Wednesday, November 28, 2018

বিভক্তির রাজনীতি

বহুদিন আগের কথা। তখন ছিল গরমকাল। একদিন এক মত ও এক পথের তিন ব্যক্তি এক সাথে শলাপরামর্শ করে ঠিক করলাে, কয়দিনের জন্য তারা কোন এক গ্রামে যাবে। আর সেখানে ফলমূলের বাগানে ঘুরে ফিরে মনের সুখে দিনগুলাে কাটিয়ে দেবে। তিনজনের একজন ছিলাে ভবঘুরে ফকির---মাথায় তার দরবেশী টুপি। দ্বিতীয়জন ছিলাে বেশ-ভুষায় মােল্লা-মুনশী, মাথায় তার সাদা পাগড়ি। আর তৃতীয়জন ছিলাে সৈয়দ বংশীয় আলেম। তার গায়ে সবুজ শাল, মাথায় সবুজ পাগড়ী, সৈয়দদের যা নিশানা। এই তিনজনেরই অভ্যাস ছিলাে মানুষের ঘরে ঘরে ধরনা দিয়ে বিনা পরিশ্রমে খাওয়া-দাওয়া করা ও অলস অকর্মণ্যভাবে দিনকাল কাটিয়ে দেয়া।

যেমন পরামর্শ তেমন কাজ। তারা তাদের শহর ছেড়ে রওয়ানা দিলাে গ্রামের দিকে। চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাে এক সবুজ শ্যামল গ্রামে। তারা গ্রামটি হেঁটে হেঁটে পরখ করতে লাগলাে। গ্রামে অনেক ফলের বাগান। বাগানের গাছে গাছে কাচা-পাকা আপেল, নাশপাতি, আনার, আঙ্গুর আরাে কতাে রসে টসটস ফল ঝুলছে। একটি বাগানের গেট খােলা ও জনশূন্য দেখতে পেয়ে তারা ঢুকে পড়লাে তাতে। বাগানের ভেতরেও কাউকে দেখতে না পেয়ে সােজা চললো পাকা পাকা ফল গাছের দিকে। তিনজনেই লেগে গেলাে ফল ছিড়তে। প্রত্যেকেই যার-যার পকেট ভরে ফল নিয়ে বসলাে একটি গাছের ছায়ায়। এবার শুরু হলাে তাদের ফল খাওয়া, গল্প-গুজব আর হাসি-তামাশা।

প্রায় দুপুরের দিকে বাগানের মালিক শাবল হাতে জমি-জমার কাজ শেষে ফিরলাে বাগানে। বাগানে ঢুকেই দেখলাে তিনজন অজানা অচেনা অনাহূত মেহমান। মেহমান তিনজন বেশ আরামেই গল্প-গুজবে ও ফল খাওয়ায় মশগুল।

বাগানের মালিক ছিল একজন কৃষক। ব্যাপার দেখে তার মেজাজ একেবারে তিরিক্ষি হয়ে গেলাে। শীতের সময় রাত দিন খেটে গাছগুলােতে সে অতিকষ্টে পানি রবরাহ করেছে এ জন্যে যে, এই ফলের মওসুমে ফল পাবে ও তা বিক্রয় করে সংসার চালাবে। সে যখন দেখলাে, এরা তাকে দেখেও নিশ্চিন্ত নির্ভাবনায় গল্পগুজবে ব্যস্ত তখন তার মেজাজ আরাে গেলাে বিগড়ে। একবার ভাবলাে তাদের সামনে গিয়ে চেঁচামেচি ও বকাবকি করে ঝাল মেটাবে ও বাগান থেকে ঘাড় ধরে বের করবে। কিন্তু মনে মনে ভাবতে লাগলাে এরা যদি সাধারণ মানুষই হবে তবে তাে বিনা অনুমতিতে কারাে বাগানে ঢুকতাে না। ফলও খেতাে না, আর এসব আলেম-ওলামা ও ওলী-দরবেশের পােশাক পরে এহেন কাজের মাধ্যমে বদনামীর ভাগী হতাে না। এদের কার্যকলাপে মনে হচ্ছে এরা বেহিসেবী অলস অকর্মণ্যের দল, বিনা পরিশ্রমে পরের মাল খাওয়া এদের অভ্যাস হয়ে পড়েছে। তাই এদের কোন ভালাে কথা বলে মানুষ করা যাবে না।

এ ভেবে কৃষক কি করা যায় সে উপায় খুঁজতে লাগলাে। মনে মনে বললাে, “আমি একা মানুষ আর ওরা নাদুস-নুদুস তিনজন এবং একেবারেই বেপরােয়া। ওদের কাছে প্রতিবাদ করতে গেলে হয়তাে কথা কাটাকাটি ও মারামারি শুরু হবে। তিনজনের সাথে একা পারা যাবে না। তাই সবচে’ ভালাে হবে কৌশলে এদের মধ্যে বিরােধ ও অনৈক্য বাধানাে, আর এক এক করে ওদের বারােটা বাজানাে৷” এ চিন্তা করেই মালিক তার পরিকল্পনা আটলাে। হাতের শাবল মাটিতে রেখে গাছ থেকে এক থােকা আঙ্গুর পাড়লাে। এরপর হাসি মুখে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাে তাদের সামনে এবং বললো “আসসালামু আলাইকুম, বাবারা! খােশ আমদেদ। ভালাে আছেন তাে?”

ওরা সালামের জবাব দিলাে। তবে যেহেতু জানতাে যে ওদের কাজটি বড় অন্যায় কাজ হয়েছে তাই কৃষকের এমন সুন্দর ব্যবহারে তাজ্জব হলাে। তারা বুঝে ওঠতে পারছিলাে না যে কি করা যায়। তাদের কথা বলার আগেই কৃষক এগিয়ে তাদের কাছে এসে বসলাে এবং নিজের কথার রেশ ধরেই বললাে, “আশ্চর্যের বিষয়, আজ আমি একেবারে একাকী ছিলাম। একাকী মেজাজ সত্যিই খারাপ হয়ে যায়। আল্লাহর কি মেহেরবানী। আপনাদের তিনি ঠিক সময়েই পাঠিয়েছেন। কথাবার্তায় সময়টা বেশ আনন্দেই কেটে যাবে। তা বাবারা, সবাই ভালাে আছেন তাে? শহর থেকে এসেছেন বুঝি?”

তারা জবাব দিলাে, “আলহামদুলিল্লাহ আমরা সবাই ভালাে। আমরাও চাচ্ছিলাম আপনার সাথে দেখা করবাে, একাকী আমাদেরও তেমন ভাল লাগছিলো না। শহর থেকে গ্রাম দেখতে এসেছি।”

মালিকঃ “বেশ করেছেন, স্বাগতম। শহরের মানুষ আপনারা। আপনাদের দেখলে মন জুড়ায়। নিন পাকা আঙ্গুর খান। খুব ভালাে জাতের আঙ্গুর এটি। কিন্তু এভাবে তাে আপনাদের আপ্যায়ন করা যায় না। বিছানা পত্র, ফরাশ-গালিচা কিছুই সাথে নেই দেখছি। এতে আরাম পাবেন না। এভাবে মেহমানদারী হয় না। এখানে গালিচা বিছিয়ে, আরামের সাথে বসা উচিত।”

কথা বলার সময় কৃষক বুঝতে পারলাে যে, তিনজনের মধ্যে সূফী-দরবেশের পােশাকধারী লােকটির মাথায় তেমন ঘিলু নেই, বুদ্ধিশূন্য হাবা। তার দিকে তাকিয়ে বললাে, “বাবারে, আমি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তুমি একটু কষ্ট করাে, ঐ যে দেখছো, ঐ দিকে বাগানের শেষ মাথায় একটি ছােট্টঘর আছে, এর ভেতর একটি বড় গালিচা দেখবে, নিয়ে এসো।”

কৃষকের কথায় ফকির বেচারা ওঠে দাঁড়ালাে এবং নির্দেশিত দিকে চলে গেলাে। এ সময় বাগানের মালিক মােল্লা ও সৈয়দের কাছাকাছি মুখ নিয়ে বললােঃ “ভাইয়েরা আমার, আমি আপনাদের দু’জনকে খুব ইজ্জত করি। আপনাদের একজন হলেন গিয়ে মােল্লা, এলেম-কালাম জানেন, মসজিদ-মিম্বরের মানুষ। আরেকজন তাে সৈয়দ, আউলাদে রাসূল। আপনাদের পায়ের ধূলি আমার চোখের সুরমার সমান। কিন্তু ঐ যে ফকির বেশধারী, সে তাে মনে হয় একেবারে আলসে অকর্মণ্য অপদার্থ লােক। তাকে সাথে রাখা কি আপনাদের মানায়? তাকে কি কারণে আপনাদের সঙ্গী করেছেন? বিনা পরিশ্রমে খাওয়া ছাড়া তার কাজই বা কি? আমার ওপর তার কোন অধিকার নেই। সে না থাকলে আপনারা দু’জন সম্মানিত মেহমান এখানে সপ্তাহখানেক কিংবা ইচ্ছে করলে যতদিন খুশি বেড়িয়ে যান। আমি আপনাদের খেদমত করতে পারলে ধন্য মনে করবাে। তবে এই বেকার অপদার্থ ফকীরকে আমি এখান থেকে তাড়াতে চাই। এরপর আমরা যতখুশী আমােদ-প্রমােদ করবাে। কি বলেন?”

বাগান মালিকের মন্ত্র তাদের ওপর প্রভাব ফেললাে। দু’জন দেখলো যে প্রস্তাবটা মন্দ নয়, তাই জবাব দিলাে, “জ্বী জনাব, আপনার কথাই ঠিক। আমরাও এই দরবেশকে নিয়ে বেশ বিরক্ত। বেচারা নিজে নিজেই আমাদের সাথে বলপূর্বক জুটে গেছে। এখন ফিরে এলে আপনার যা ইচ্ছে তাই করুন। আমরা কিছুই বলবাে না।”

বাগান মালিক বললাে, “ঠিক আছে। ব্যবস্থা আমিই করবাে।” ফকির গালিচা নিয়ে ফিরে আসতেই মালিক বললাে, দেখাে ফকীর বাবা, এই সৈয়দ ও মােল্লার সাথে আমার অনেক আগের পরিচয়, জানাশুনা। তারা এখানে আমার সম্মানিত মেহমান। কিন্তু আমি ফকীরগোষ্ঠীকে মােটেই সহ্য করতে পারি না। খুব বিরক্ত লাগে তােমাদের দেখলে। তাই বলছি তুমি তােমার নিজের চিন্তা কর। নিজের পথ নিজেই দেখাে। এই কয়টা আপেল নিয়ে যাও বাবা, রাস্তা মাপাে, আল্লাহ তােমার রিজিক অন্য কোথাও রেখেছেন। খােদা হাফেজ বাবা।”

ফকীর বুঝতে পারলাে বাতাস উল্টো বইছে, তাই বন্ধুদের প্রতি তাকিয়ে দেখলাে তারা সবাই মাথা নিচু করে আছে ও চুপচাপ। কেউ কিছুই বলছে না। বাধ্য হয়েই মাথা নাড়লাে এবং তাদের লক্ষ্য করে বললাে, “বেশ ভালাে কথা, আমি যাচ্ছি, বুঝা গেলো যে তােমরা সবাই একহাত হয়েছো, কিন্তু আমি যা দেখতে পাচ্ছি এ বিশ্বাসঘাতকতার জন্য এই বাগান আর বাগানের মালিকের কাছ থেকে সুখ পাবে না।”

মােল্লা ও সৈয়দ বিরক্ত হয়ে বললাে, “তাের মাথা ঘামাতে হবে না ব্যাটা। তুই কেটে পড়।”

ফকীর পথ চলা শুরু করলাে ও বাগান থেকে বেরিয়ে গেলো। বাগান মালিক দেখলাে যে, তার বুদ্ধি বেশ কাজে লেগেছে। সে মেহমান দু’জনকে বললাে, “বাবারা একটু অপেক্ষা করুন, আমি বাগানের দরজাটা বন্ধ করে আসি।” এই বলে সে দৌড়ে ছুটলাে দরজার দিকে। পথে একটি মােটা লাঠি নিতে ভুললাে না। বাগান থেকে বেরিয়েই দেখতে পেলাে ফকির বেচারা এদিক সেদিক উদ্দেশ্যহীনভাবে তাকাচ্ছে। ব্যস, তার কাছে গিয়ে বললাে, “এই বেইনসাফ। লজ্জা-শরম কি খেয়ে ফেলেছিস যে, মানুষের বাগানে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়িস ও যা পাস তাই খাস? কোন পীর-মুর্শিদ তােকে এ অনুমতি দিয়েছে যে, অন্যের মাল খেতে পারবি। অতিসত্বর এখান থেকে দূর হ, নইলে গ্রামের মানুষ ডেকে এমন দশা ঘটাবাে যে, জীবনে কখনাে ভুলবিনে।” এ কথা বলেই হাতের লাঠি দিয়ে ইচ্ছে মতাে ফকিরের খেদমত করলাে। বেচারা মারের চোটে শেষ পর্যন্ত উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালালাে।

ফকিরের কাজ শেষে বাগান মালিক ফিরে এলাে বাগানে এবং সহাস্যে বললাে, “ইনশাআল্লাহ মাফ করবেন। ফকিরের চেঁচামেচি হয়তাে শুনেছেন। আমি আসলে তাকে মারতে চাইনে, কিন্তু আমাকে দেখেই সে কিনা গালাগালি শুরু করলাে। তাই তাকে কিছু সবক দিতেই হলাে। কিছু মনে করবেন না। যাক আপদ দূর হলাে। এখন তিনজনে বেশ ভালােই কাটবে।” এবার কৃষক বসে বসে গােঁফে তা দিতে লাগলাে আর ভাবতে শুরু করলাে, এখনাে এরা দু’জন। আমি একা দু’জনের সাথে পারবাে না। এ ভেবেই কথাবার্তা ও গল্প জুড়ে দিলাে আর মনে মনে ফন্দি আঁটতে লাগলাে। দুপুর গড়িয়ে আসতেই কৃষক বললাে, “এখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। এবার খানাপিনার বন্দোবস্ত করা দরকার।”

সৈয়দ ও মােল্লা বললাে, “চাচাজান, খানার কোন প্রয়ােজনই নেই। আমরা যথেষ্ট ফল খেয়েছি, একেবারে পেট ভর্তি। আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনে এখন। আসলে দুপুরের খানা না খেলেই ভালাে।”

বাগান মালিকঃ “না না, মােটেই নয়। এ হতেই পারে না। সামান্য দু' লােকমা ডাল ভাত খেতেই হবে। আপনারা আলেম-ওলামা মানুষ, আপনাদের খেদমত করতে পারলে অনেক সওয়াব, খেতেই হবে।”

এরপর সৈয়দের দিকে তাকিয়ে সে বললাে, “বাবা সৈয়দ, আপনার পূর্ব পুরুষ রাসূলের দোহাই, একটু কষ্ট করুন। আমার বাড়ি কাছেই, বাগান থেকে বেরিয়ে দু'এক বাক মােড় নিলেই আমার ঘর। ঘরে গিয়ে বলবেন, আমাদের খানা এখানে এ বাগানে খাবাে, আপনার কাছে যেননা দিয়ে দেয়। ঘরে দুপুর বেলা কোন শান্তি নেই, বাচ্চাদের দুষ্টুমীতে খানাদানার পর একটু বিশ্রাম নেয়ার ও চোখ বন্ধ করার কোন জো নেই। আজ আপনাদের সাথে এখানে খেয়ে দেয়ে একটু আরামে গাছের ছায়ায় ঘুমুবাে। যান বাবা, আপনি বয়েসে ছােট তাই আপনাকেই বিরক্ত করছি। তা ছাড়া সৈয়দ মানুষ পর হলেও আপন। যান বাবা, গিয়ে আমার গিন্নীকে বলবেন, তিনজনের খানা যেনাে পাঠায়। ডাল ভাত যা হােক আলেম-ওলামাদের সাথে একত্রে খেয়ে সওয়াব পাবাে। বাগান থেকে বেরিয়ে বাম দিকের পথ ধরে যাবেন, পাড়ায় ঢুকে দ্বিতীয় গলির ডান পাশের চার নম্বর ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বলবেন, বাগান থেকে এসেছি।”

বাগান মালিক জানতাে যে, ঠিকানা মতাে ঘরে কেউ নেই।

যাক সে কথা, সৈয়দ তার সবুজ শাল গায়ে জড়িয়ে ও মাথায় সবুজ পাগড়ি বেধে রওয়ানা হলাে খানার সন্ধানে। এরপর বাগান মালিক বসলােমােল্লার সামনা সামনি এবং বললাে দেখাে ভাই, একজন ভালাে ও সৎ মানুষের কয়েকদিন মেহমানদারী করার ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ইনসাফ বলে একটা কথা আছে। আমি একজন মেহনতি কৃষক। আপনিও একজন পরিশ্রমী আলেম। নামাজ রােজার মসলা মাসায়েল মানুষকে শিক্ষা দেয়া বহু কষ্টের কাজ। সুতরাং মেহনতি আলেম হিসেবে আমার ওপর আপনার নিশ্চয়ই হক আছে। আমি আপনার খেদমত করতে পারলে ধন্য হবাে। আখেরাতে ফায়দা আছে। কিন্তু এই যে যুবক, বাপদাদার সৈয়দ নামের নিশানা হিসেবে সবুজ শাল গায়ে জড়ানাে ছাড়া তার আর কি গুণ আছে? সে মানুষের কি উপকার করছে যে এভাবে পরের ঘরে খেয়ে বেড়াচ্ছে? তা ছাড়া, আসলেই সে সৈয়দ কি না তাই বা কে জানে? হয়তাে বা সবুজ শাল তার মিথ্যা পােষাক। এরাই পয়গম্বর ও আওলাদে রাসূলের বদনাম করছে। পয়গম্বর কোথায় বলেছেন যে, তার বংশধর। বিনামূল্যে পরের ঘরে পরের মাল খাবে? আসলে এটা এসব অপদার্থদের একটি পেশা মাত্র। এসব ছােট লােকের সাথে আপনার মতাে বিরাট আলেমের দোস্তি ঠিক নয়। মানুষ আপনাকেই শেষ পর্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করবে। তাই এসব অপদার্থ যুবক ছােকরাদের সঙ্গ ছাড়াই উত্তম। যাক, আমার কথা হলাে সৈয়দ নামধারী ফিরে এলে তার সাথে ক’টা কথা বলবাে। আপনি চুপচাপ থাকবেন। তার সাথে আমাদের হিসেব চুকে ফেলতে হবে। তাকে পাঠাবাে তার পথে। সে চলে গেলে আপনি আমাদের সাথে এই গ্রীষ্মকালটা এখানেই কাটিয়ে দেবেন। এখানে বেশ ভাল কাটবে আপনার। এমন সুশীতল আবহাওয়া শহরে পাবেন না। আমি আপনার কাছ থেকে এ সুযােগে দ্বীনি মসলা মাসায়েল শিখবাে, আমার ছেলেমেয়েরাও আপনার কাছ থেকে আরবী ফারসী শিখতে পারবে। আপনারও এই মওসুমটা বিশ্রামে কেটে যাবে। আপনি আমাদের মেহমান হলে আমাদের অনেক উপকার হবে। আপনার খেমদত করা গ্রামবাসীদের ওপর ফরজ। তবে ঐ সৈয়দ ছােকরাকে আমার মােটেই পছন্দ হয় না। তাকে তাড়াতেই হবে। সে কোন্ অধিকারে আমার বাগান ও সংসারে ভাগ বসাবে?

মােল্লা বাগবানের কথায় ও একমাস বিনা কাজে বসে বসে খাওয়ার লােভ সামলাতে পারছে না। তাই বললাে, আসলে আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু ব্যাপার হলাে---

বাগান মালিকঃ কোন কিন্তু নেই, আপনাকে কিছুই বলতে হবে না, আমিই সব ঠিকঠাক করবাে।

ওদিকে সৈয়দ বেচারা গ্রামের পাড়ায় গিয়ে ঠিকানা মতাে দরজায় গিয়ে দেখলাে কেউ নেই। তাই খালি হাতে ফিরে এলাে বাগানে, বললােঃ “ঘরে কেউ নেই।”

বাগান মালিক তার কথা লুফে নিয়ে বললাে তমি একজন অপদার্থ মানুষ বাপ। কোথায় কার বাড়িতে ঘুরে এসেছে। যাক সে সব কথা, আসলে তুমি নামেই সৈয়দ, কাজে কর্মে একেবারে উল্টো। তােমার মতাে লােক ক্ষতিকরও বটে। জনাব মওলানার সাথে আমার পুরানাে দোস্তি ও আত্মীয়তার কথা এতক্ষণ আমরা খুঁজে বের করেছি। কিন্তু তুমি আমাদের কেউ নও, পর। আমাদের কাছ থেকে তােমার দূরে সরে যাওয়াই সমীচীন। অনর্থক আমাদের আরাম-আয়েশের সময়টা নষ্ট করাে না। যাও বাপু, ঐ আঙ্গুরের ঝডিটি তােমার। এটা নিয়ে যত শিগগির এখান থেকে বিদায় হও। এ রকম অপদার্থ কুঁড়ে মানুষ আমার মােটেই সহ্য হয় না। জলদি যাও, আমরা এখন কথায় ব্যস্ত আছি।

সৈয়দ মােল্লার দিকে তাকালাে, দেখলােমােল্লা মাথা নুয়ে মুখ বন্ধ করে আছে। কোন কথা বলছে না। সে বুঝতে পারলাে যে, বাগবান তার উদ্দেশ্য সফল করেছে। তার কুমন্ত্রণা মৌলভীর ওপর প্রভাব ফেলেছে। তখন মুখফুটে বললাে, হযরত মওলানা! এটাই কি বন্ধুত্বের পরিচয় যে, এক সাথে আসবাে আর একা বিদায় হবাে? তাের কপালেও মন্দ রয়েছে।

মােল্লাঃ আমার বলার কি আছে! বাগান কি আমার?

বাগবানঃ হ্যা, ব্যাটা দেখছি কথা বাড়াচ্ছে। বাগান আমার, মওলানা সাহেবও আমার মেহমান। আমার হুযুর তিনি, একেবারে পীর-মুর্শিদ। এতে তাের বলার কিছু নেই। তুই ব্যাটা প্রথমেই অন্যায় করেছিস। কে তােকে দাওয়াত করেছে যে এখানে। তশরিফ এনেছিস? এখন কথা না বাড়িয়ে জলদি বের হয়ে যা, নইলে আমিই জানি তাের কি গতি হবে।

সৈয়দঃ ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি মােল্লার হুযুরী ও পীরগিরি আর পুরানাে বন্ধুত্ব কিছুই তার কাজে আসবে না। তার ভাগ্যেও বিপদ আছে। যাক, গােলাম, খােদা হাফেজ।

বাগবান ছুটলাে তার পিছু পিছু। বাগান থেকে বের হতেই সৈয়দের ঘাড় চেপে ধরলাে আর সেই লাঠি দিয়ে আচ্ছা করে ঝালমিটালাে এবং বললােঃ বজ্জাতি করার আর জায়গা পাসনে। বিনা অনুমুতিতে লােকের বাগানে ঢুকবি, মানুষের মাল খাবি এরপর কি না লম্বা লম্বা কথা। উটের বাচ্চাও উটের আকৃতি পায়, কিন্তু তাের কোন্ বিষয়টি পয়গম্বরের মতাে? তাের পূর্ব পুরুষ রাসূলে খােদা কি বলেছেন যে, বেকার। ঘুরে বেড়াও, মানুষের মালে হাত দাও ও বিনা অনুমতিতে যা পাও তাই খাও? জলদি এখান থেকে পালিয়ে যা, নইলে গ্রামের মানুষ জানতে পারলে তাের ইজ্জত-সম্মান ততা যাবেই, জান নিয়ে যেতে পারবি নে। সৈয়দ লাঠি পেটা ও লাথিগুতা খেয়ে দৌড়ে পালালাে।

সৈয়দ চলে যেতেই বাগান মালিক ফিরলাে বাগানে। বাগানের দরজা শক্ত করে বন্ধ করলাে। এরপর শাবল হাতে গেলােমােল্লার সামনে। বললাে, জনাব মােল্লা, এবার আসল কথায় আসা যাক। বলো ব্যাপার কি?

মােল্লা নিরুত্তর। বাগবান বললােঃ কি হলাে, কথা নেই কেনো?

মােল্লাঃ কি বলবাে?

বাগবানঃ ব্যাটা জোচ্চোর কোথাকার, কোন্ অধিকারে এ বাগানে ঢুকেছিস? কার হুকুমে আপেল, আঙ্গুর ও আনারের গায়ে হাত দিয়েছিস? আমি জানতে চাই কোন্ কিতাবে লেখা আছে যে, মালিকের অনুমতি ছাড়া তার বাগানে বা ঘরে ঢােকা যায় আর না জানিয়ে তার মাল নেয়া যায়? এ কথা কোন শরিয়তে আছে? জবাব দে, নইলে এই শাবল দিয়ে তাের বারটা বাজাবাে।

হতভাগা মােল্লা এ ধরনের আপ্যায়নে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। মাথায় তার কিছুই আসছে না, তাই বললােঃ কোন কিতাবেই এসব নির্দেশ নেই। কিন্তু আমি তাে একা আসিনি, আমরা তিনজন মেহমান এসেছিলাম। আমি বুঝতে পারছি না প্রথম দিকের এত সব আদর-আপ্যায়নের অর্থই বা কি, আর এখন এসব বেইজ্জতির মানেই বা কি?

বাগবানঃ আসলে তােরা প্রথমেও তিনজন ছিলি না, যদি তিনজনই ছিলি তবে এখনাে তা থাকতি। তােরা প্রত্যেকেই আলাদা ও ভিন্ন ভিন্ন ছিলি যেমন এখনাে আছিস। এ ছাড়া মেহমান কক্ষণাে ছিলি না। কারণ কেউ তােদের দাওয়াত করেনি। এখন আমি যা বলি তাই মানতে হবে। এতাে সব আদর-আপ্যায়ন, স্বাগতম-সম্মান এ জন্যে ছিলাে যে, আমি ছিলাম একা। কিন্তু তুই আরাে দুই অপদার্থকে দলে ভিড়িয়েছিলি। আর এখন এই যে অপমান-বেইজ্জতি দেখছিস তাহলো এ জন্যে যে, তুই গুনাহগার অপরাধী এবং আমার হাতে এই শাবল দেখতে পাচ্ছিস। যদি কেউ নিজের বিচার নিজে না
করে তাহলে অন্যরাই তার বিচার করতে বাধ্য হয়। এখন কি বলবি?

মােল্লাঃ কিছুই না, বলার আর কি আছে। আসলে সত্য কথা যদি জানতে চাও তাহলে শুন। আমি মােল্লা মৌলভী কিছুই নই। মাথার পাগড়ি বাকী ও কিস্তিতে কিনে এনেছি যাতে মােল্লার নাম করে বিনা কাজে খেয়ে দেয়ে দিন কাটাতে পারি। আসলে লেখাপড়ার আলিফ বাও জানি না, কোরআন কিতাব পড়াতাে দূরের কথা। ফিকাহ শরিয়ত যে কি তার নামও শুনিনি। আমার সঙ্গী বন্ধুরা সবাই বাজে বেকার লােক। মুনশি বা সৈয়দ সবই মিথ্যা কথা। এখন যা কিছু করতে চাও তার অধিকার তােমার আছে। কারণ আমি একা খাওয়া ও একা ভােগ করার লােভে পড়ে বন্ধুদের হারিয়েছি। তােমার বুদ্ধিই আসলে উত্তম রাজনীতি। তােমার চাল আমরা বুঝতেই পারিনি লােভের কারণে।

বাগবানঃ তবে নে তাের প্রাপ্য। এই বলেই শাবল দিয়ে মিথ্যা পাগড়িওয়ালাকে ইচ্ছে মতাে ধােলাই করলাে। মারের চোটে ভণ্ড মােল্লার চিল্লাচিল্লি ও গড়াগড়ি কে দেখে। শেষ পর্যন্ত দিকিবিদিক জ্ঞান হারিয়ে দিলাে ছুট। বাগবানও তার পিছু নিয়ে মনের মতাে শাবল দিয়ে ঝাল মিটাতে লাগলাে। অবশেষে মােল্লা বেচারা পাগড়ি-লেবাসের মায়া ত্যাগ করে কোন মতে জান নিয়ে উধ্বশ্বাসে বাগানের দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছেই দেয়াল টপকিয়ে পালালাে।

এতক্ষণে বাগান মালিকের মনের ঝাল মিটেছে। গোঁফে তা দিতে দিতে সে গিয়ে বসলাে গাছের ছায়ায়।

লেখকঃ মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী” কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।

No comments:

Post a Comment