Tuesday, November 27, 2018

অন্যায় বিচার

একবার এক শীর্ণকায় হাড্ডিসার বৃদ্ধ এলো চিকিৎসকের কাছে এবং বললো, আমার অবস্থা খুবই খারাপ, চোখে-মুখে শুধু সর্ষেফুল দেখি। আমার একটা ব্যবস্থা করুন ডাক্তার সাব।

চিকিৎসক তার শিরা ও জিহবা পরীক্ষা করে জিজ্ঞেস করলেন, গতরাতে কি খেয়েছিলে?

জবাব দিলোঃ কিছু না।

চিকিৎসকঃ আজ কি নাশতা করে এসেছো

বৃদ্ধঃ কিছুই না। 

চিকিৎসক দেখলেন যে, এ ব্যক্তি বয়োবৃদ্ধ এবং কংকালসার হওয়া ছাড়াও চরম ক্ষুধার্ত। খাদ্যাভাবে তার প্রাণ এই বুঝি বের হয়ে গেলো। চিকিৎসকের বুঝতে বাকী রইলো না যে, এই বৃদ্ধ বেচারার জীবন প্রায় শেষ প্রান্তে। যে কোন সময় সে ধরাশায়ী হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। চিকিৎসকের খুবই মায়া হলো এই বৃদ্ধের জন্য। অসহায় লোকটির করুণ দশা চিকিৎসকের হৃদয়কেও জ্বালিয়ে দিলো। তাই চিকিৎসক বৃদ্ধকে সত্য কথা বলতে পারছিলেন না। সে যাতে কষ্ট না পায় সে দিকে খেয়াল রেখে বললেন, তোমার যে রোগ এ থেকে নিরাময় লাভের কোন সহজ পথ নেই। এর জন্য তেমন ওষুধও দেখছিনা। তবে তোমার অবস্থা ভালো হওয়ার জন্যে তোমাকে তোমার মন যা চায় তাই করতে হবে। মন যত চায় খাও, যা করতে চায় তাই করো। এটাই তোমার ভাল হওয়ার পথ। এর জন্য অন্য কোন পথ নেই। মৃত্যুপথযাত্রী দিশেহারা বৃদ্ধ বললোঃ আপনি ঠিকই বলেছেন ডাক্তার সাব; তবে আমার মন যা চায় তাতো খেতে পারিনা, অর্থাৎ নেই যে খাবো।

চিকিৎসক তার কথা শুনে আরো মর্মাহত হলেন। তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে তাকে যেহেতু কষ্ট দিতে চাননি সেহেতু বললেনঃ আমার কথাও তাই, যা নেই তা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাবে না। যা পারো তাই করো। মোটকথা তোমার মনটাকে যত পারো খুশীতে রাখো। যা আছে তাই মন খুশী করে খাও, যা করতে মনটা ইচ্ছে করে তাই করো। সুন্দর সুন্দর কল্পনা করো তাতেও মন আনন্দ পাবে।

নিরূপায় বৃদ্ধঃ মাশাল্লাহ! আপনি খুবই ভাল ডাক্তার। আল্লাহ আপনার মঙ্গল দিন। আমার মনের কথাই বলেছেন। আমি জানি যে, কখনো আমার মনের খাহেশ মিটেনি, অপূর্ণ রয়ে গেছে। তাই সুন্দর সুন্দর কল্পনা করাই ভালো। কল্পনা যত ইচ্ছে করা যায়।

চিকিৎসকঃ ঠিকই বাবা, তুমি ঠিকই বুঝেছো। আল্লাহ তোমাকে শেফা দিক। এখন যাও মন যেখানে চায় সেখানে ঘুরে বেড়াও। আশাকরি তোমার দীলের আরজু মিটবে।

কঙ্কালসার বৃদ্ধঃ মনটা চাচ্ছে সবুজ বনবাদাড়ে যাই, নহরের পাশে গিয়ে বসি। পানির ছলছল চলার দৃশ্য দেখি।
                                                      
চিকিৎসকঃ খুব ভালো কথা, যাও সেখানেই যাও। আল্লাহ হাফেয।

চিকিৎসকের কথায় বৃদ্ধের বেশ ভালই লাগলো। মনটা খুশীতে নেচে উঠলো। কল্পনার নীল আকাশে মনের পাখা মেলে দিয়ে উড়তে লাগলো। সে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলো একটা নহরের কাছে। কলকল রবে পানি বয়ে চলেছে। এক নিবিষ্ট মনে পানির স্রোত ও গতিবিধি লক্ষ্য করতে করতে হটাৎ তার নজর পড়লো নহরের পাড়ে বসা একজন দরবেশের উপর। দরবেশ একান্ত মনোযোগের সাথে মাথা নূয়ে পানির দিকে তাকিয়ে ছিলো। কোন দিকেই তার খেয়াল নেই। বৃদ্ধের আগমন তিনি টেরই পেলেন না। এদিকে বৃদ্ধ দরবেশকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলোএক সময় তার দৃষ্টি পড়লো গিয়ে দরবেশের প্রশস্ত ঘাড়ের উপর। বেশ পুরো, মোটা ও নরম গোশতওয়ালা ঘাড়। এ রকম মোটাসোটা ঘাড়গর্দান দেখে বুড়োর হাত ইসপিস করতে লাগলো জোরসে কষে একটি থাপ্পড় দেয়ার জন্য। দরবেশের ঘাড়ে থাপ্পড় বসালে এর যে কি আওয়াজ হবে সে কল্পনা পেয়ে বসলো বুড়োকে। তবে তার জানা ছিলো যে, বেহুদা কাউকে চড়-থাপ্পড় দেয়া যায়না। তার মনে পড়লো চিকিৎসকের কথা। চিকিৎসক বলেছিলেন তার রোগের একমাত্র ওষুধই হলো মনে যা আসে তাই করা। মনের খুশীই তার রোগের পথ্য। ব্যস, আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। হাতের আস্তিন গুটিয়ে হাত তুললো আসমানের দিকে। তারপর শরীরের সমস্ত জোর খাটিয়ে দরবেশের ঘাড়ে মারলো কষে এক থাপ্পড়। তড়াক্ করে বিরাট একটা আওয়াজ হলো। সাথে সাথেই খিলখিল করে সে হাসতে শুরু করলো।

দরবেশতো সম্পূর্ণ বেখেয়াল অবস্থায় এ থাপ্পড় খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন পানিতে। কোন মতে নিজেকে সামলে নিলেন এবং ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে গেলেন। থাপ্পড় দাতাকে ধরার জন্য পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলেন এক ক্ষীণকায় হাড্ডিসার বৃদ্ধ, মরণের পথযাত্রী। দরবেশ তাকে পাল্টা থাপ্পড় লাগানোর কথা ভাবতেই বুঝতে পারলেন যে, তাকে থাপ্পড় লাগালে হয়তো মারাই পড়বে। তাই শক্ত করে তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেনঃ বদবখত কোথাকার! তোর কয়টা মাথা আছে যে, অনর্থক আমাকে মারলি? তোর গায়েতো এক ফোটা শক্তিও নেই যে, তোর উপর হাত লাগাবো। তোর জীবনতো এমনিতেই নাকের ডগায় এসে পৌঁছেছে। কেনো এ কাজ করলি? আবার নির্লজ্জের মতো হাসছিস কেনো? পাগল হয়েছিস নাকি

বৃদ্ধঃ জানিনে কেনো এ কাজ করেছি। শুধু মনটা চাইলো আর ডাক্তারও বলেছিলো মনে যা আসবে তাই যেন করি। কিন্তু হাসছি এ জন্যে যে, চমৎকার আওয়াজ হয়েছে। বুঝতে পারলাম না এ আওয়াজ আমার হাতের না তোমার ঘাড়ের?

দরবেশঃ বুঝতে পারছিস না? আয় তোকে বুঝাই। একথা বলেই বৃদ্ধকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চললেন কাজীর বাড়ি এবং কাজীকে বিস্তারিত জানিয়ে বললেনঃ এই হলো আমার নালিশ আর এই হলো দুষ্ট বুড়ো। এবার কি করবেন করুন। যদি বলুন কেসাসকরবো-তাই করবো। নতুবা যা বলুন তাই হবে। আমি তাকে কেসাস (সমান পাল্টা আঘাত) করতে চেয়েছিলাম কিন্তু দেখলাম যে এতে তার মউত হতে পারে। যাহোক, এটা বড়ই অন্যায় যে, শহরে কাজী থাকবে অথচ একজন আরেকজনকে চড় থাপ্পড় লাগাবে।

কাজী বৃদ্ধকে তাকিয়ে দেখলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, তার উপর কেসাস করা অসম্ভব। তাই বাধ্য হয়ে দরবেশকে নসিহত করে বললেন, বন্ধু আমার! দেখতেই পাচ্ছেন লোকটিকে মারার মতো অবস্থা নেই। হয়তোবা সে ওতে মরেই যাবে। তখন তাকে হত্যার দায় আপনাকেই বহন করতে হবে। সুস্থ-সবল লোককেই মারা যায়। শাস্তি দেয়া যায়। একে তো কিছুই করা যাবেনা। সে এখনো যে জীবিত আছে তাই অনেক জোর। আসুন ওকে মাফ করে দিন। ক্ষমা করার ভেতরও একটা আনন্দ আছে। প্রতিশোধে কোন আনন্দ ও তৃপ্তি নেই। এ রকম বিষয়েই তো ক্ষমা করতে হয়।

দরবেশঃ কাকে ক্ষমা করবো? কিসের ক্ষমা? মানুষ যখন জেনে যাবে যে, এ ধরনের অন্যায় কাজের কোন বিচার হয়নি তখন শহরে অন্যায়-অবিচার ছড়িয়ে পড়বে। কেউ কাউকে মানবে না। কাজীকেও পাত্তা দেবে না। অরাজকতা ছড়িয়ে যাবে। এটা এক অন্যায় হুকুম। সব খারাফ কাজেরই শাস্তি হওয়া উচিত। আমি তাকে ক্ষমা করবো না। তাকে শাস্তি দিতেই হবে।

কাজীঃ যা বললাম তাই। এ বৃদ্ধ অসুস্থ একেবারে হাড্ডিসার ও মৃত্যু মুখে পতিত। তার উপর থেকে নালিশ উঠিয়ে নিন।

দরবেশঃ আমি কখনো রাজি হবো না। কাজী বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ তোমার সাথে কত টাকা আছে?

বৃদ্ধঃ কিচ্ছু না।

কাজীঃ সকালে কি খেয়েছো?

বৃদ্ধঃ কিছুই খাইনি।

এবার কাজী দরবেশের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখতেই পাচ্ছেন লোকটি অভুক্ত। আপনাকে না হয় একটি থাপ্পড় মেরেছেই। আপনার তো কিছু কমে যায়নি? ছেড়ে দিন তাকে। আচ্ছা, আপনার কাছে কত টাকা আছে?

দরবেশঃ ছয় টাকা।

কাজীঃ ঠিক আছে, এ ছয় টাকা অর্ধেক করে তিন টাকা আপনি নিন আর তিন টাকা তাকে দিন। বেচারা রুটি কিনে খাবে। আল্লাহ আপনাকে পুরস্কার দেবেন।

দরবেশ প্রতিবাদ করে উঠলেন এবং বললেন, আজব বিচার তো! মারও খেলাম আবার টাকাও দেবো? এটা অন্যায় বিচার, এটা জুলুম, এটা জবরদস্তি। এ আবার কি ধরনের রায় দিলেন। একটা থাপ্পড়ের দাম কতো শুনি?

এরপর শুরু হলো কাজী আর দরবেশের মধ্যে তর্ক বিতর্ক ও বাকবিতণ্ডা। এদিকে দুর্বল জয়ীফ বৃদ্ধটি ভাবতে লাগলো, তাহলে থাপ্পড় দিলে টাকা পাওয়া যায়! আর এক থাপ্পড়ের দাম তিন টাকা। এসময় তার চোখ পড়লো কাজীর ঘাড়ের উপর এবং দেখলো যে, কাজীর ঘাড় দরবেশের চেয়েও অনেক মোটা আর গোশতে থল্-থল্। থাপ্পড় বেশ লাগবে। আবার রঙ্গীন কল্পনা তাকে পেয়ে বসলো। কাজী আর দরবেশ কথা কাটাকাটিতে ব্যাস্ত। বৃদ্ধের হাত উঠে গেলো শুন্যে। সবাইকে চমকে দিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে মেরে বসলো কাজীর ঘাড়ে। আর বললো, আরো তিন টাকা দিন, তাহলে ছয় টাকা দিয়ে কিছু একটা খাওয়া যাবে।

কাজীর অবস্থা কে দেখে। লজ্জা ও বিরক্তিতে মাথা তার নীচু হয়ে এলো। কিন্তু দরবেশ উল্লসিত হয়ে উঠলেন এবং পকেট থেকে ছয় টাকা বের করে এনে বললেন, এই নিন তিন টাকা আমার থাপ্পড়ের আর এই তিন টাকা আপনি যেটা খেলেন তার বাবদ।

কাজীঃ এটা কি ধরনের কথা? আমাকে মারার জন্য তুমি টাকা দিচ্ছো?

দরবেশঃ জ্বী হ্যাঁ, চড় থাপ্পড় যদি ভাল মূল্যবান জিনিস হয়ে থাকে তাহলে তা সবার জন্যই মূল্যবান। আফসোস যে, আর কোন টাকা নেই হাতে। দ্বিতীয় থাপ্পড়ের দাম যে একশো টাকারও বেশী। কেননা, অন্যায় বিচারের শাস্তি এটি। আফসোস আর টাকা নেই, নতুবা পূরো দামই দিয়ে দিতাম। তোমার মতো কাজীর জন্য উপর্যুক্ত দামই হতো

লেখকঃ মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী” কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।

No comments:

Post a Comment