একবার এক শহরে চারজন ভিক্ষুক একসাথে মিলিত হলো। এরা সবাই ছিলো ঐ শহরে নতুন। এদের একজন ইরানী,
একজন তুর্কী,
একজন আরব এবং আরেকজন গ্রীক দেশীয়। কেউ কারো ভাষা না জানলেও আকারে-ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় করে পরস্পর বন্ধু হলো। তাদের মধ্যে বেশ ভাব জমে ওঠলো। এক সাথে চলাফেরা ও ওঠাবসা শুরু হলো। যা কিছু দেখতো তা-ই নিজ নিজ ভাষায় একে অপরকে শেখাতো। যেমন ইরানী ভিক্ষুক পানি দেখিয়ে তার বন্ধুদের বলতো,
ইরানে একে বলে
“আব”। আরব বলতো,
আমরা একে বলি
“মা”। তুর্কী ভিক্ষুক জানাতো তাদের দেশে একে বলে
“সূ”। আর এ ভাবেই তারা পরস্পর ভাবের ও ভাষার আদান-প্রদান করে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। গরমকালে এই ভিক্ষুকদের বন্ধুত্ব বেশ জমে ওঠলো। একে অপরকে সাহায্য-সহায়তা করে খুব ঘনিষ্ঠ হলো। তারা প্রতিদিন দুপুরে এক জায়গা এসে জমা হতো এবং একসাথে খাওয়া-দাওয়া করতো। খাওয়া-দাওয়ার পর গাছের ছায়ায় কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে চলে যেতো যার যার পথে ভিক্ষার থলে নিয়ে।
একদিনের কথা। দুপুরে সময়মতো চারজন নির্ধারিত স্থানে এসে জমা হলো। যার যার খাবারের পুটলী খুলে রাখলো সামনে। সবার হাতেই এক টুকরো করে রুটি। আর কিছুই নেই। ইরানী বললো,
“আমি বাবা এরকম শুকনো রুটি খেতে পারিনে। গলা দিয়ে যেতেই চায় না। আমার কাছে টাকাও নেই যে আঙ্গুর বা অন্যকিছু কিনে এনে রুটির সাথে মিশিয়ে খাই। যদি কারো কাছে টাকা পয়সা থাকে তাহলে ভাই কিছু একটা নিয়ে এসো। আগামীকাল না হয় আমি তোমাদের পুষিয়ে দেবো।”
ইরানী ভিক্ষুকের কথা শুনে বাকী তিন ভিক্ষুক বলে ওঠলো,
“আমাদের হাতে ভাই কোন টাকা-পয়সাই নেই। এই শহরে মানুষের হাতে টাকা খুব কম। এদের আছে,
শুধু রুটি আর পানি,
ব্যস। কেউই ভিক্ষুকদের অন্যকিছু দিতে চায় না।”
কি আর করা যাবে। সবাই শুকনো রুটিই চিবানো শুরু করলো। ঠিক ও সময় ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলো এক পথিক। ভিক্ষুকদের খাওয়া-দাওয়া দেখে তার মনে দয়া এলো। পকেটে হাত দিয়ে কয়টি টাকা গুঁজে দিলো একজনের হাতে। ভিক্ষুকেরা টাকা পেয়ে খুব খুশী হয়ে হাত ওঠিয়ে দোয়া করলো। এবার ইরানী বললো,
“এই তো টাকা এসে গেলো,
এ টাকা আমাদের চারজনেরই। চলো এ টাকা দিয়ে আঙ্গুর কিনে আনি। আঙ্গুর দিয়ে রুটি খাওয়া খুব মজা।”
কিন্তু অন্য তিনজন বেঁকে বসলো। বললো,
“আমরা আঙ্গুর খাব না। আঙ্গুর আবার খাওয়ার জিনিষ হলো নাকি।”
ওরা আসলে আঙ্গুর বলতে কি বুঝায় তা জানতো না। আরব ভিক্ষুকটি বলে ওঠলো,
“ইরানী খাওয়া ভাই মোটেও স্বাদের নয়। আঙ্গুর বাদ দাও। চলো
“ইনাব” খাই। অনেক স্বাদের। আমি তো কতোকাল ইনাব খাই না। ইনাব খাওয়ার জন্য আমার মন পড়ে আছে।”
তুর্কী ভিক্ষুক প্রতিবাদ করে বললো,
“আমাদের এই আরব বন্ধু কেবল দেশী খানাদানার কথাই ভাবে। আমি কিন্তু ভাই ইনাব পছন্দ করি না। আমার মত চাইলে আমি বলবো,
এ অর্থ দিয়ে
“ওযোম” কেনাই ভালো।
“ওযোমের” দামও সস্তা। গরমের দিনে এ ফল সবাই পছন্দ করে,
বেশ মজাদার ও শক্তিদায়ক।”
গ্রীক ভিক্ষুক সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে ওঠলো। বললো,
“না বাবা,
খানা-দানা আমার একেবারেই ভালো লাগে না। আমাদের হাতে যখন টাকা আছে চলো কিছু
“ইস্তাফিল” কিনে আনি। দয়া করে আমার কথা রাখো। ইস্তাফিল সব ফলের রাজা। ইস!
কতো দিন যে ইস্তাফিল খাই না।”
ইরানী বলে ওঠলো,
“এ আবার কেমন কথা!
একদিনে কি সবার মন রাখা যায়। আমি বাবা তোমাদের সবার চেয়ে বড়,
বুড়ো মানুষ। তা ছাড়া আঙ্গুরতো শুধু ইরানী ফলই নয়। সবখানেই আঙ্গুর জন্মায়। আঙ্গুর কে না খায়?
আজ বাবারা আমার কথা রাখো।”
আরব বললো,
“তুমি বড় হয়েছো তো কি হয়েছে?
রেখে দাও তোমার মুরুব্বীয়ানা। বয়েসে কি আসে যায়?
উটওতো অনেক বড়। তাই বলে কি উটের কথাও রাখতে হবে?
তাছাড়া তোমরাতো জানো,
আমি তোমাদের মধ্যে জ্ঞানী ব্যক্তি,
আরবী কিছুটা পড়তে পারি। জানোতো আরবরা কারো কাছে মাথা নত করে না।”
এবার তুর্কী বেচারার ধৈর্য ভেঙ্গে গেলো। বললো,
“দয়া করে এখানে আরব-আজমের ঝগড়া বাধাবে না। যদি ঝগড়া করার প্রশ্নই ওঠে,
তাহলে জেনে রাখো তোমাদের মতো দু’চারজনকে কুপোকাৎ করার মতো বল আমার গায়ে রয়েছে। আমি তুর্কী। কাউকে সমীহ করা তুর্কীদের কাজ নয়। আমার এক কথা,
আজ ওযোম খাবো। তর্কই যখন বেধেছে তাহলে জেনে রেখো ওযোম ছাড়া অন্য কিছুই খাব না।”
এবার গ্রীক ভিক্ষুক মুখ খুললো,
“আহা, কেনো আমরা রাগারাগি করছি। চলো এ টাকা ভাগাভাগি করে চারজনে নিজেদের ভাগ দিয়ে কিছু আঙ্গুর,
কিছু ইনাব,
কিছু ওযোম এবং আমার জন্য কিছু ইস্তাফিল কিনে আনি এবং একত্রে বসে যার যার পছন্দ মতো খেয়ে ফেলি। এতে ঝগড়া বিবাদের কি আছে ভাই?”
আরব তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,
“এখানেও ফিরিঙ্গিবাজী করতে চাও,
তাই না?
ভাগ করো আর শাসন করো—এ নীতি তোমাদের ইউরোপবাসীর এক দুর্নীতি। না তা চলবে না। আমরা সবে মাত্র একে অপরের বন্ধু হয়েছি। এখানে ঐ ফিরিঙ্গিপনা বাদ দাও। সবাই যখন এক সাথে আছি তখন মিলেমিশেই এক হয়ে থাকবো। যার যার ইচ্ছে মতো গেলে মত বিরোধ দেখা দেবেই। আমার মতে চলো আজ ইনাব খাই,
কাল না হয় অন্য কিছু খাওয়া যাবে।”
আরবের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলো ইরানী ভিক্ষুক। সে বলে উঠলো,
“কি জ্বালায় পড়লাম। একেক দিন যখন একেক রকমের ফল খেতে রাজী হয়েছো তাহলে আজ আঙ্গুর খেতে অসুবিধা কোথায় শুনি?”
তুর্কীঃ “না
প্রথম দিন ওযোমই উত্তম। ওসব আঙ্গুর-ফাঙ্গুর বাদ দাও।”
গ্রীকঃ “আমি কিন্তু ওসব মোটেও খাব না। আমার ইস্তাফিল চাইই চাই।”
এবার ইরানী বললো,
“তোমরা বিশ্বাস করো আমার কথা,
আঙ্গুর খুবই মজা। আজ না হয় খেয়ে পরিক্ষা করো। মজা না লাগলে আমার দোষ।”
আরব চেঁচিয়ে ওঠে বললো,
“অসম্ভব। আঙ্গুর আমি খাবো না। যত্তোসব বাজে।”
এবার তুর্কী বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল এবং বললো,
“ওযোম ছাড়া অন্য কিছু কিনবে তা হবে না। আমি তা হতে মোটেও দেবো না।”
তুর্কীর কথায় গ্রীক বেচারার মেজাজ গেলো বিগড়ে। সেও দাঁড়িয়ে গেলো এবং কর্কশ কন্ঠে চেঁচিয়ে ওঠলো,
“ফাজলামী শুরু করছো,
তাই না?
নিজের শরীরটাকেই শুধু দেখছো। তাহলে আমি কি শুধু পানি আর বায়ু খেয়ে বড় হয়েছি?
দাঁত ভেঙ্গে ফেলবো থাপ্পড় দিয়ে। ফিরিঙ্গীরা এতো সহজ নয় যে ছেড়ে দেবে।”
ব্যস, শুরু হয়ে গেলো তর্ক-বিতর্ক, শোরগোল ও চেঁচামেচি।
সে সময় ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ। ভিক্ষুকদের ঝগড়াঝাটি শুনে এগিয়ে এলেন তাদের কাছে এবং বললেন,
“ব্যাপার কি হে,
তোমরা এখানে ঝগড়া বাধাচ্ছো কেনো?
শুনি কি হয়েছে।”
চারজনই তাকে ঘটনা খুলে বললো,
“আমরা চারজন পরস্পর বন্ধু। এক সাথে ওঠাবসা আছে আমাদের। আজ সামান্য কিছু টাকা সাহায্য পাওয়ায় রুটির সাথে কিছু ফলও খেতে চাচ্ছি। কিন্তু একজন চায় আঙ্গুর,
একজন চায় ইনাব,
একজন চায় ওযোম,
আরেকজন চায় ইস্তাফিল। এ টাকায় তো এতোসব হবে না। একটি না হয় কেনা যাবে। কিন্তু কেউ কারো কথা রাখছে না। আর ঝগড়ার কারণ এটাই।”
ভিক্ষুকদের কথা শুনে বৃদ্ধলোক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। শেষে জিজ্ঞেস করলেন,
“তাহলে তোমাদের ঝগড়ার বিষয় এটাই?”
একজন জবাব দিলো,
জ্বী, বিষয়টা তো এই। এতে অবশ্য খারাপ কিছু নেই। কোন বিশেষ ফল খাওয়া না খাওয়া বড় কথা নয়। আসল কথা কেউ কাউকে মানতে রাজি নয়। এতে আবার আপনার হাসির কি হলো?”
বৃদ্ধ ছিলেন লেখাপড়া জানা লোক। তিনি আরবী,
ফারসী, তুর্কী আর গ্রীক ভাষাও মোটামুটি জানতেন। তাই আবারো হাসলেন এবং বললেন,
“তোমাদের কথা কিন্তু ঠিকই। কেউ কারো কাছে মাথা নত করতে চাও না। তবে তোমাদের কথা বার্তায় তো খুব একটা বিরোধের কিছু দেখছি না। বিরোধ অবশ্য আছে সেটা অন্য কোথাও।”
ভিক্ষুকেরা বললো,
“সে আবার কি?
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?”
বৃদ্ধঃ “আমি তোমাদের কাছে জানতে চাই তোমরা কি রাজি আছো যে প্রতেকে নিজের ভাগেরটুকুই খাবে ও অন্যের ভাগে ভাগ বসাবে না?”
ভিক্ষুকেরা বললো,
“অবশ্যই।আমাদের মাঝে ভাগাভাগি নিয়ে কোন সমস্যা নেই। আমরা সবাই বন্ধু। সমস্যা হয়েছে কি খাব তা নিয়ে। এত অল্প টাকায় তো আর সব কিছু পাবো না।”
বৃদ্ধঃ “খুব ভালো কথা বলেছো। বিরোধ তো হয়ে থাকে ভাগাভাগি নিয়েই। তা তোমাদের মাঝে যখন ওই ব্যাপারটি নেই,
খুবই ভালো হলো। এখন আমার কথা শুনো। তোমরা সবাই এক জিনিষই চাচ্ছো। আঙ্গুর,
ইনাব, ওযোম আর ইস্তাফিল এক ফলেরই আলাদা নাম। বিশ্বাস না হয় চলো আমার সাথে। তোমাদের কিনে দেবো। তখন দেখবে সবাই আনন্দে মজা করে খাচ্ছো।”
বৃদ্ধের কথায় এতক্ষণে ওদের মুখেও হাসি ফুটে ওঠলো। বললো,
“আল্লাহ আপনার হায়াত দারাজ করুন,
ঠিক সময়ে উপস্থিত হয়েছেন। নতুবা এতক্ষণে হয়তো আমরা মারামারি শুরু করে দিতাম। আসলে কেউ কারো ভাষা না বুঝার জন্যই এরকম হলো। এখন থেকে আরো বেশী বেশী একে অপরের ভাষা শেখার চেষ্টা করবো।”
এরপর থেকে চার ভিক্ষুক আরো ঘনিষ্ঠ হলো এবং পরস্পরের ভাষা শিখে জ্ঞান অর্জনের দিকে এগিয়ে গেলো। লেখাপড়া শেখার উৎসাহ-উদ্দীপনা তাদের পেয়ে বসলো। কিছুকালের ভেতরই তারা ভিক্ষা ছেড়ে বিভিন্ন পেশা ধরলো। তবে এক সাথে মিলেমিশে একটি উত্তম কাজ শুরু করলো। আর তাহলো তাদের চার ভাষায় অভিধান রচনা।
লেখকঃ মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান
(সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির
“মসনবী” কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।
No comments:
Post a Comment