তখনকার
দিনে ছেলেমেয়েরা মকতবে ওস্তাদের কাছে লেখাপড়া শিখতো। শিক্ষককেই ওস্তাদ
বলা হয়। ওস্তাদ কোরআন শরীফ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বইপত্র পড়াতেন। ছাত্ররা
সেই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ওস্তাদের কাছে লেখাপড়া করতো। তারা নিজ নিজ
বাড়ি থেকে খাওয়া-দাওয়া সঙ্গে নিয়ে আসতো। কেবল শুক্রবারই ছিলো তাদের ছুটি।
ছেলেমেয়েরা এদিনেই মাত্র খেলাধুলা করার সময় পেতো। আগেরকার দিনের মক্তবগুলোতে
খেলাধুলার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। তখন ছাত্রদের শীতকালীন বা গ্রীষ্মকালীণ
ছুটিও ছিলোনা। শুধু পড়া আর পড়া। ওস্তাদগণ খুব কড়া ছিলেন। ছাত্ররা হাসাহাসি করা কিংবা উচ্চসরে
কথাবার্তা বলার সাহস পেতো না। মোট কথা ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা শেখানোর সাথে সাথে
তাদের আদব-কায়াদাও কঠোরভাবে শেখানো হতো। এ ব্যাপারে একটি প্রসিদ্ধ কবিতাই
আছেঃ
“ওস্তাদ যদি আচ্ছা করে
না দেয় কভু বেতের মার
বাচ্চারা সব বাঁদরামীতে
নাচিয়ে তোলে হাট বাজার।”
কিন্তু ছোট
ছেলেমেয়েরা খেলাধূলা ভালবাসে। তারা সারাদিনের পড়াশুনা ও ওস্তাদের কড়া শাসনে ক্লান্ত হয়ে পড়তো। তাই শুক্রবার, ঈদের
দিন কিংবা অন্য কোন ছুটির দিন কখন আসবে সেই আশায় তারা
দিনগুনতো। আর পরপর দু’তিনদিন কোনক্রমে
মকতব বন্ধ থাকলে তখন তাদের আনন্দ উল্লাস কে দেখে।
এক গ্রামে
ছিল দুটি মকতব। একটির নাম পীরের মকতব এবং দ্বিতীয়টির নাম মোল্লার মকতব।
দুটোতেই গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করতো। একদিন ভোরে মোল্লার মকতবের একটি
ছেলে মকতবে যাওয়ার পথে দেখলো পীরের মকটবের কয়েকটি ছেলে মহল্লার রাস্তায়
খেলাধূলা ও ছুটাছুটি করছে। সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেশ করলো, এই তোরা মকতবে যাচ্ছিস না কেন?
জবাব এলোঃ আমাদের
ওস্তাদের অসুখ। তাই তিন চারদিন মকতব বন্ধ থাকবে।
ছেলেটি এরপর চলে এলো
তার মকতবে। দু’চারজন
বন্ধুর দেখা পেতেই বললো, খবর
রাখিস কিছু?
জবাব দিলো, কিসের খবর?
ছেলেটি বললো, পীরের মকতব কয়দিনের জন্য বন্ধ থাকবে।
ওস্তাদ নাকি অসুস্থ।
ছেলেমেয়েরা বলে উঠলো,
কি সুখবর! ওস্তাদের
অসুখ হয়েছে আর তার মকতবের ছাত্ররা এখন মনের আনন্দে খেলাধুলা করছে।
কিন্তু আমাদের ওস্তাদজ্বীর তো অসুখ – বিসুখ কিছুই হয়না। একেবারে লোহার শরীর। আরে বাবা কয়দিন অসুখ
হলে এমন কি ক্ষতি হয়ে যায়। দুয়েক দিন ছুটি কাটাতে পারতাম।
ছাত্রদের মধ্যে একটি ছিলো
খুবই চালাক – চতুর
আর দুষ্ট। তার নাম রফিক। সে বললো, তোরা যদি আমার কথা শুনিস তাহলে এমন কাজ করবো যে,
আমরাও কয়েকদিন ছুটি
কাটাতে পারবো।
সবাই বললো, আমরা তৈরি। এখন বল্ কি করতে হবে?
রফিকঃ আমরা সবাই মিলে
আমাদের ওস্তাদজ্বীকে অসুস্থ বানাবো।
অন্যরা বললো, এ্যা! কেমন করে? সুস্থ লোককে কি করে অসুস্থ বানানো যায়?
রফিকঃ পারবো ঠিকই।
তবে সবাইকে কথা দিতে হবে সবাই আমার বুদ্ধি মতো কাজ করবি। আজ রাতে বুদ্ধি আঁটবো। এখন চল আজ
ভালো করে পড়াশুনা করি। ওস্তাদকে আজ পড়া দিয়ে খুশী রাখবো। সবাই চলে গেলো
ক্লাসে। ওস্তাদ আসার পর পড়াশুনা শুরু হলো। ঐদিন সবাই মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা
করলো। ওস্তাদ খুব খুশী হলেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে মকতব ছুটি হলো।
রাতের বেলায় ছেলেরা
সব এক জায়গায় জড়ো হলো। রফিকের পরামর্শে ঠিক করা হলো, আগামীকাল সবাই সকাল সকাল মকতবে হাজির
হবে। যারা
বেশী বুদ্ধিমান তারা একে একে ওস্তাদের ঘরের পাশ দিয়ে মকতবে ঢোকার সময় ওস্তাদকে
সালাম জানাবে আর বলতে থাকবে, ওস্তাদের
অসুখ মনে হচ্ছে? কি
হয়েছে? চেহারা
ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে? রাতে
ঘুম হয়নি নাকি? ইত্যাদি।
এমন কৌশলে বলতে হবে যাতে ওস্তাদ কিছুই টের না পায়।
ওস্তাদের ঘরটি ছিলো
মকতবে প্রবেশের
পাশের কামরায়। সাধারণতঃ তিনি ছেলেমেয়েদের আসা শুরু হওয়ার আগেই মকতবে
নিজের আসনে গিয়ে বসতেন। পরদিন কথামতো ছাত্ররা খুব ভোরেই রওয়ানা হয়ে গেলো
মকতবের পথে। রফিক সবার আগেই পৌঁছে গেলো মকতবে। ওস্তাদের ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার
সময় ওস্তাদকে দেখে সালাম জানালো। এরপর ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে বললো, “ওস্তাদজ্বী, আপনার শরীরটা খারাফ যাচ্ছে মনে হয়।
আল্লাহ না করুন, অসুখ-টসুখ করেনিতো?”
ওস্তাদ বললেন,
“নাতো, কিছুই হয়নি। যা পড়তে বস গিয়ে। পণ্ডিতি করতে
এসেছিস, না?”
রফিক আবারো সালাম
জানিয়ে চলে গেলো। এবার ওস্তাদ মনে মনে ভাবতে লাগলেন, রাতে কোনো অসুবিধা হয়েছে নাকি।
অসুখ-বিসুখের তো কোনো কিছু ঘটেনি। এরই ভেতর দ্বিতীয় ছেলেটি
এগিয়ে এসে সালাম জানালো এরপর ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে বললো, ওস্তাদ, আপনার চেহারা এমন ফ্যাকাশে কেনো?
রক্ত নেই
মনে হচ্ছে। আপনার কি কোনো অসুখ-টসুখ হলো?
ওস্তাদঃ না, ভালো আছি। যা, ক্লাশে বস গিয়ে। এবার ওস্তাদ সত্যি সত্যি
চিন্তায় পড়লো। ব্যাপার কি? বিনা
অসুখে মুখের রং ফ্যাকাশে হবে কেনো? তিনি তাকের উপর থেকে আয়নাটা টেনে এনে সামনে ধরলেন। কিন্তু আয়না দেখে
কিছুই বুঝতে পারলেন না। শরীরেও তেমন কিছু বুঝা যাচ্ছে না। তবু ওস্তাদকে
চিন্তা পেয়ে গেলো। ইতিমধ্যে এগিয়ে এলো তৃতীয় ছেলেটি। সালাম বিনিময়ের পর
উৎকন্ঠার সাথে বললো, “ওস্তাদজ্বী,
আপনার কি
হয়েছে? আপনার
চেহারা এতো রোগা রোগা দেখাচ্ছে কেনো? নিশ্চয়ই ঠাণ্ডা লেগেছে। একটু আরাম করলেই সেরে যাবে”। ওস্তাদ সত্যি
ভাবনায় পড়ে গেলেন। আবারো আয়না
তুলে ধরে চেহারা দেখতে লাগলেন। গাটাও যেনো কেমন ভার ভার মনে হচ্ছে। একটু
কেশে নিলেন। বললেন, না
রে বাবা, তেমন
কিছু হয়নি। সামান্য সর্দি টর্দি হবে হয়তো। সে সেরে যাবে। যাতো ক্লাসে
যা।
এবার চতুর্থ ছেলেটি
সামনে এলো।
ওস্তাদকে সবিনয়ে সালাম জানালো। এরপর ভালো করে ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি
ঘরে ঢুকলো এবং বললো, হুযুর,
শরীরটা খারাফ যাচ্ছে
নাকি? সন্ধ্যায় তো
ভালো দেখে গেলাম। খোদা না খাস্তা অসুখ না হলেই হয়।
ওস্তাদঃ জানি না কি
হয়েছে। তবে শরীর কেমন যেনো ম্যাজ ম্যাজ করছে। মাথাটাও ভারী মনে হচ্ছে।
ছেলেটি বললো, হুযুর এখন হাওয়া বদল হচ্ছে। সাবধান থাকা
দরকার। আমার আব্বাও গতকাল হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ঠিক
আপনার মতোই তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। মাথায় ব্যথা শুরু হওয়ায় কোনো
কাজেই যেতে পারেননি। সারাদিন বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলেন। সবাই বলে
ঠাণ্ডা লাগলে নাকি বিছানায় বিশ্রাম নিতে হয়। হুযুর, আপনার কিছু লাগবে?
ওস্তাদঃ না তেমন কিছু
প্রয়োজন নেই। দেখা যাক কি করি। আমার মাথাটাও কেমন ব্যথা করছে। ঠাণ্ডাই
লেগেছে। এ ছাড়া একটানা পরিশ্রম করাতেও শরীর খারাফ হতে পারে। যা, পড় গিয়ে। ভালো করে পড়।
এবার ওস্তাদ কিন্তু
মাথা ব্যথা ক্রমশঃ টের পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে গাটাও গরম। এ ভাবনার ভেতর থাকলেও
প্রকৃতপক্ষে যেহেতু অসুস্থ নন সেহেতু ঘরের ভেতর টুকটাক কাজগুলো গুছাতে লাগলেন। এমন
সময় প্রবেশ করলো পঞ্চম ছাত্র। আসসালামু আলাইকুম বলতেই ওস্তাদ তার দিকে
তাকিয়ে ওয়া আলাইকুম সালাম বলে জবাব দিলেন। ছেলেটি দারুণ উৎকণ্ঠার সাথে ওস্তাদের
দিকে তাকিয়ে বললো, হুযুর,
আপনার শরীর এতো খারাফ
দেখাচ্ছে কেনো? চেহারা
যে সাদা হয়ে গেছে। আল্লাহ শেফা দিক। এখন হুযুর সবখানেই ঠাণ্ডা সর্দি
শুরু হয়েছে। আমার ভাইজান গতকাল এরকম অসুখে পড়লে ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার
বললেন, ঠাণ্ডা
সর্দির তেমন কোন ওষুধ পথ্য নেই। তবে ভালো করে ক’টা দিন বিশ্রাম নিলেই সেরে যাবে। হুযুর
আপনি দয়া করে এতো পরিশ্রম করবেন না। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।
একথা বলেই সে বিদায়
নিলো। ওস্তাদ এবার সত্যি অসুস্থ বোধ করলেন। মনে হলো হাওয়া বদলের ফলে তার
ঠাণ্ডা লেগেছে। মাথাটা বেশ ব্যথা করছে। শ্বাস-প্রশ্বাসও যেনো গরম হচ্ছে।
ওস্তাদ ভাবলেন, ছাত্ররা
তাকে কতো ভালোবাসে। ওদের কচি চোখে ধরা পড়লো যে আমার অসুখ। অথচ আমার স্ত্রী মোটেও
টের পেলো না। আসলে সে বেখেয়াল। স্বামীর প্রতি তার দৃষ্টি নেই। আশ্চর্য
বউ নিয়ে সংসার করছি। এরপর ওঠে দাঁড়ালেন এবং গায়ে জোব্বা ও মাথায় পাগড়ি
চেপে লাঠিতে ভর করে বেরুলেন ঘর থেকে। এগিয়ে গেলেন মকতবের পেছন দিকে তার
বাসায়। বাসায় গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে বললেন, “আমার প্রতি কি কোন খেয়াল আছে? ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেরা যেখানে চেহারা দেখেই
বলে দিচ্ছে আমি অসুস্থ, সেখানে
তোমার চোখ কোথায় থাকে শুনি? পরের ছেলেরা
আমার জন্যে ভাবনা করছে কিন্তু ঘরের আপন মানুষের মোটেও খেয়াল নেই। আমি
মরে গেলেও যেনো ক্ষতি নেই।”
ওস্তাদের কথা শুনে
তার স্ত্রী বললেন, “আমি
তো কিছুই বুঝতে পারলাম না। কই, সেই
সাতসকালে তো তুমি ভালোই ছিলে। এরি মাঝে আবার কি ঘটে গেলো?”
ওস্তাদঃ হয়েছে,
হয়েছে, আর বুঝতে হবেনা। আজব স্ত্রী লোক তুমি। শুধু
নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, আমার
প্রতি কোন নজর নেই। ছেলেরা এতো ছোট হয়েও ধরে ফেলল যে আমি অসুস্থ। আর তুমি
কিনা কিছুই বুঝনি। যাও, জলদি
আমার বিছানা ঠিক করো আর আলমীরা থেকে কম্বল বের করে দাও। ব্যথায় মরে গেলাম।
রোগ যাতনা ও মাথা
ব্যথার ব্যাপারে কল্পনা এখন পাকাপোক্ত বিশ্বাসে রুপ নিয়েছে। তাই
ওস্তাদ ধীরে ধীরে আহ্ উহ্ শব্দে কাতরানীও শুরু করলেন। ওস্তাদ সত্যি
সত্যিই শয্যাশায়ী হলেন। মকতবের ছেলেরা সতর্কতার সাথে সব খবরই রাখছিলো। ওস্তাদ
বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছেন। এ খবর পেয়ে সবার সেরা দুষ্ট
ছেলেটি এসে উপস্থিত হলো ওস্তাদের ঘরের দরজায় এবং বললো, “হুযুর আসতে পারি।”
ওস্তাদের ঈশারায় সে
প্রবেশ করলো ঘরে এবং বিছানার কাছে গিয়ে অতি বিনয়ের সাথে বললোঃ হুযুর আমরা
তাহলে এখানে এসেই আপনার সামনে পড়াশুনা করি?
ওস্তাদঃ ঠিক আছে,
তোরা এখানেই পাটি
বিছিয়ে পড়াশুনা কর।
ওস্তাদের অনুমতি পেয়ে
সবাই এসে ওস্তাদের রোগশয্যা ঘিরে যার যার বইপত্র নিয়ে বসে গেলো আর গুণ গুন করে পড়ায়
ব্যস্ত হলো। এরপর দু’টি
ছেলে সবার সেরা দুষ্ট ছেলে রফিককে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলোঃ
এ আবার কি কাজ করলি? সবাই মিলে
তো হুযুরকে রোগী বানিয়ে শয্যাশায়ী করলাম কিন্তু এখন যে নিজেরাই তার ঘরে
নজরবন্দী হলাম। কই মকতব তো বন্ধ হলো না?
রফিক বললো, “ধীরে বন্ধু, ধীরে। আমার চোখের ঈশারায় সবাই গলার
আওয়াজ বাড়িয়ে পড়তে শুরু করবি।”
এরপর তার ঈশারায় সবাই
পড়ার আওয়াজ বাড়িয়ে দিলো। ঘর এবার ছেলেদের শব্দে সরগরম হয়ে ওঠলো। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই
রফিক ওস্তাদের কানে পৌঁছে এমন শব্দে ছেলেদের লক্ষ্য করে বললোঃ এই
ছেলেরা, তোরা
আস্তে আস্তে পড়। বরং কয়েক ঘন্টা একেবারে চুপ থাক। এসব আওয়াজ
হুযুরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। মাথা ব্যথা এতে আরো বেড়ে যায়। রোগীর জন্য নীরব
স্থান দরকার।
ওস্তাদ রফিকের কথা
খুব পছন্দ করলেন এবং বললেন, সে
ঠিকই বলেছে। তোরা বরং আজ চলে যা। আমার অবস্থা ভালো নয়। দেখি কাল কি করা যায়।
ছেলেরা ওঠে দাঁড়িয়ে
বললোঃ জ্বী হুযুর! আমরা যাই, আল্লাহ
আপনাকে তাড়াতাড়ি ভালো করে দিন। আপনার এখন অনেক বিশ্রাম দরকার। খোদা হাফেজ।
সবাই ওস্তাদের ঘর
থেকে বেরিয়ে এলো এবং কিছুদূর গিয়েই দে ছুট। ওদের আনন্দ উল্লাস আর কে দেখে। ছুটাছুটি দৌড়াদৌড়ি
করে ছেলেরা বইপত্র নিয়ে যার যার ঘরে ফিরতেই মায়েরা জিজ্ঞেস করলোঃ কি হয়েছে
তোদের? এতো
তড়াতাড়ি যে ফিরে এলি?
ছেলেরা জবাব দিলোঃ
হুযুরের অসুখ। মকতব বন্ধ করে দিয়েছেন।
কোনো কোনো মা ছেলেদের
কথা বিশ্বাস করতে পারলেন না। তারা আশঙ্কা করলেন ছেলেরা নিশ্চয় মকতব থেকে পালিয়েছে।
ছেলেরা মায়েদের
মনোভাব বুঝে বললোঃ আমাদের কথা বিশ্বাস না হয় গিয়ে দেখুন হুযুর অসুস্থ কিনা।
ওস্তাদের পাড়া
পড়শীদের কয়েকজন মহিলা ওস্তাদের অসুস্থ হওয়ার খবর জেনে তাকে দেখতে
গেলেন। কেউ কেউ গেলেন ছেলেদের কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। গিয়ে দেখলেন
সত্যি সত্যি ওস্তাদ অসুস্থ। একেবারে বিছানা নিয়েছেন এবং ব্যথা বেদনায়
কাতরাচ্ছেন। মায়েরা ওস্তাদের হাল অবস্থা জিজ্ঞস করলেন। তাদের ভেতর দুষ্ট
ছেলে রফিকের মাও ছিলেন। তিনি ওস্তাদকে বললেন, আমার স্বামী তো
চিকিৎসক। তিনি এখন
বাড়িতেই আছেন। তাকে বলবো আপনাকে দেখে যেনো ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করেন।
চিকিৎসক এসে ওস্তাদের
অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। হাতের শিরা, জিহবা, গলা ও হৃদ স্পন্দন পরীক্ষা করে রোগের
কোন লক্ষণই খোঁজে পেলেন না। নাচার হয়ে ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করলেন, জনাব ওস্তাদ, আপনার হয়েছেটা কি?
ওস্তাদঃ মাথা খুব
ব্যথা করছে। শরীরটা অবশ হয়ে গেছে। আমার অবস্থা মোটেও ভালো না। কিছু একটা
করুন। অন্ততঃ মাথা ব্যথাটা যেনো চলে যায়। বাকী বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
চিকিৎসক তো আর
মানুষের ভেতরের কথা বুঝতে পারে না। তাকে রোগী যা বলে তাই বিশ্বাস করতে
হয়। রোগী নিজে যদি চিকিৎসকের কাছে মিথ্যা বলে চিকিৎসক তা ধরবে কেমন করে।
ওস্তাদের কথা শুনেও চিকিৎসক বিশ্বাস করলেন। ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লিখে
দিলেন। মাথা ব্যথার ক্যাপসুল দিতে ভুল করলেন না। বাজার থেকে ওষুধ আসার পর
ওস্তাদ নিয়ম মতো খাওয়া শুরু করলেন। কিন্তু তিনি যেহেতু অসুস্থ ছিলেন না ঐ
ওষুধ তার জন্যে ক্ষতিকারক ছিলো। ওষুধ তো রোগীর জন্য, সুস্থ লোকের জন্য নয়। সুস্থ লোক ওষুধ
খেলে তার ক্ষতি হবেই। এছাড়া চিকিৎসকের কথা মতো অনেক খাবার-দাবারও ওস্তাদের
জন্য নিষেধ হয়ে গেলো। এতে করে ওস্তাদ সত্যি সত্যিই অসুস্থ ও দুর্বল
হয়ে পড়লেন। কয়েকদিন তাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হলো। অবশেষে বিশ্রাম গ্রহণ
ও ভালো চিকিৎসার পর তিনি আরোগ্য হলেন। এদিকে ছেলেরাও কয়েকদিন এক নাগাড়ে
খেলাধুলা ও ছুটাছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। ওস্তাদও মকতব খুলে ছেলেদের
ডেকে পাঠালেন।
এদিকে গত কয়দিন যাবত
ছেলেরা তাদের গ্রামের পীরের মকতবের ছেলেদের কাছে নিজেদের বুদ্ধি
ও কায়দা-কৌশল জাহির করার জন্য কথায় কথায় জানিয়ে দিলো যে, তাদের ওস্তাদ অসুস্থ ছিলেন না, তারাই তাকে অসুস্থ বানিয়েছে ইত্যাদি। বিষয়টি মুখে
মুখে ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। অনেকে সবিস্তারে ঘটনা জানালো তাদের অন্যান্য
খেলার সাথীকে। আর ঐসব ছেলের মুখ থেকে তাদের মা বাবারাও বিষয়টি অবগত হলেন।
বিষয়টি কানাঘুষা হয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলো ওস্তাদের ঘরে তার স্ত্রীর
কানে। স্ত্রী বেচারী স্বামীকে জানালেন বিষয়টি। এবার ওস্তাদের টনক নড়লো। তিনিও
বুঝতে পারলেন তার অসুস্থ হওয়ার আসল রহস্য। দুষ্ট ছেলেদের তোষামোধ, একই কথার পূনরাবৃওি ও শয়তানী ফন্দীতেই
তিনি নিজেকে
অসুস্থ মনে করে বসলেন। আর শেষতক অযথা ওষুধ খেয়ে খেয়ে আসলেই রোগী হয়ে
গেলেন। বিষয়টি ওস্তাদ একেবারেই চেপে গেলেন। এরপর কোন কালে তিনি অসুস্থ হয়ে
পড়লেও মকতব বন্ধ করতেন না। মকতব খোলা থাকতো। বেশী অসুবিধা হলে আরেকজন ওস্তাদ
ডেকে এনে ক্লাশ চালু রাখতেন। ছেলেদের দুষ্ট বুদ্ধি তাদের ক্ষতিই ডেকে
আনলো। ওস্তাদকে ফাঁকি দেয়ার মজা তারা হাড়ে হাড়ে টের পেলো।
লেখকঃ মোঃ ফরিদ
উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল
উদ্দিন রুমির “মসনবী”
কাব্যগ্রন্থ থেকে
অনুবাদ কৃত।
No comments:
Post a Comment