Tuesday, November 27, 2018

হালুয়া

এক দেশে ছিলো এক শহর। সে শহরে বাস করতেন শেখ আহমদ খাজারী নামক এক আলেম। শহরে তার খুব নাম যশ। মানুষের উপকার সাধন ও কল্যাণ কামনাই তার জীবনের ব্রত। এ কারণেই তার খুব সুনাম। তিনি এক সময় বেশ ধনবান লোক ছিলেন। কিন্তু দান খয়রাত করে করে তার ধনসম্পদ সব শেষ করে দিয়েছেন। তিনি এখন দরিদ্র ও বিত্তহীন। তার ধনসম্পদ শেষ হয়ে গেলেও শহরের লোকজন তাকে ছাড়ছেনা। যে কোন অভাব-অনটনে ও সংকটে তারা হাযির হতো শেখ আহমদ খাজারীর কাছে। শহরে যদি কোন আগন্তুক আসতো এবং তার যদি থাকার কোন জায়গা না থাকতো তাহলে শহরের লোকেরা তাকে দেখিয়ে দিতো শেখ আহমদের বাড়ি। কেউ অভাবে পড়লে এবং ঋনগ্রস্থ হলেই ছুটতো শেখের কাছে। শেখের গরীব দুঃখী মুরিদের অভাব ছিল না।

শেখ আহমদের মনটা ছিলো খুবই নরম ও দয়ালু। এই দীল-দারাজ মানুষটি কোন অভাবীকে ফিরিয়ে দিতে পারতেন না। তাই শেষ পর্যন্ত মানুষের অভাব অভিযোগ মেটানোর জন্য পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে ছুটে যেতেন এবং টাকা পয়সা কর্জ করে মানুষের অভাব মেটাতেন। কারো সমস্যা দেখলে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। তার অবস্থা দেখে ঘরের লোকেরা বলতো, “আপনার এহেন অবস্থায় আপনি কখনো মানুষের ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন না।জবাবে শেখ আহমদ খাজারী বলতেন, “আরে বাবা, আমি কি আর আমার জন্যে ঋণ করি! আল্লাহর রাস্তায় খরচ করি আল্লাহ নিজেই এর ব্যবস্থা করবেন। এ যাবৎ তো ঠেকিনি, এরপরও ঠেকবোনা। আল্লাহ আছে।

দেখতে দেখতে শেখ আহমদের ঋণের পরিমাণ সাতশ দিনারে গিয়ে ঠেকলো। সাত শদিনার তখনকার দিনে বিরাট অঙ্কের টাকা । তবে যারা শেখ আহমদকে টাকা কর্জ দিতো তারা যখন দেখতে পেতো যে শেখ অসহায় নিঃস্ব মানুষের জন্যই ঐ অর্থ খরচ করছেন তখন বাধা দিতো না। তারা বলতো, শেখ আহমদ ভালো মানুষ। কর্জ পরিশোধ করতে না পারলে কি আর তিনি কর্জ নিচ্ছেন। নিশ্চয়ই তার কোন ভরসা আছে। ঐ ভরসা আছে বলেই কর্জ করে বিলাচ্ছেন। অনেক সময় লোকজন কোন কিছু মানত করলে বা সদকা দিতে চাইলে তা শেখ আহমদের হাতেই তুলে দিতো। শেখ আহমদও ঐ অর্থ কড়ি দিয়ে ছোট খাট ঋণগুলো পরিশোধ করে ফেলতেন। কিন্তু পুনরায় প্রয়োজন দেখা দিলে কিংবা কেউ এসে সাহায্য চাইলে তিনি ফিরিয়ে দিতে পারতেন না। তাই আবারো কর্জ করতেন। এ কারণে তার নাম হয়ে যায় কর্জ পীর। তিনি শুধু কর্জই করেন।

একবার শেখ আহমদ খাজারীর অসুখ হলো। ক্রমে ক্রমে তার অবস্থা শোচনীয় আকার ধারণ করলো। মুখে মুখে রটে গেলো যে শেখ আহমদ তার শেষ দিনগুলো কাটিয়ে যাচ্ছেন। আরোগ্যের কোন আশা নেই। এ খবরে পাওনাদাররা শঙ্কিত হয়ে পড়লো। তারা ভাবলো যে, এ ব্যক্তি তো সারা জীবন কর্জের উপর বেঁচে ছিলেন। এখন যদি মারা যান তাহলে তাদের পাওনা পরিশোধ করার কেউ থাকবেনা। সুতরাং যিন্দা থাকতেই তার কাছে যাওয়া উচিত। তখন একটা উপায় বের করতে তিনি বাধ্য হবেন। পাওনাদাররা একে অপরকে খবর দিলো এবং একদিন সবাই দল বেধে উপস্থিত হলো শেখ আহমদের বাড়িতে। তারা শেখকে বললো, হে শেখ, বহু বছর যাবৎ আপনি আমাদের কাছে যা চেয়েছেন তা কর্জ দিয়ে এসেছি। কিন্তু আপনি কখনো তা পরিশোধের চিন্তাও করেননি। আমাদের আর ধৈর্য নেই। টাকা পয়সা নেই বলে আমাদের বিদায় করতে পারবেন না। টাকা এনেছেন টাকা ফেরত দিতেই হবে। পরের অর্থে নাম করা ঠিক নয়। দিন, আজই আমাদের পাওনা দিয়ে দিন।

শেখ বললেন, কথা ঠিকই বলেছেন। আমি টাকার অপেক্ষায় আছি। আপনারা এতোকাল ধৈর্য ধরেছেন, আরেকটু ধৈর্য ধরুন। আমি কারো টাকা মেরে দেবো না।

পাওনাদাররাঃ কেউই কারো টাকা মারতে চায় না। কিন্তু কারো ঋণ যখন আসমান ছাড়িয়ে যায় আর তার পরিশোধের ক্ষমতা না থাকে তখন তার পক্ষে ঐ কর্জ শোধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আমাদেরও সমস্যা সংকট আছে। আমরাতো খাল-বিল থেকে টাকা পয়সা কুড়িয়ে পাইনি। ছাইয়ের নীচ থেকেও অর্থের ভাণ্ডার হাতে আসেনি। আমরাও যদি আপনার মতো বেহুদা দান-খয়রাত করে টাকা পয়সা উড়িয়ে দিতাম তাহলে আপনাকে কর্জ দেয়ার অর্থ কোথায় পেতাম? আপনি একজন বেহিসেবী মানুষ। একহাতে কর্জ করেন আর অন্য হাতে বিলিয়ে দিন। ভালো কাজ যে করছেন, তা ঠিক বটে। তবে ভালো কাজ তারই শোভা পায় যার ধন-সম্পদ আছে। যা হোক আমরা আপনার সম্মান রক্ষা করবো। আপনি যেহেতু সম্মানী ও নামী দামী লোক আপনার ইজ্জত-সম্মান নষ্ট করবো না। কিন্তু কথা হলো এর শেষ কোথায়?

শেখঃ ভাল কথা, এখন আপনারাই বলুন আমি কি করবো?

পাওনাদারগণঃ জানেন না কি করবেন? আমাদের পাওনা পরিশোধ করে দিন কিংবা দিন তারিখ নির্ধারণ করুন যে কবে পরিশোধ করবেন।

শেখঃ আমি তারিখ টারিখ কিছু বুঝিনে, দিন তারিখ আল্লাহর হাতে। আমি তো আপনাদের কথাই চিন্তা করছি। আপনাদের ধৈর্য ধরতে হবে। আমি সারা জীবন খেটে ইজ্জত-সম্মান কুড়িয়েছি। আপনাদের কোন অধিকার নেই হৈ চৈ করে আমাকে বেইজ্জতি করার। আমি চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি আপনাদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে। আল্লাহর কাছে এই সাতশদিনার কিছুই না। তিনিই ব্যবস্থা করবেন।

পাওনাদাররাঃ আমরা জানিনে কে দেবে, খোদা দেবেন না খোদার বান্দা দেবেন তাতে আমাদের কাছে কোন তফাৎ নেই। ভালো কথা, যদি কোথাও কোন ভরসা থেকে থাকে তাহলে আমাদের দিন তারিখ বলে দিন। যত তাড়াতাড়িকথার কি অর্থ আছে? আমরা আজ এখানে বসে থাকবো। আপনি আপনার চিন্তা ভাবনা করুন, কথা দিন। আপনার তো প্রতিদিনই মেহমান থাকে, আজ না হয় আমরাই আপনার মেহমান।

শেখঃ এঘর আপনাদেরই। আপনাদের স্থান আমার মাথার ওপর। থাকতে চানতো থাকুন, আমিও আমার চিন্তা করবো। তবে আমার যে আশা ভরসা এর কোন দিন তারিখ নেই। হয়তো খুব নিকটে, তবে তা আমার জানা নেই।

এমন সময় রাস্তার পাশ থেকে একটি হকার ছেলের ডাক শুনা গেলো। শে জোর গলায় বলছেঃ হালুয়া চাই হালুয়া, অনেক মজার হালুয়া, গরম গরম হালুয়া, জব্বর মজার হালুয়া। গেলো শেষ হয়ে গেলো হালুয়া।

শেখ আহমদ খাজারী হালুয়া বিক্রেতা ছেলেটির হাঁক-ডাক শুনে ভাবলেন, যা হবার হবে। আমার তো দেনা সাতশদিনার হয়েই আছে। এক ডালা হালুয়াতে আর তেমন কি আসবে যাবে। না হয় সাতশর সাথে সামান্য কিছু যোগই হলো। তাতে আর কি আসে যায়। ঘরে এখন মেহমান। শেখ আহমদ ঘরে মেহমানদের উপোস রাখার মতো লোক নয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। শেখ খাদেমকে ডেকে বললেন, যাও ঐ বালকের কাছ থেকে হালুয়ার ডালাটি কিনে নিয়ে এসো আর মেহমানদের খেতে দাও।

খাদেম জানতো যে, শেখের হাতে টাকা পয়সা নেই। হালুয়া বাকিতেই আনতে হবে। অথচ ঘরের মেহমানরা সবাই পাওনা আদায়ের জন্য বসে আছে। কিন্তু শেখের মন মানসিকতা তার ভালো করেই জানা ছিলো। তাই আর কোন কথা না বলে বের হয়ে গেলো রাস্তায়। খাদেম বালকটিকে ডেকে বললো, এই ছেলে, তোর সবটুকু হালুয়ার দাম কতোরে?

বালকঃ এক দিনার তিন দেরহাম।

খাদেমঃ আরে বাপু এতো দাম চাস কেনো? আমরা ফকির দরবেশ মানুষ। এতো টাকা পয়সা নেই। ঘরে এখন অনেক মেহমান। দে, এক দিনার পাবি।

বালকঃ এতে আমার কোন লাভ হবে না। ওস্তাদকেই দিতে হবে এক দিনার। আমার কিছু থাকবেনা।

খাদেমঃ আজ না হয় লাভ করলিনে। তোর ওস্তাদের দামেই দিয়ে দে। মেহমানরা খেয়ে দোয়া করবে।

বালকটি কিছুক্ষন ভেবে বললো, ঠিক আছে, এই নিন হালুয়া। বলুন কোথায় পৌঁছে দিতে হবে।

খাদেমঃ এখানেই, হুযুরের ঘরে নেবো।

বালকটি খুশি হয়ে হালুয়ার ডালা মাথায় তুলে নিলো এবং শেখ আহমদের ঘরে এসে মেহমানদের কাছে রাখলো।

শেখ মেহমানদের বললেন, বিসমিল্লাহ বলে শুরু করুন, সামান্য মিষ্টি মুখ করুন। আমিও ভেবে দেখি-কি করা যায়।

মেহমানরা শুরু করলো হালুয়া খাওয়া। শেখ ঘরের এক কোণে তার জায়নামাজ বিছিয়ে কয়েক রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে হাত উঠালেন এবং বলতে লাগলেনঃ হে খোদা! দেখতেই পাচ্ছো অবস্থা। আমি এই সাতশদিনার তোমার জন্যে কর্জ করেছি এবং তোমার অভাবী বান্দাদের জন্যে খরচ করেছি। এবার সর্বশেষ কর্জটাও করলাম। হে খোদা, এই হালুয়া বিক্রেতা ছেলেটির সামনে আমাকে লজ্জিত করো না। এখন জানিনে এই এক ডালা হালুয়ার কি জবাব দেবো। এরা সবাই শেখ আহমদের মেহমান আর শেখ আহমদতো তোমারই মেহমান।

এদিকে হালুয়ার মালিক বালকটি সবাইকে হালুয়া খাইয়ে শেখের সামনে এসে উপস্থিত হলো এবং বললোঃ হুযুর শেষ হয়েছে। এবার আমার টাকা দিন ঘরে ফিরবো।

শেখঃ অ্যাই ভালো ছেলে, শুন্। আমার কাছে তো এখন কোন টাকা পয়সা নেই। এই যে দেখছিস লোকজন হালুয়া খেলো তারা সবাই আমার পাওনাদার। সবাই বসে আছে তাদের পাওনা বুঝে নিতে। তুইও ধৈর্য ধরে বস্। হয়তো একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

বালকঃ আমি বাবা ওসব বুঝিনে। আমার বসার সময় নেই। হালুয়া খেয়েছেন দাম দিন। আমার দেরী হলে আমার ওস্তাদ আমাকে বকবে, হালুয়ার দাম না নিয়ে গেলেও বকাঝকা ও মারধোর করবে। এসব লোকের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমার টাকা দিয়ে দিন আমি চলে যাই।

শেখঃ হাঁ, তোর হিসাব এদের থেকে আলাদা। কিন্তু আমার হিসেব থেকে তো আলাদা নয়রে। আমার এখন সাতশদিনার ঋণ। এক কানাকড়িও নেই। আল্লাহ সাক্ষী আছেন যে, আমার হাত শুন্য। ধৈর্য ধরা ছাড়া কোন গতি নেই।

বালকঃ অ্যাঁ, বাবা! আজব ফাঁদে এসে পড়লাম। ধৈর্য ধরো মানে কি? আমার টাকা আমাকে দিয়ে দিন। জলদি করুন, নইলে পুলিশ ডেকে আনবো। টাকা না থাকলে হালুয়া কিনলেন কেনো? সে-ই হালুয়া কিনে যার টাকা আছে অথবা তার বড় কেউ আছে যিনি দাম দিতে পারেন।

শেখ আহমদ বালকের শেষ কথাটি শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন। তার মাঝে বিরাট ভাবান্তর দেখা দিলো। তার চোখ বেয়ে অশ্রু ধারা প্রবাহিত হলো। শেখ বললেন, ঠিক কথাই বলেছিস হে প্রিয় বালক। হালুয়া সে-ই কেনে যার অর্থ আছে কিংবা তার মাথার ওপর বড় কেউ থাকে যিনি ঐ মূল্য দিয়ে দিতে পারেন। আমারও একজন বড় ব্যাক্তি আছেন। অপেক্ষা করছি সেই বড় ব্যক্তি এসে আমার কর্জ আদায় করে দেবেন। আমি তো তার আশাতেই এতো সব কর্জ করেছি, আর তার পথেই সব খরচ করেছি।

শেখ আহমদের গাল বেয়ে চোখের পানি ঝরছে। হাতে তসবিহ। কান্নায় তার সারাটা শরীর দুলে দুলে কাঁপছে। বালক শেখের কান্না দেখে বললো, এতে কান্নার কি আছে। যার কথা বলছেন সেই বড় লোক কোথায়? মারা গেছে? নাকি কোথাও চলে গেছেন? জলদি করুন। বলুন তাকে আমার দিনার দিয়ে দিতে।

শেখঃ তিনি জীবিত, তিনি এখানেই আছেন। তিনি ইচ্ছে করলে সবার পাওনাই দিয়ে দিতে পারেন।

একথা বলার সাথে সাথেই শেখের বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো। হাউমাউ করে তিনি কান্না জুড়ে দিলেন। তার কান্নার শব্দ ছড়িয়ে গেলো দিকে দিকে। বালকটি শেখের অবস্থা দেখে একেবারে গলে গেলো। তার কলজেটাও যেনো শেখের দুঃখে কাবাব হয়ে গেলো। শেখের কথার কোন অর্থ সে না বুঝলেও তার ওস্তাদের ভয়ে আর হালুয়ার টাকার জন্য তারও কান্না এসে গেলো। সে জোর গলায় ডুকরে ডুকরে কেঁদে বিলাপ করে বলতে লাগলো, আমি ওসব বুঝিনে, আমি হালুয়ার টাকা চাই। আপনার টাকা যদি নাই থাকে তবে হালুয়া খেলেন কেনো! এসব ফকির দরবেশী আমি বুঝি না। দিন, আমার টাকা দিন। আমি আর কিছু চাইনে, আমার টাকা আমাকে দিয়ে দিন। ওস্তাদ আমাকে মারবে! আপনার বড় কই গেলো, বড়কে ডাকুন।

বালকের চিৎকার ও কান্নাকাটিতে শেখের বাড়িতে পাড়া পড়শীরা এসে জমা হলো। শেখকে তারা যা কিছুই জিজ্ঞেস করুকনা কেনো শেখ শুধু কাঁদছেন। শেখ কাঁদছেন নিরবে সারা শরীর দিয়ে। আর বালকটি কাঁদছে হাউ মাউ করে। লোকজন বলাবলি করতে লাগলো, বালকের কি দোষ। তার পাওনা তাকে দিয়ে দিলেই হয়। শেখের কর্জ বেশী না কম তার সাথে এ বালকের কি সম্পর্ক? বাবা, টাকা নেই তো হালুয়া খেলেন কেনো?

শেখের বাড়িতে বেশ শোরগোল শুরু হয়ে গেলো। আশেপাশের ও রাস্তার লোকজনও ছুটে এলো। এমন সময় এক বৃদ্ধ ভীড় ঠেলে প্রবেশ করলেন শেখের ঘরে। তার হাতে একটি চিঠি ও থলে। বৃদ্ধ শেখ আহমদের জায়নামাজের পাশে গিয়ে শেখের হাতে চিঠি ও থলে গুঁজে দিলেন এবং ভীড় ঠেলে পুনরায় বের হয়ে গেলেন।

শেখ আহমদ চোখ মুছে প্রথমেই চিঠিটা খুললেন।

ওতে লেখা ছিলোঃ

জনাব শেখ আহমদ খাজারী!

আসসালামুয়ালাইকুম। আমি এই মহল্লার একজন বাসিন্দা। কয়েক বছর আগে আপনার এক মুরীদ মুখ বাধা এই থলেটি আমার কাছে রেখে যান এবং বলে যান, ‘যেদিন দেখবেন যে শেখ আহমদ খুবই অভাবী হয়ে পড়েছেন এবং তার কোন উপায়ান্তর নেই তখন টাকার এই থলেটি তার হাতে পৌঁছে দেবেনআজ আমি আপনার ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখতে পেলাম হালুয়া বিক্রেতা ছেলেটি তার একটি মাত্র দিনারের জন্য বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে চিৎকার করে বুক ফাটাচ্ছে। ভেবে দেখলাম আজই আপনার সেই জরুরী দিন। আজ এক দিনারের জন্যেও আপনি দারুন অভাবী। তাই আমার সেই বন্ধুর অসিয়ত অনুসারে তার অনুরোধ রক্ষা করলাম। এ টাকা কড়ি দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করুন। আমিও চাইনে কেউ আমাকে চিনুক। খোদা হাফেজ

চিঠি পড়া শেষ হলে শেখ আহমদ বললেন, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। আজই তাহলে হিসাব-নিকাশের দিন ধার্য হয়েছে।

এরপর তিনি থলের মুখ খুললেন এবং বালকটিকে ডেকে বললেন, কাছে আয় বাবা! টাকার জন্যে অধৈর্য হয়ে পড়েছিলি। কিন্তু তুই সবার চেয়ে বেগুনাহ। ভালই করেছিস চিৎকার করে। তোর কান্না দিয়ে আমার ফরিয়াদ সেই বড় ব্যক্তির কানে পৌঁছে দিলি। বলেছিলাম না আমার মাথার ওপরও একজন বড় আছেন? এই নে তোর ওস্তাদের হালুয়ার এক দিনার। আর এই নে আরেক দিনার। এটি তোর। তুই আমাকে আজ বিরাট দুঃখ-কষ্ট ও বেইজ্জতি থেকে নাজাত দিলি। তোর চিৎকার না হলে আজ এতো তাড়াতাড়ি সমস্যার সমাধান হতো না।

বালকটি তার অর্থ নিয়ে চলে যেতেই শেখ আহমদ থলের বাকী অর্থ গুনতে শুরু করলেন। গুনে দেখলেন সাতশ দিনার। শেখ আহমদ পাওনাদারদের সব কর্জ পরিশোধ করে দিলেন। এবার পাওনাদাররা বলতে লাগলেন, জনাব শেখ! এখন আর তেমন তাড়াহুড়া নেই। আপনার প্রয়োজন হলে এ অর্থ অন্য কোন ফরজ কাজে খরচ করুন। আমরা ধৈর্য ধরবো। আগে অভাবীদের প্রয়োজন মিটান।

শেখঃ জ্বী না! কর্জ আদায়ের চেয়ে বড় ফরজ কাজ নেই। আর অনুরোধ করবেন না। আপনাদের পাওনা নিয়ে যান আর ঐ হালুয়া বিক্রেতা ছেলেটির জন্য দোয়া করুন। সে না থাকলে টাকা পয়সার কোন খবরই ছিল না। আমিও আল্লাহর কাছে এই একটা বিষয়ই চেয়েছিলাম। আমার একটা আরজুই ছিল যে মরণের আগে মানুষের কর্জ দিয়ে যাবো।

লেখকঃ মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির মসনবীকাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।

No comments:

Post a Comment