(১) ভূমিকা
(২) শিরক
(৩) শিরক প্রধানত চার প্রকার
(৪) মূর্তিপূজার (শিরকের) সূচনা
(৫) শিরকের ধারণা খন্ডন
(৬) শিরকের কুফল ও ভয়াবহতা
(৭) অন্তরে অপছন্দ নিয়েও মূর্তিপূজার (শিরকের) কাছে যাওয়া যাবে না
(৮) আমি কি আল্লাহর আদেশ নিষেদের প্রতি অবজ্ঞার বশবর্তী হয়ে নিজের অজ্ঞাতেই শিরক করে ফেলছি
(৯) অন্য ধর্মের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান
(১০) শির্কের ভয়ে দোয়া
তাওহীদের (একত্ববাদ) মহান বাণী নিয়ে প্রথম মানব ও প্রথম নবী আদম (আঃ) পৃথিবীতে আগমন করেন। তিনি তাঁর সন্তানদেরকে তাওহীদের শিক্ষা দান করেন। যুগ পরস্পরায় শয়তানের প্ররোচনায় তাঁর বংশধরদের মাঝে (প্রতিমা বা মূর্তি তৈরী, ওসীলা পূজা, মুর্তিকে আল্লাহর সাহায্যকারী সাব্যস্ত করা, মূর্তির সামনে মাথা নত করা) শিরকের প্রচলন ঘটে।
কুরআনের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, আদম পরবর্তী নবী নূহ (আঃ) থেকে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) পর্যন্ত সকল নবীর-ই মিশন ছিলো দুনিয়া থেকে শিরকের উৎখাত করা এবং উম্মতকে তাওহীদের বাণী শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা তথা উম্মতকে বান্দার গোলামী থেকে রক্ষা করা।
এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাই, শিরক উৎখাত এবং আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা তথা দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) আরবের মক্কা নগরীতে আগমন করেন। তিনি মূর্তিপূজাকে অসার এবং অন্তঃসারশুন্য প্রমাণ করেন। জড় মূর্তির উপর ভর করে রাষ্ট্রশক্তিতে টিকে থাকা জীবন্ত মানবমূর্তি আবু জাহেল, আবু লাহাব, উৎবা, মুগীরাদেরকে তিনি আল্লাহর একত্ববাদ এবং দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তাঁর সঙ্গী হতে আহবান করেন।
ফলস্বরুপ, শিরককে কেন্দ্র করে টিকে থাকা রাষ্ট্রশক্তির পক্ষ থেকে নেমে আসে রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সাথীদের উপর অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতন।
রাষ্ট্রশক্তিতে বর্তমান মানব মূর্তিগুলোর পক্ষ থেকে দীর্ঘ অত্যাচার ও যুলুমের পর রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ), তাঁর ও সাহাবীদের (তাঁর সাথীদের) অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় মদীনায় একত্ববাদের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র (খিলাফত রাষ্ট্র) প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমগ্র আরব ভূমি থেকে শিরক উৎখাত করেন।
শিরকঃ
শিরক দ্বারা পৌত্তলিকতা বা বহুঈশ্বরবাদ চর্চা করার পাপকে বুঝায়। শিরক শব্দের অর্থ হলো এক বা একাধিক কোন কিছুকে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও কর্তৃত্বের অংশীদার সাব্যস্ত করা, একাধিক স্রষ্টা বা উপাস্যে বিশ্বাস করা।
আল্লাহর সাথে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে শরিক করা, তাঁর সমতুল্য মনে করা কিংবা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে উপাস্য হিসেবে সাব্যস্ত করা বা তার উপাসনা করাকে শিরক বলে।
যে ব্যক্তি শিরক করে তাকে বলে মুশরিক।
এটি তাওহীদের পরিপন্থী একটি বিষয়। ইসলামে শিরক হল একটি অমার্জনীয় অপরাধ।
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ
অর্থঃ যে কেউই আল্লাহর সাথে শরীক করবে, আল্লাহ তায়ালা তার উপর জান্নাত হারাম করে দেবেন, আর তার (স্থায়ী) ঠিকানা হবে জাহান্নাম। [সূরা আল মায়িদাঃ ৭২]
শিরক প্রধানত চার প্রকার যথাঃ
১. আল্লাহ তায়ালার সত্তা ও অস্তিত্বে শিরক করা। যেমনঃ আল্লাহর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা আছে বলে বিশ্বাস করা। খ্রিস্টানরা ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র মনে করেন।
আল্লাহ বলেন,
وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَٰنُ وَلَدًا - لَقَدْ جِئْتُمْ شَيْئًا إِدًّا - تَكَادُ السَّمَاوَاتُ يَتَفَطَّرْنَ مِنْهُ وَتَنْشَقُّ الْأَرْضُ وَتَخِرُّ الْجِبَالُ هَدًّا - أَنْ دَعَوْا لِلرَّحْمَٰنِ وَلَدًا
অর্থঃ (এ মূর্খ) লোকেরা বলে, করুণাময় আল্লাহ তায়ালা সন্তান গ্রহণ করেছেন; (তুমি এদের বলো) এটি অত্যন্ত কঠিন একটি কথা, তোমরা যা (আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে) নিয়ে এসেছো, (এটা এতো কঠিন কথা) যার কারণে হয়তো আসমান ফেটে পড়ার উপক্রম হবে, যমীন বিদীর্ণ হয়ে যাবে, পাহাড়সমূহ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে, (এর কারণ) এরা দয়াময় আল্লাহ তায়ালার উপর সন্তান আরোপ করে। [সূরা মারইয়ামঃ ৮৮-৯১]
২. আল্লাহর তায়ালার গুণাবলিতে শিরক করা। যেমনঃ আল্লাহ তায়ালার পাশাপাশি অন্য কাউকে সৃষ্টিকর্তা বা রিযিকদাতা মনে করা। নবী, রাসূল ও আওলিয়াগণ গায়েব জানেন বলে মনে করা, কারণ গায়েবের জ্ঞান শুধু আল্লাহ জানেন।
আল্লাহ বলেন,
فَلَا تَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ فَتَكُونَ مِنَ الْمُعَذَّبِينَ
অর্থঃ অতএব তুমি কখনো আল্লাহ তায়ালার সাথে অন্য কোনো মাবূদকে ডেকো না, নতুবা তুমিও শাস্তিযোগ্য লোকদের দলভুক্ত হয়ে যাবে। [সূরা আশ শোয়ারাঃ ২১৩]
قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ ۚ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ
অর্থঃ (হে নবী) তুমি বলো, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে, এদের কেউই গায়েবের (অদৃশ্য জগতের) কিছু জানে না; তারা এও জানে না, কবে তাদের আবার (কবর থেকে) উঠানো হবে। [সূরা আন নামলঃ ৬৫]
৩. ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার সাথে কাউকে শরিক করা। যেমনঃ কবর কিংবা মাজারে সিজদা দেওয়া। কোন পীরকে সেজদা দেওয়া। উপাসনার নিয়তে কারো সামনে মাথা নত করা, কারও নামে পশু জবাই করা ইত্যাদি শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ বলেন,
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
অর্থঃ অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায আদায় কর এবং কুরবানী কর। [সূরা আল-কাউসারঃ ২]
নিম্নের হাদিসগুলো দেখুন,
وَحَدَّثَنِي قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، حَدَّثَنَا الْفَزَارِيُّ، عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ الأَصَمِّ، حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ الأَصَمِّ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " لَعَنَ اللَّهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ "
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ ইয়াহূদ ও নাসারাদের (খৃষ্টানদের) ওপর অভিসম্পাত বর্ষণ করুন। কারণ তারা তাদের নবীদের কবরসমূহকে মসজিদ বা সাজদার স্থান করে নিয়েছে। [সহিহ মুসলিম হাদিস নংঃ ১০৭৩, ই.ফা. ১০৬৭, ই.সে. ১০৭৫]
আমির ইবন ওয়াসিলা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, "আল্লাহ তা’আলা লা’নত করেন ঔ ব্যক্তিকে, যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে যবেহ করে।" [সুনানে আন-নাসায়ী, কুরবানী অধ্যায়, হাদিস নংঃ ৪৪২২]
৪. সৃষ্টি জগতের পরিচালনায় কাউকে আল্লাহর অংশীদার বানানো। যেমনঃ যে শাসক দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) হিসেবে ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করে অথবা রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামকে পরিপূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন করেনা তার আনুগত্য করা, ফেরেশতাদের জগৎ পরিচালনায় আল্লাহর সাহায্যকারী মনে করা ইত্যাদি।
ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন আইন মানা তাকে সঠিক মনে করা বা বিকল্প মনে করা শিরক।
আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
অর্থঃ যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না, তারাই (হচ্ছে) কাফের। [সূরা আল মায়েদাঃ ৪৪]
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ
অর্থঃ এদের কি এমন কোনো শরীক আছে, যারা এদের জন্যে এমন কোনো জীবন বিধান প্রনয়ণ করে নিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ তায়াল দান করেননি। [সূরা আশ শূরাঃ ২১]
রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
“যারা আমাদের হুকুমের মধ্যে এমন কোন নতুন কথার প্রবর্তন করবে, যা আমাদের কথা নয়, তবে তা পরিত্যক্ত।” [বুখারী ও মুসলিম]
মূর্তিপূজার (শিরকের) সূচনাঃ
আসুন মূর্তিপূজার উৎসটা একটু জেনে নেই। আল্লাহ কুরআনে নূহের (আঃ) জাতির উপাস্যগুলোর নাম উল্লেখ করেছেন, যারা আসলে তাদের পূর্ববর্তী যুগের সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। নিচের হাদীসটি একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করিঃ
إِبْرَاهِيْمُ بْنُ مُوْسَى أَخْبَرَنَا هِشَامٌ عَنْ ابْنِ جُرَيْجٍ وَقَالَ عَطَاءٌ عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا صَارَتْ الْأَوْثَانُ الَّتِيْ كَانَتْ فِيْ قَوْمِ نُوْحٍ فِي الْعَرَبِ بَعْدُ أَمَّا وَدٌّ كَانَتْ لِكَلْبٍ بِدَوْمَةِ الْجَنْدَلِ وَأَمَّا سُوَاعٌ كَانَتْ لِهُذَيْلٍ وَأَمَّا يَغُوْثُ فَكَانَتْ لِمُرَادٍ ثُمَّ لِبَنِيْ غُطَيْفٍ بِالْجَوْفِ عِنْدَ سَبَإٍ وَأَمَّا يَعُوْقُ فَكَانَتْ لِهَمْدَانَ وَأَمَّا نَسْرٌ فَكَانَتْ لِحِمْيَرَ لِآلِ ذِي الْكَلَاعِ أَسْمَاءُ رِجَالٍ صَالِحِيْنَ مِنْ قَوْمِ نُوْحٍ فَلَمَّا هَلَكُوْا أَوْحَى الشَّيْطَانُ إِلَى قَوْمِهِمْ أَنْ انْصِبُوْا إِلَى مَجَالِسِهِمْ الَّتِيْ كَانُوْا يَجْلِسُوْنَ أَنْصَابًا وَسَمُّوْهَا بِأَسْمَائِهِمْ فَفَعَلُوْا فَلَمْ تُعْبَدْ حَتَّى إِذَا هَلَكَ أُوْلَئِكَ وَتَنَسَّخَ الْعِلْمُ عُبِدَتْ
অর্থঃ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, যে প্রতিমার পূজা নূহ (আঃ)-এর কওমের মাঝে চালু ছিল, পরবর্তী সময়ে আরবদের মাঝেও তার পূজা প্রচলিত হয়েছিল। ওয়াদ “দুমাতুল জান্দাল” নামক জায়গার কাল্ব গোত্রের একটি দেবমূর্তি, সূওয়া‘আ হল হুযায়ল গোত্রের একটি দেবমূর্তি এবং ইয়াগুছ ছিল মুরাদ গোত্রের, অবশ্য পরবর্তীতে তা গাতীফ গোত্রের হয়ে যায়। এর আস্তানা ছিল কওমে সাবার নিকটবর্তী ‘জাওফ’ নামক স্থান। ইয়া‘উক ছিল হামাদান গোত্রের দেবমূর্তি, নাস্র ছিল যুলকালা গোত্রের হিময়ার শাখার মূর্তি। নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের কতিপয় নেক লোকের নাম নাস্র ছিল। তারা মারা গেলে, শয়তান তাদের কওমের লোকদের অন্তরে এ কথা ঢেলে দিল যে, তারা যেখানে বসে মাজলিস করত, সেখানে তোমরা কতিপয় মূর্তি স্থাপন কর এবং ঐ সমস্ত পুণ্যবান লোকের নামেই এগুলোর নামকরণ কর। কাজেই তারা তাই করল, কিন্তু তখনও ঐ সব মূর্তির পূজা করা হত না। তবে মূর্তি স্থাপনকারী লোকগুলো মারা গেলে এবং মূর্তিগুলোর ব্যাপারে সত্যিকারের জ্ঞান বিলুপ্ত হলে লোকজন তাদের পূজা আরম্ভ করে দেয়। [সহীহ বুখারীঃ ৪৯২০, আ.প্র. ৪৫৫১, ই.ফা. ৪৫৫৫]
সহীহ বুখারীতে ইবন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, নূহের (আঃ) যুগের মূর্তিগুলোকে আরবের কাফেররা গ্রহণ করে। ‘দাওমাতুল জানদাল’ এলাকায় কালব গোত্র ‘ওয়াদ’ মূর্তির পূজা করত। হুযায়েল গোত্র পূজা করত ‘সূওয়া’ নামক মূর্তির। মুরাদ গোত্র এবং সাবা শহরের নিকটবর্তী জারফ নামক স্থানের অধিবাসী বনু গাতীফ গোত্র ‘ইয়াগুস’ নামক মূর্তির উপাসনা করত। হামাদান গোত্র ‘ইয়াউক’ নামক মূর্তির পূজারী ছিল এবং হিমায়ের এলাকার ‘যু কালা’ গোত্র ‘নাসর’ নামক মূর্তির পূজা করত। প্রকৃতপক্ষে এগুলি নূহের (আঃ) কাওমের সৎ লোকদের নাম ছিল। তাদের মৃত্যুর পর শাইতান ঐ যুগের লোকদের মনে এই খেয়াল জাগিয়ে তুলল যে, ঐ সৎ লোকদের নামে উপাসনালয়ে তাদের স্মারক হিসাবে কোন নিদর্শন স্থাপন করা উচিত। তাই তারা সেখানে কয়েকটি নিশান স্থাপন করে ও প্রত্যেকের নামে ওগুলোকে প্রসিদ্ধ করে।
তারা জীবিত থাকা পর্যন্ত ঐ সৎলোকদের পূজা হয়নি বটে, কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর ও ইল্ম উঠে যাওয়ার পর যে লোকগুলোর আগমন ঘটে তারা অজ্ঞতা বশতঃ ঐ জায়গাগুলোর ও ঐ নামগুলোর নিদর্শনসমূহের পূজা শুরু করে। [ফাতহুল বারী ৮/৫৩৫), ইকরিমাহ (রহঃ), যাহহাক (রহঃ), কাতাদাহ (রহঃ) এবং ইবন ইসহাকও (রহঃ) অনুরূপ বর্ণনা করেছেন]
আলী ইবন আবী তালহা (রহঃ) ইবন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, নূহের (আঃ) আমলে এভাবেই বিভিন্ন লোকের নামের মূর্তি পূজা করা হচ্ছিল। [তাবারী ২৩/৬৪০] মুহাম্মাদ ইব্ন কায়েস (রহঃ) বলেন যে, ঐ লোকগুলি ছিলেন আল্লাহর ইবাদাতকারী, দ্বীনদার, আল্লাহওয়ালা ও সৎ। তাঁরা আদম (আঃ) থেকে নূহের (আঃ) আমল পর্যন্ত ছিলেন সত্য অনুসারী, যাঁদের অনুসরণ অন্য লোকেরাও করত। যখন তারা মারা গেলেন তখন তাঁদের অনুসারীরা পরস্পর বলাবলি করলঃ যদি আমরা এদের প্রতিমূর্তি (মুরাল) তৈরী করে নিই তাহলে ইবাদাতে আমাদের ভালভাবে মন বসবে এবং এঁদের প্রতিমূর্তি দেখে আমাদের ইবাদাতের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং তারা তাই করল। অতঃপর যখন এ লোকগুলিও মারা গেল এবং তাদের বংশধরদের আগমন ঘটল তখন ইবলিস শাইতান তাদের কাছে এসে বললঃ “তোমাদের পূর্বপুরুষরাতো ঐ বুযুর্গ ব্যক্তির মূর্তি পূজা করত এবং তাদের কাছে বৃষ্টি ইত্যাদির জন্য প্রার্থনা করত। সুতরাং তোমরাও তাই কর!” তারা তখন নিয়মিতভাবে ঐ মহান ব্যক্তিদের প্রতিমূর্তিগুলোর পূজা শুরু করে দিল। [তাফসীর ইবনে কাসীরঃ বঙ্গানুবাদ সপ্তদশ খন্ড (১৭/৬০২-৬০৩)]
শিরকের ধারণা খন্ডনঃ
মহান আল্লাহ (সুবঃ) পবিত্র কুরআনে শিরকের ধারনা খণ্ডন করেছেন।
আল্লাহ বলছেন,
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ - اللَّهُ الصَّمَدُ - لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ - وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
অর্থঃ (হে মুহাম্মাদ) তুমি বলো, তিনি আল্লাহ, তিনি এক একক। তিনি কারোই মুখাপেক্ষী নন। তাঁর থেকে কেউ জন্ম নেয়নি আর তিনিও কারও থেকে জন্ম গ্রহণ করেননি। তাঁর সমতুল্য দ্বিতীয় কেউ-ই নেই। [সূরা আলা এখলাসঃ ১-৪]
يَذْرَؤُكُمْ فِيهِ ۚ لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ
অর্থঃ (সৃষ্টিলোকে) কোনো কিছুই তার সদৃশ নয়। [সূরা আশ-শুরাঃ ১১]
اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ۚ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ ۚ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ ۖ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا ۚ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ
অর্থঃ মহান আল্লাহ তায়ালা, তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনাে ইলাহ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, তিনি অনাদি এক সত্তা, ঘুম (তাে দূরের কথা, সামান্য) তন্দ্রাও তাঁকে আচ্ছন্ন করে না; আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে তাঁর সব কিছুরই একচ্ছত্র মালিকানা তাঁর; কে এমন আছে যে তাঁর দরবারে বিনা অনুমতিতে কিছু সুপারিশ পেশ করবে? তাদের বর্তমান ভবিষ্যতের সব কিছুই তিনি জানেন, তাঁর জানা বিষয়সমূহের কোনাে কিছুই (তাঁর সৃষ্টির) কারাে জ্ঞানের সীমা পরিসীমার আয়ত্তাধীন হতে পারে না, তবে কিছু জ্ঞান যদি তিনি কাউকে দান করেন (তবে তা ভিন্ন কথা), তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য আসমান যমীনের সব কিছুই পরিবেষ্টন করে আছে, এ উভয়টির হেফাযত করার কাজ কখনাে তাঁকে পরিশ্রান্ত করে না, তিনি পরাক্রমশালী ও অসীম মর্যাদাবান। [সূরা আল বাকারাঃ ২৫৫]
لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا
অর্থঃ যদি আসমান যমীনে আল্লাহ তায়াল ব্যতীত আরো অনেক মাবুদ থাকতো, তাহলে (কবেই যমীন ও আসমানের) উভয়টাই ধ্বংস হয়ে যেতো। [সূরা আল আম্বিয়াঃ ২২]
আল কুরআনের এসব আয়াত দ্বারা স্পষ্টভাবে আল্লাহ তায়ালার সত্তা ও গুনে অতুলনীয়তার বিষয়টি বোঝা যায়। সুতরাং আল্লাহ তায়ালার সাথে কাউকে অংশীদার করা নিঃসন্দেহে শিরক ও জঘন্য অপরাধ।
শিরকের কুফল ও ভয়াবহতাঃ
১. শিরককারী যালিমঃ
পৃথিবীর সকল প্রকার জুলুমের সবচেয়ে বড় জুলুম হলো শিরক। আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ
অর্থঃ “নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে সবচাইতে বড় যুলুম” [সূরা লুকমানঃ১৩]
২. শিরককারীর উপর শয়তানের আধিপত্য থাকেঃ
فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ - إِنَّهُ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانٌ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ - إِنَّمَا سُلْطَانُهُ عَلَى الَّذِينَ يَتَوَلَّوْنَهُ وَالَّذِينَ هُمْ بِهِ مُشْرِكُونَ
অর্থঃ যখন তুমি কুরআন পাঠ (করার ইচ্ছা) করবে তখন অভিশপ্ত শয়তান হতে (ওয়াসওয়াসা) আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও। যারা (আল্লাহর ওপর) ঈমান আনে এবং (যাবতীয় কার্যকলাপে) তাদের মালিকের ওপর ভরসা করে, তাদের ওপর (শয়তানের) কোনোই আধিপত্য নেই। তার সব আধিপত্য তো তাদের ওপরই (চলে) যারা তাকে বন্ধু (ও অভিবাভক) হিসেবে গ্রহণ করেছে, (উপরন্তু) যারা তাঁর (আল্লাহর) সাথে শরীক করেছে। [সূরা আনা নাহলঃ ৯৮-১০০]
অর্থাৎ, শিরককারীর উপর শয়তানের আধিপত্য থাকে। যার উপর যার আধিপত্য থাকে সে তো অন্যদেরকে তার দিকেই পরিচালিত করবে এটাই স্বাভাবিক।
إِنْ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا إِنَاثًا وَإِنْ يَدْعُونَ إِلَّا شَيْطَانًا مَرِيدًا
অর্থঃ আল্লাহকে ছাড়া এরা (আর কাকে ডাকে) - ডাকে (নিকৃষ্ট) দেবীকে কিংবা কোনো বিদ্রোহী শয়তানকে! [সূরা আন নিসাঃ ১১৭]
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থঃ হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছো (তোমরা জেনে রেখো), মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর হচ্ছে ঘৃণিত শয়তানের কাজ। অতএব তোমরা তা (সম্পূর্ণরুপে) বর্জন করো। আশা করা যায় তোমরা মুক্তি পেয়ে যাবে। [সূরা আল মায়িদাঃ৯০]
৩. শিরককারীর আমল নিষ্ফল হয়ে যায়ঃ
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
(হে নবী) তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের (নবীদের) প্রতি অবশ্যই ওহী (প্রত্যাদেশ) করা হয়েছে যে, যদি তুমি আল্লাহ তায়ালার সাথে (অন্যদের) শরীক করো তাহলে অবশ্যই তোমার (সব) আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্তদের দলে শামিল হবে। [সূরা আয-যুমারঃ ৬৫]
وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
তারা যদি শিরক করত, তাহলে তাদের যাবতীয় কর্ম অবশ্যই নিষ্ফল হয়ে যেতো। [সূরা আল আন’আমঃ ৮৮]
৪. শিরককারীরা ক্ষমার অযোগ্যঃ
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ ۚ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَىٰ إِثْمًا عَظِيمًا
অর্থঃ নিসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা কখনো (সে গুনাহ) মাফ করবেন না (যেখানে) তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা হয়, এছাড়া অন্য সব গুনাহ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার বানালো সে সত্যিই (আল্লাহর ওপর) মিথ্যা আরোপ করলো এবং একটা মহাপাপে (নিজেকে) জড়ালো! [সূরা আন নিসাঃ ৪৮]
৫. শিরককারীরা পথভ্রষ্টঃ
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ ۚ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا
অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে অংশী (শিরক) করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। আর যে কেউ আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন (শিরক) করে, সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়। [সূরা আন নিসাঃ ১১৬]
৬. শিরককারী পথভ্রষ্টকারীঃ
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَٰذَا الْبَلَدَ آمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ - رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ
অর্থঃ (স্মরণ করো), যখন ইবরাহীম (আল্লাহর কাছে) দোয়া করলো, হে আমার মালিক, এ (মক্কা) শহরকে (শান্তি ও) নিরাপত্তার শহরে পরিণত করো এবং আমাকে এবং ও আমার সন্তান সন্ততিদের মূর্তিপূজা করা থেকে দূরে রেখো। হে আমার মালিক, নিসন্দেহে এ মূর্তিগুলো বহু মানুষকেই বিভ্রান্ত করেছে। [সূরা ইবরাহীমঃ ৩৫-৩৬]
৭. শিরককারীদের জন্য জান্নাত হারামঃ
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ ۖ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ
অর্থঃ যে কেউ আল্লাহর অংশী (শরীক) করবে, নিশ্চয় আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করবেন ও জাহান্নাম তার বাসস্থান হবে এবং যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। [সূরা আল-মায়েদাঃ ৭২]
৮. শিরককারী সৃষ্টির নিকৃষ্টঃ
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِينَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ أُولَٰئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ
অর্থঃ নিশ্চয়ই যারা কিতাবীদের মধ্য থেকে কুফরী করে এবং মুশরিকরা অনন্তকাল জাহান্নামের অগ্নিতে থাকবে। এরাই সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্টতম। [সূরা আল বাইয়্যেনাহঃ ৬]
৯. শিরককারীরা অপবিত্রঃ
فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِ
অর্থঃ অতএব তোমরা মূর্তি পূজার অপবিত্রতা থেকে বেঁচে থেকো এবং বেঁচে থেকো মিথ্যা কথা থেকে। [সূরা আল হাজ্জ্বঃ ৩০]
১০. শিরককারী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শাফা’আত থেকে বঞ্চিত হবেঃ
আওফ ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার প্রভুর নিকট থেকে একজন আগমনকারী এসেছেন এবং আল্লাহ তায়ালা আমাকে দু’টো জিনিষের একটা কবুল করার এখতিয়ার দিয়েছেন। আমার উম্মতের অর্ধেকের জান্নাত দান করা কিংবা আমাকে শাফা’আতের সুযোগ দেয়া, আমি শাফা’আতের সুযোগ গ্রহন করেছি এবং যে লোক আল্লাহ্র সাথে কোনরূপ শিরক না করে মৃত্যুবরণ করেছে তার জন্য আমার সুপারিশ হবে। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
অন্তরে অপছন্দ নিয়েও মূর্তিপূজার (শিরকের) কাছে যাওয়া যাবে নাঃ
নিম্নের আয়াতটি নাযিলের প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে হযরত সাঈদ বিন যুবায়ের থেকে বর্ণনা পাওয়া যায় একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাবা তাওয়াফ এর সময় হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করেছিলেন তখন কুরায়েশগণ তাকে বাঁধা দিয়ে বলে আমাদের দেবতার নিকটে না গেলে তোমাকে তা স্পর্শ করতে দেব না। তখন রাসূল (সাঃ) মনে মনে ভাবছিলেন হাজরে আসওয়াদ স্পর্শের বিনিময়ে মূর্তির কাছে গেলে কি পাপ হবে? আমি যে মূর্তি অপছন্দ করি আল্লাহ তা ভালোভাবেই জানেন।
আল্লাহ রাসূল (সাঃ) এর এমন চিন্তা অপছন্দ করেন এবং তখন এই আয়াত নাযিল হয়। [তাফসীরে কুরতুবি]
إِذًا لَأَذَقْنَاكَ ضِعْفَ الْحَيَاةِ وَضِعْفَ الْمَمَاتِ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا - وَإِنْ كَادُوا لَيَسْتَفِزُّونَكَ مِنَ الْأَرْضِ لِيُخْرِجُوكَ مِنْهَا ۖ وَإِذًا لَا يَلْبَثُونَ خِلَافَكَ إِلَّا قَلِيلًا
অর্থঃ যদি আমি তোমাকে অবিচল না রাখতাম তাহলে তুমি অবশ্যই তাদের দিকে সামান্য কিছুটা (হলেও) ঝুঁকে পড়তে। (আর এমনটি যদি হতো) তাহলে আমি অবশ্যই তোমাকে ইহজীবনে ও পরজীবনে দ্বিগুণ শাস্তি আস্বাদন করাতাম, অতপর তুমি আমার বিরুদ্ধে তোমার জন্য কোনই সাহায্যকারী পেতে না। [সূরা বনি ইসরাইলঃ ৭৪-৭৫]
আমি কি আল্লাহর আদেশ নিষেদের প্রতি অবজ্ঞার বশবর্তী হয়ে নিজের অজ্ঞাতেই শিরক করে ফেলছিঃ
১. আল্লাহর বক্তব্যঃ
আমাদের সমাজের প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী অনেকেই জীবন ব্যবস্থা ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানের অভাবে মূর্খতার বশবর্তী হয়ে কবর পূজা (কবর সাজানো, কবরে ফুল দেওয়া...ইত্যাদি), মাজার পূজা, পীর পূজা (পীরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উছিলা মনে করা, পীরকে দোয়া কবুলের মাধ্যম ও কিমায়তের মাঠে শাফায়াতকারী মনে করা, পীরের নামে জবাই করা, রোজী-রোজগার বৃদ্ধি, সন্তান প্রাপ্তির জন্য পীরের নিকট দোয়া চাওয়া.....ইত্যাদি), স্মৃতিসৌধ পূজা (কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা, স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়া....ইত্যাদি), শিরককারীকে তার উৎসবে শুভেচ্ছা জানানো, ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়া, তাকে সঠিক মনে করা বা বিকল্প মনে করা......ইত্যাদির মাধ্যমে শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ে। যদিও এরা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, আল্লাহর ইবাদত করে কিন্তু সাথে সাথে উক্ত প্রকারের শিরকগুলোও করে।
মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ
অর্থঃ অধিকাংশ মানুষই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে। [সূরা ইউসুফঃ ১০৬]
২. আল্লাহর রাসূলের বক্তব্যঃ
মুশরিকদেরকে পূজার উৎসবে শুভেচ্ছা জানানো বা পূজার উৎসবে যাওয়া হচ্ছে তাদের সাথে সাদৃশ্যতা। কেননা তারা একে অপরকে শিরক-কুফরের অনুসারী হওয়ার কারণেই শুভেচ্ছা জানায়, আনন্দ করে। এছাড়া, অপর ধর্মের উৎসবের স্বীকৃতি দেওয়া মানে–তার সেই শিরক বা কুফরের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা অথবা কমসে কম তার সেই শিরক বা কুফরের উপর থাকাতে খুশী প্রকাশ করা। একজন মুসলিম কখনই শিরক বা কুফরের ঘটনায় সন্তুষ্ট হতে পারে না।
حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا أَبُو النَّضْرِ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ ثَابِتٍ، حَدَّثَنَا حَسَّانُ بْنُ عَطِيَّةَ، عَنْ أَبِي مُنِيبٍ الْجُرَشِيِّ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ "
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
যে কেউ কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্যতা ধারণ করলো, সে তাদের-ই অন্তর্ভুক্ত। [সূনানে আবু দাউদ, হাদিস নং- ৪০৩১]
৩. সাহাবীদের বক্তব্যঃ
উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেছেনঃ
"তোমরা মুশরিকদের উপাসনালয়ে তাদের উৎসবের দিনগুলোতে প্রবেশ করো না। কারণ সেই সময় তাদের উপর আল্লাহর গযব নাযিল হতে থাকে।" [তথ্যসূত্রঃ ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিঃ) তাঁর আহকামুল জিম্মাহ ১/৭২৩-৭২৪ এ সহিহ সনদে বায়হাক্বী থেকে এই রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন]
৪. ক্লাসিকাল আলেমগণ বা মুসলিম মনিষীদের বক্তব্যঃ
কাফিরদের যে কোন উৎসবে অংশগ্রহণ করা মুসলমানদের জন্য হারাম। ইমাম ইবনুল কায়্যিম রাহিমাহুল্লাহ এ ব্যাপারে বলেন,
"কাফেরদের তাদের উৎসবে সম্ভাষণ জানানো আলিমদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে নিষিদ্ধ। এটা কাউকে মদ খাওয়া বা খুন করা বা ব্যভিচার করায় সাধুবাদ জানানোর মতো। যাদের নিজের দ্বীনের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই, তারাই কেবল এ ধরনের ভুল করতে পারে। যে অন্যকে আল্লাহ্-র অবাধ্যতা, বিদ’আত অথবা কুফরীতে জড়ানোর কারণে শুভেচ্ছা জানাবে সে আল্লাহ্-র ক্রোধ ও শাস্তির সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করে দিল।"
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন,
"কাফেরদের উৎসবের নিদর্শন এমন কিছুতে অংশ নেয়া মুসলমানদের জন্য জায়েয নয়।" [সূত্রঃ মাজমু আল ফাতাওয়া- ২৯/১৯৩]
ঈমাম আয যাহাবী (রহঃ) এর মতে,
"মুসলিমগন কাফিরদের কোন উৎসবে অংশ নিবে না, যা কিনা তাদের ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ঠিক যেমন করে কোন মুসলিম অন্য ধর্মের অনুশাসন এবং উপাসনার লক্ষ্যবস্তু গুলোকে গ্রহন করতে পারে না।" [সূত্রঃ তাশাব্বুহুল খাসিস বি আহলিল খামিস- ৪/১৯৩]
অন্য ধর্মের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থানঃ
وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ
তারা (মুশরিকরা) আল্লাহ তায়ালার বদলে যাদের ডাকে, তাদের তোমরা কখনো গালি-গালাজ করো না। কেননা, শত্রুতার বশবর্তী হয়ে, অজ্ঞানতাবশতঃ আল্লাহ তায়ালাকেও তারা গালি দেবে। [সূরা আল আন'আমঃ ১০৮]
শির্কের ভয়ে দোয়াঃ
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ وَأَنَا أَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لاَ أَعْلَمُ
অর্থঃ “হে আল্লাহ! আমি জ্ঞাতসারে আপনার সাথে শির্ক করা থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাই এবং অজ্ঞতাসারে (শির্ক) হয়ে গেলে তার জন্য ক্ষমা চাই।” [আহমাদ ৪/৪০৩, নং ১৯৬০৬; ইমাম বুখারীর আল-আদাবুল মুফরাদ, নং ৭১৬]
হে আমাদের প্রভু, আমাদের এমন জ্ঞান দান কর যাতে আমরা শিরকের সেই সকল উৎসগুলোকে চিনতে পারি যারা জীবন ব্যবস্থায় (রাষ্ট্র ক্ষমতায়, বিচার ব্যবস্থায়, শিক্ষা ব্যবস্থায়, সমাজ ব্যবস্থায়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়.....ইত্যাদি) ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ব্যবস্থার বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজেদের ইচ্ছাকে তোমার আদেশের উপর প্রাধান্য দান করে এবং নিজেদেরকে গুনাবলীতে তোমার অংশীদার সাব্যস্ত করার মাধ্যমে অধিনস্তদেরকে তাদের এই অন্যায় ইচ্ছার আনুগত্য তথা শিরক করতে আহবান করে।
হে আমাদের মালিক আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে ও অজ্ঞাতসারে যে শিরকগুলো করে ফেলেছি তা থেকে তুমি আমাদের ক্ষমা করো। আমাদের অন্তরসমূহকে শিরকের ও শিরককারীদের অন্তঃসারশূন্য এই চাকচিক্য থেকে বিমুখ করো। নিশ্চয়ই শিরককারীরা, শিরকে সাহায্যকারীরা, অংশগ্রহনকারীরা ও শুভেচ্ছা বিনিময় কারীরা তোমার নিকৃষ্ট সৃষ্টি এবং যালেম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর হে অন্তর সমূহের পরিবর্তনকারী! তোমার দ্বীনের উপর আমাদের অন্তরকে অবিচল রাখ।
সম্পাদনাঃ মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম।
No comments:
Post a Comment