েছে।
(VI) অতপর
(একদিন) সে (কারূন) তার লোকদের সামনে
(নিজের শান শওকতের প্রদর্শনী করার জন্যে) জাঁকজমকের সাথে বের হলো; (মানুষদের মাঝে) যারা পার্থিব জীবনের (ভোগবিলাস) কামনা করতো তখন তারা বললো, আহা! (কতো ভালো হতো) কারূনকে
যা দেয়া হয়েছে তা যদি আমাদেরও থাকতো, আসলেই
সে মহাভাগ্যবান ব্যক্তি। [সূরা আল-কাসাসঃ ২৮/৭৯]। পরিশেষে আমি তাকে এবং তার
(ঐশ্বর্যে ভরা) প্রাসাদকে যমীনে গেড়ে দিলাম। [সূরা আল-কাসাসঃ ২৮/৮১]।
(VII) আপনি কি
তাকে দেখেন না, যে তার প্রবৃত্তিকে (লোভ, লালসা, কামনা, বাসনা, কৃপণতা,
পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি) উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? [সূরা আল-ফুরকানঃ ২৫/৪৩]।
(VIII) যারা
শুধু এ পার্থিব জীবন ও তার প্রাচুর্য কামনা করে, আমি তাদেরকে তাদের কৃতকর্মগুলির
ফল দুনিয়াতেই পরিপূর্ণরুপে আদায় করে দেই এবং সেখানে তাদের জন্যে কিছুই কম করা হয়
না। এরাই হচ্ছে সেসব (দুর্ভাগা) লোক যাদের জন্যে আখিরাতে (জাহান্নামের) আগুন ছাড়া
আর কিছুই থাকবেনা, তারা এখানে যা কিছু করেছে সবই বরবাদ করেছে; আর তারা যা করত তা
ছিল নিরর্থক। [সূরা হূদঃ ১১/১৫-১৬]।
(IX) যে ব্যক্তি দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমি তাকে
(দুনিয়ায়) তার কিছু অংশ দান করি (তবে ততটা নয়, যতটা সে চায়; বরং ততটা যতটা আল্লাহ
চান ও তার লিখিত তকদীরে নির্ধারিত থাকে), কিন্তু আখিরাতে তার জন্যে কোনো কিছুই
থাকবেনা। [সূরা আশ-শূরাঃ ৪২/২০]।
(X) কোনো ব্যক্তি দ্রুত (দুনিয়ার সুখ সম্ভোগ) পেতে
চাইলে আমি তাকে এখানে তার জন্যে যতোটুকু দিতে চাই তা সত্বর দিয়ে দেই, (কিন্তু)
পরিশেষে তার জন্যে জাহান্নামই নির্ধারণ করে রাখি, যেখানে সে প্রবেশ করবে একান্ত
নিন্দিত, অপমানিত ও বিতাড়িত অবস্থায়। [সূরা আল-ইসরাঃ ১৭/১৮]।
(XI) (তারা সত্য) অস্বীকার করে এবং নিজ নিজ প্রবৃত্তির
(লোভ, লালসা, কামনা, বাসনা, কৃপণতা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি) অনুসরণ করে চলে। (অথচ)
প্রত্যেক কাজের একটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির (সময়) রয়েছে। [সূরা আল-কামারঃ ৫৪/০৩]।
(XII) যে ব্যক্তি আমার (সুস্পষ্ট) স্মরণ থেকে সরে গেছে,
তার ব্যাপারে তুমি কোনো পরোয়া করো না, (কারণ) সে তো পার্থিব জীবন ছাড়া আর কোনো
কিছুই কামনা করেনা। [সূরা আন-নাজমঃ ৫৩/২৯]।
(XIII) তাদের পরে এলো অপদার্থ পরবর্তীরা; তারা সালাত নষ্ট
করল ও লালসা পরবশ হল; সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। [সূরা
মারইয়ামঃ ১৯/৫৯]।
এই আয়াতের
পূর্বের আয়াতগুলোতে আল্লাহ সৎ লোকদের বিশেষ করে নাবীগণের (আঃ) বর্ণনা করলেন, যারা
আল্লাহর হুদূদের রক্ষণাবেক্ষণকারী, সৎ কাজের নমুনা স্বরূপ এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে
অবস্থানকারী ছিলেন। এখন তিনি মন্দ লোকের বর্ণনা দিচ্ছেন যারা ঐ ভাল লোকদের পর এমনই
হয় যে, তারা সালাত হতে বেপরোয়া হয়ে যায়। সালাতের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ফরজকে
যখন তারা ভুলতে বসে তখন এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, অন্যান্য ফরজগুলিকে কি
তারা পরোয়া করতে পারে? কেননা সালাত হচ্ছে দীনের ভিত্তি এবং সমস্ত আমল হতে এটি
উত্তম ও মর্যাদা সম্পন্ন। ঐ লোকগুলি তাদের কুপ্রবৃত্তির (লোভ, লালসা, কামনা,
বাসনা, কৃপণতা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি) পিছনে লেগে পড়ে। পার্থিব জীবনেই তারা
সন্তুষ্ট হয়ে যায়। কিয়ামতের দিন তারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।[১২]
(XIV) আর আমি চাইলে তাকে এ (আয়াতসমূহ) দ্বারা উচ্চ
মর্যাদা দান করতে পারতাম, কিন্তু সে তো
(উর্ধমুখী আসমানের বদলে) নিম্নমুখী যমীনের প্রতিই আসক্ত হয়ে পড়ে এবং (পার্থিব)
কামনা-বাসনার অনুসরণ করে। তার উদাহরণ হচ্ছে কুকুরের উদাহরণের মতো, যদি তুমি তাকে দৌড়াতে থাকো সে (জিহ্বা বের করে)
হাঁপাতে থাকে, আবার তুমি সেটিকে ছেড়ে দিলেও সে (জিহ্বা ঝুলিয়ে) হাঁপাতে থাকে, এ
হচ্ছে তাদের দৃষ্টান্ত যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, এ কাহিনীগুলো
(তাদের) তুমি পড়ে শোনাও, হয়তো বা তারা চিন্তা-গবেষণা করবে। [সূরা আল-আ'রাফঃ
০৭/১৭৬]।
(XV) সত্য যদি তাদের কামনা-বাসনার অনুগামী হতো, তাহলে
বিশৃংখল হয়ে পড়তো আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং ওদের মধ্যবর্তী সবকিছুই; পক্ষান্তরে আমি
তাদেরকে দিয়েছি উপদেশ, কিন্তু তারা উপদেশ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়। [সূরা আল-মুমিনুনঃ
২৩/৭১]।
(XVI) আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও
সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহবান করে এবং আপনি
পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার
মনকে আমার স্মরন থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে, নিজের প্রভৃতির অনুসরণ করে এবং যার
কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না। [সূরা আল কাহফ,
আয়াতঃ ১৮/২৮]।
(XVII) হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমাদের ঐশ্বর্য ও সন্তানাদি
যেন কখনো তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে দেয়, (কেননা) যারা এ কাজ করবে
তারা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। [সূরা আল-মুনাফিকূনঃ ৬৩/৯]।
(XVIII) আল্লাহ তা'আলার (শাস্তির) কাছ থেকে (তাদের বাঁচানোর
জন্যে) সেদিন তাদের ধন সম্পদ, সন্তান সন্ততি কোনোটাই কোনো কাজে আসবে না; তারা তো জাহান্নামেরই বাসিন্দা, সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে। [সূরা
আল-মুজাদালাঃ ৫৮/১৭]।
(XIX) যে স্বীয় প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয়
রেখেছে এবং কুপ্রবৃত্তি (লোভ, লালসা, কামনা, বাসনা, কৃপণতা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি)
হতে নিজেকে বিরত রেখেছে, জান্নাতই হবে তার আশ্রয়স্থল। [সূরা আন-নাযি’আতঃ ৭৯/৪০-৪১]।
৭. লোভের কুফল
ও ভয়াবহতা সম্পর্কে হাদিসের বক্তব্যঃ
(I) আবূ
হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ জাহান্নাম কু-প্রবৃত্তি ও লোভ-লালসা
দ্বারা বেষ্টিত। আর জান্নাত বেষ্টিত দুঃখ-কষ্ট ও শ্রমসাধ্য বিষয় দ্বারা।[১৩]
(II) আনাস
(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ “আর ধ্বংসকারী বিষয় সমূহ হলঃ অনুগত লোভ, অনুসৃত
প্রবৃত্তি এবং মানুষের নিজেকে নিয়ে অহংকার বা (আত্মগরিমা)।”[১৪]
(III) আবু
বারযাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি নবী
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “নিশ্চয় আমি তোমাদের উপর যা আশংকা করছি তা হচ্ছে,
পেটের ব্যাপারে এবং যৌনাঙ্গের বিষয়ে লোভে পড়ে পথভ্রষ্ট হওয়া এবং প্রবৃত্তির
অনুসরণ করে বিভ্রান্ত হওয়া।”[১৫]
(IV) আনাস
ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নাবী
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ দুজন লোভী ব্যক্তির পেট কখনো পরিতৃপ্তি
লাভ করে না। একজন জ্ঞানপিপাসু লোক- ইলম দ্বারা তার পেট কখনো ভরে না। দ্বিতীয়জন হল
দুনিয়া পিপাসু- দুনিয়ার ব্যাপারে সেও কখনো পরিতৃপ্ত হয় না।[১৬]
(V) ইয়াজ ইবনু
হিমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা তার খুতবায় বলেছেনঃ
...........................................জাহান্নামের
অধিবাসী পাঁচ প্রকারঃ
(ক) ঐ দুর্বল ব্যক্তি; যার কোন জ্ঞান (বিচারিক বিবেক) নেই, যারা তোমাদের
(সমাজের) মধ্যে অনুসারী, (অর্থাৎ অন্যের আনুগত্যকারী), যারা পরিবার-পরিজন ও
মাল-সম্পদের ধার ধারে না।
(খ) ঐ খিয়ানাতকারী যার লোভ-লালসা গোপন হয় না (মিটে
না) যদি সামান্য বস্তু (আমানাত হিসেবে) রাখা হয় তাতেও সে খিয়ানত করে।
(গ) এবং ঐ ব্যক্তি যে সকাল-সন্ধ্যায় (সদা-সর্বদা)
তোমার পরিবার-পরিজন ও অর্থ-সম্পদের (যাবতীয়) ব্যাপারে তোমাকে ধোঁকা দেয়।
(ঘ) আর তিনি কৃপণতা কিংবা মিথ্যাবাদীতার কথা উল্লেখ
করেন (অর্থাৎ বখীল ও মিথ্যুকদের জাহান্নামীদের মধ্যে গণ্য করেছেন)।
(ঙ) এবং অসচ্চরিত্রের অধিকারী অশ্রাব্যভাষী।[১৭]
(VI) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আদম সন্তান বৃদ্ধ হয়ে গেলেও তার দু’টি স্বভাব
যুবকই থেকে যায়ঃ সম্পদের লোভ ও বেঁচে থাকার লালসা।[১৮]
(VII) ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন যে, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, যদি আদম সন্তানের দু’ উপত্যকা ভরা মালধন থাকে তবুও সে তৃতীয়টার আকাঙ্ক্ষা করবে। আর মাটি (মৃত্যু) ভিন্ন বনী আদমের পেট (চাহিদা) কিছুতেই ভরবে না। তবে যে তাওবাহ করবে, আল্লাহ্ তার তাওবাহ কবুল করবেন।[১৯]
৮. হালাল
উপায়ে, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও সম্মান উপার্জনের চেষ্টা করা এবং
সর্বাবস্থায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা মানুষের একটি অতি উত্তম গুণ।
সম্পদ ও
সম্মান দুনিয়াতে মানুষের জন্য আল্লাহর পরীক্ষাস্বরূপ।[২০] কেননা উক্ত সম্পদ ও
সম্মান কোন পথে অর্জিত হয়েছে এবং কিভাবে তা ব্যয়িত হয়েছে তার পরিপূর্ণ হিসাব
বান্দাকে আল্লাহর নিকট দিতে হবে। আল্লাহ যাকে পার্থিব জীবনে অঢেল সম্পত্তি দান
করেন তার যথাযথ ব্যবহার যেমন তাকে আখিরাতে ব্যপকভাবে সম্মানিত করবে তেমনি এর
অপব্যবহার তাকে ঢেলে দেবে জাহান্নামের অতল গহ্বরে।
৯. আমরা সম্পদ
ও সম্মান কে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করব। প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ ও সম্মানের
হিসেব থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাইব।[২১] আমরা মুমিনদের মতো করে এই দোয়া করব যে,
“হে আল্লাহ, আমাকে এই পার্থিব সম্পদের খুব বেশীও দিও না আবার খুব কমও দিও না, যেন
আমি আমার সীমা অতিক্রম না করি এবং আমার দায়িত্বগুলোও ভুলে না যাই। চিত্তবিনষ্টকারী
সম্পদের প্রাচুর্যতার চাইতে স্বল্প কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ উত্তম।”
আল্লাহ আমাদেরকে
উক্ত দু’ব্যক্তির মতো সৎ চরিত্রের অধিকারী, তাকওয়াবান, নির্লোভ, আমানতদার ও
নিয়ামতের শোকরগোজারী হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখকঃ মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম
--------------------------------------------------
[১]. জামে আত-তিরমিজি, পর্বঃ (৩৪) দুনিয়াবী ভোগবিলাসের প্রতি
অনাসক্তি, অনুচ্ছেদঃ (৪৩) সম্পদ ও প্রতিপত্তির মোহ মানুষকে পথভ্রষ্ট করে, হাদিস
নাম্বারঃ ২৩৭৬, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
[২]. সুনানে
আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ (৪৩) শিষ্টাচার, অনুচ্ছেদঃ (৫২) হিংসা-বিদ্বেষ, হাদিস নাম্বারঃ
৪৯০৩, হাদিসের মানঃ দুর্বল হাদিস।
[৩]. সহিহ
বুখারী, অধ্যায়ঃ (৮১) কোমল হওয়া, বিষয়ঃ (৮১/১৫) প্রকৃত সচ্ছলতা হলো অন্তরের
সচ্ছলতা, হাদিস নাম্বারঃ ৬৪৪৬, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
[৪]. (I)
মিশকাতুল মাসাবিহ, পর্বঃ (৬) যাকাত, অধ্যায়ঃ (৪) যার জন্য কিছু চাওয়া হালাল নয় এবং
যার জন্য হালাল, অনুচ্ছেদঃ ৩, হাদিস নাম্বারঃ ১৮৫৬।
(II) মুসনাদে
আহমাদ; সুনান আল-কুবরা লিল বায়হাক্বী (আল-সুনান আল-কাবীর); আল-মুস্তাদরাক আলা আল-সহিহাইন
(মুস্তাদরাক আল-হাকিম)।
[৫]. সুনানে
আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ (৯) যাকাত, অনুচ্ছেদঃ (৪৭) কৃপণতা সর্ম্পকে, হাদিস নাম্বারঃ
১৬৯৮, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
[৬]. (I) সহিহ
বুখারী, অধ্যায়ঃ (৬০) আম্বিয়া কিরাম (আঃ), বিষয়ঃ (৬০/৫৪) পরিচ্ছেদ, হাদিস
নাম্বারঃ ৩৪৭২, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
(II) সহিহ
মুসলিম, পর্বঃ (৩১) বিচার বিধান, অধ্যায়ঃ (১১) বিচারক কর্তৃক বিবাদমান দু’দলের
মধ্যে মীমাংসা করে দেয়া উত্তম, হাদিস নাম্বারঃ ৪৩৮৯, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
(III) রিয়াদুস
সলেহিন, অধ্যায়ঃ (১৯) বিবিধ চিত্তকর্ষী
হাদিসসমূহ, পরিচ্ছেদঃ (৩৭০) দাজ্জাল ও কিয়ামতের নিদর্শনাবলী সম্পর্কে, হাদিস
নাম্বারঃ ১৮৩৫, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
(IV) হাদিস
সম্ভার, অধ্যায়ঃ (১৮) শাসন অধ্যায়, পরিচ্ছদঃ ন্যায়-বিচার ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের
মাহাত্ম্য, হাদিস নাম্বারঃ ১৮০৬, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
(V) আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইসলামের ইতিহাসঃ
আদি-অন্ত)
লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ আল্লামা ইমাদুদ্দীন ইবন
কাসীর আদ-দামেশকী (রহঃ)
বঙ্গানুবাদঃ দ্বিতীয় খণ্ড; অনুবাদকঃ মাওলানা বোরহান
উদ্দীন, মাওলানা মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন, মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ এমদাদ উদ্দীন,
মাওলানা গোলাম সোবহান সিদ্দিকী।
গ্রন্থস্বত্বঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১ম প্রকাশঃ জুন ২০০১
পৃষ্ঠা নাম্বারঃ ২৭৩
[৭]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইসলামের ইতিহাসঃ
আদি-অন্ত)
লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ আল্লামা ইমাদুদ্দীন ইবন
কাসীর আদ-দামেশকী (রহঃ)
বঙ্গানুবাদঃ দ্বিতীয় খণ্ড; অনুবাদকঃ মাওলানা বোরহান
উদ্দীন, মাওলানা মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন, মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ এমদাদ উদ্দীন,
মাওলানা গোলাম সোবহান সিদ্দিকী।
গ্রন্থস্বত্বঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১ম প্রকাশঃ জুন ২০০১
পৃষ্ঠা নাম্বারঃ ২৭৩
[৮]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইসলামের ইতিহাসঃ
আদি-অন্ত)
লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ আল্লামা ইমাদুদ্দীন ইবন
কাসীর আদ-দামেশকী (রহঃ)
বঙ্গানুবাদঃ দ্বিতীয় খণ্ড; অনুবাদকঃ মাওলানা বোরহান
উদ্দীন, মাওলানা মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন, মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ এমদাদ উদ্দীন,
মাওলানা গোলাম সোবহান সিদ্দিকী।
গ্রন্থস্বত্বঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১ম প্রকাশঃ জুন ২০০১
পৃষ্ঠা নাম্বারঃ ২৭৪
[৯]. সূরা
আন-নিসাঃ ৪/১২৮
[১০]. সহিহ
বুখারী, অধ্যায়ঃ (২৪) যাকাত, বিষয়ঃ (২৪/২৭) আল্লাহ তা’আলার বাণীঃ অতঃপর যে ব্যক্তি
দান করেছে এবং আল্লাহকে ভয় করেছে আর ভাল কথাকে সত্য বলে বুঝেছে, তবে আমি তাকে
শান্তির উপকরণ প্রদান করব। আর যে ব্যক্তি কার্পণ্য করেছে এবং বেপরোয়া হয়েছে আর ভাল
কথাকে অবিশ্বাস করেছে, ফলতঃ আমি তাকে ক্লেশদায়ক বস্তুর জন্য আসবাব প্রদান করব। (সূরা
আল-লাইলঃ ৯২/৫-১০)। হে আল্লাহ্ তার দানে উত্তম প্রতিদান দিন, হাদিস নাম্বারঃ
১৪৪২, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
[১১]. সুনানে
আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ (১৫) জিহাদ, অনুচ্ছেদঃ (২২) বীরত্ব ও কাপুরুষতা প্রসঙ্গে, হাদিস
নাম্বারঃ ২৫১১, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
[১২]. তাফসীর
ইবন কাসীর, লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ আল্লামা ইমাদুদ্দীন ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (রহঃ),
বঙ্গানুবাদঃ চতুর্দশ খণ্ড, অনুবাদঃ ডঃ মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান, প্রকাশকঃ তাফসীর
পাবলিকেশন কমিটি (পক্ষে ডঃ মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান), প্রথম প্রকাশঃ মে ১৯৮৬
ইংরেজী, পৃষ্ঠা নাম্বারঃ ১৮৮-১৮৯।
[১৩]. সহিহ
বুখারী, অধ্যায়ঃ (৮১) কোমল হওয়া, বিষয়ঃ (৮১/২৮) কামনা-বাসনা দিয়ে জাহান্নামকে
বেষ্টন করা হয়েছে, হাদিস নাম্বারঃ ৬৪৮৭, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
[১৪]. (I)
সহিহ তারগিব ওয়াত তাহরিব, অধ্যায়ঃ (২) সুন্নাত অধ্যায়, পরিচ্ছেদঃ সুন্নাত
পরিত্যাগ এবং প্ৰবৃত্তির অনুসরণ ও বিদআত চর্চার প্রতি ভীতি প্রদর্শণ, হাদিস
নাম্বারঃ ৫৩, হাদিসের মানঃ হাসান লিগাইরিহি।
(II) মুসনাদ
আল-বাযযার; সুনান আল-কুবরা লিল বায়হাক্বী (আল-সুনান আল-কাবীর) প্রমুখ গ্রন্থে
হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে।
[১৫]. (I)
সহিহ তারগিব ওয়াত তাহরিব, অধ্যায়ঃ (২) সুন্নাত অধ্যায়, পরিচ্ছেদঃ সুন্নাত
পরিত্যাগ এবং প্ৰবৃত্তির অনুসরণ ও বিদআত চর্চার প্রতি ভীতি প্রদর্শণ, হাদিস
নাম্বারঃ ৫২, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
(II) হাদীছটি
বর্ণনা করেছেন আহমদ, ত্বাবরানী ও বাযযার।
[১৬]. (I)
মিশকাতুল মাসাবিহ, পর্বঃ (২) ইলম (বিদ্যা), অনুচ্ছেদঃ ৩, হাদিস নাম্বারঃ ২৬০,
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
(II) সুনান
আল-কুবরা লিল বায়হাক্বী (আল-সুনান আল-কাবীর), হাদিস নাম্বারঃ ১০২৭৯; আল-মুস্তাদরাক
আলা আল-সহিহাইন (মুস্তাদরাক আল-হাকিম) ১/৯২।
[১৭]. (I)
সিলসিলাতুল আহাদীসুস সহীহাহ্, অধ্যায়ঃ (১) উত্তম চরিত্র, অনুকম্পা ও (আত্মীয়তার)
সম্পর্ক বজায় রাখা প্রসংগ, হাদিস নাম্বারঃ ৪৪, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
(II) সহিহ
হাদিসে কুদসী, অধ্যায়ঃ (৩৬) জান্নাত ও জাহান্নামীদের বর্ণনা, হাদিস নাম্বারঃ ৬৭,
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
(III) সহীহ
মুসলিম- ৮/১৫৯ পৃষ্ঠা, হাদিস নাম্বারঃ ৭৩৮৬; (আরবী)।
[১৮]. (I)
জামে আত-তিরমিজি, পর্বঃ (৩৫) কিয়ামত ও মর্মস্পর্শী বিষয়, অনুচ্ছেদঃ (২২) মানুষ
কামনা-বাসনা ও বিপদাপদে বেষ্টিত, হাদিস নাম্বারঃ ২৪৫৫, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
(II) সহিহ
বুখারী, অধ্যায়ঃ (৮১) কোমল হওয়া, বিষয়ঃ (৮১/৫) যে ব্যক্তি ষাট বছর বয়সে পৌঁছে
গেল, আল্লাহ্ তার বয়সের ওযর পেশ করার সুযোগ রাখেননি, হাদিস নাম্বারঃ ৬৪২১, হাদিসের
মানঃ সহিহ হাদিস।
[১৯]. সহিহ
বুখারী, অধ্যায়ঃ (৮১) কোমল হওয়া, বিষয়ঃ (৮১/১০) ধন-সম্পদের পরীক্ষা থেকে রক্ষা
পাওয়া, হাদিস নাম্বারঃ ৬৪৩৬ ও ৬৪৩৭, হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
[২০]. সূরা
আত-তাগাবুনঃ ৬৪/১৫।
[২১]. সূরা
আল-আনফালঃ ৮/২৮; সূরা আলে-ইমরানঃ ৩/১৮৬; সূরা আত-তাওবাঃ ৯/৫৫।
No comments:
Post a Comment