Tuesday, November 27, 2018

লোকমান (আঃ) এর নুন খেয়ে গুন গাওয়া

হযরত লোকমান হাকিম ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ। তাঁর শরীরও ছিল কৃশকায়। তিনি সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন উপদেশ গ্রহন ও উপদেশ দানে। তার সময়ে জ্ঞানগরিমা, বুদ্ধিশুদ্ধি, সৎ কথা ও কাজে তিনি ছিলেন সবার সেরা। তিনি যে শহরে বাস করতেন সে শহরে তার খ্যাতি ছিলো প্রচুর। শুধু তাই নয়, তার গুনের কথা সকল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। লোকমান হাকিম এতোই সৎ ও জ্ঞানী ছিলেন যে, মানুষ তাকে পয়গম্বর বলে মনে করতো। 

লোকমান (আঃ) সম্পর্কে অনেক কাহিনী রয়েছে। তিনি তার ছেলেকে বলতেন, “প্রিয় পুত্র আমার, যখন খাবার খাবে তখন সবচেয়ে ভালো খাবার খেয়ো; যখন ঘুমুবে তখন সর্বোত্তম বিছানায় ঘুমিয়ো, যখন জীবন যাপন করবে তখন জীবনের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে মজার জিনিস উপভোগ করো; যেখানে যাবে ভালো ঘরে থেকো আর সেখানে বন্ধুবান্ধব নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করো।’’ 

লোকমান হাকিমের ছেলে জবাব দিলেনঃ বাবাজান, আপনি যা বলেছেন তা পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সর্বোত্তম খাদ্যসামগ্রী, সর্বোত্তম ও সবচেয়ে মজার দ্রব্যসামগ্রী লাভ করা তাদের জন্যই সম্ভব যাদের অনেক অনেক অর্থ বিত্ত আছে। তারাই ওসব সংগ্রহ করতে পারে। তারাই যেখানে ইচ্ছে ঘর বানাতে সক্ষম। আমার হাত তো প্রায় শুন্য।’’ 

হযরত লোকমান হাকিমঃ আসল কথাতো এখানেই। মানুষ মনে করে বেশী বেশী টাকা পয়সা থাকলেই হয়তো সবচে ভালো জিনিস কেনা যায়। কিন্তু ভুল এখানেই। বেশী টাকা পয়সার সাথে যদি বিবেক বুদ্ধি না থাকে তাহলে তা অনেক সমস্যা-সংকটের জন্ম দিয়ে থাকে। অনেক টাকা পয়সাওয়ালা লোক আরো টাকা উপার্জনের জন্য জীবনের বেশীর ভাগ সময়কেই দুঃখে কষ্টে কাটিয়ে দেয়। বেশী টাকা উপার্জনের সুখ আশায় জীবন তার বিষাক্তভাবে কাটতে থাকে। কিন্তু বেশী টাকা পয়সায় সুখ-শান্তি নেই, বরং আক্কেল বুদ্ধিতেই জীবনের শান্তি। সৌভাগ্য কেবল সুচিন্তায়। আমি বলছি না যে, তুমি সবচেয়ে মূল্যবান খাওয়া-দাওয়া ক্রয় করো, নরমতম বিছানাপত্রের ব্যবস্থা করো, সুন্দরতম নারী বিয়ে করো এবং সোনা, রুপা ও কাঁচের পাত ও ইট দিয়ে ঘর বানাও। বরং এ কথা বলছি যে, ভালো ভাবে ও সুষ্ঠু-সুচারুরুপে জীবন যাপন করো এবং জীবনেরে অর্থ বুঝে চলো। এর জন্যে যথেষ্ট হলো একটু দেরী করে খাদ্য খাওয়া যাতে পুরোপুরি ক্ষুধা সৃষ্টি হয়। তখন যে খাদ্যই খাবে তা সর্বোত্তম খাদ্যে পরিণত হবে। বেশী করে কাজ করো আর কম পরিমাণ ঘুমাও, তাহলেই সর্বোত্তম ও সবচেয়ে মজার ঘুম উপভোগ করতে পারবে। যদি তাই করো তাহলে এর অর্থ হবে তুমি যেন সর্বোত্তম বিছানায় ঘুমুলে। নিজেকে সব সময় ভোগ বিলাসে ব্যাস্ত রাখবে না, কঠিন পরিশ্রম ও কাজে ব্যস্ত থাকবে এবং অন্যদের দুঃখ-দুর্দশার কথা চিন্তা করবে। তাহলেই তোমার জীবনের যতোগুলো ভোগ ও মজা আসবে তা সর্বোত্তম হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তখন জীবন হবে তোমার কাছে মধুরতম ও প্রিয়তম। সৎ ও ভালো কাজ ও স্নেহ মায়া-মমতা দ্বারা মানুষের অন্তরে স্থান করে নাও। তাহলেই সর্বস্থানে তোমার সর্বোত্তম ঘর দেখতে পাবে। তখন সবার ঘরই তোমার জন্য প্রিয়তম ও সুন্দর ঘর হিসেবে খোলা থাকবে। 

হযরত লোকমান হাকিম (আঃ) থেকে এ ধরনের উপদেশমূলক ভালো ভালো কথা অনেক রয়েছে। লোকমান হাকিমের জীবনে অনেক স্মরণীয় ঘটনাও ঘটেছে। তেমনি একটি ঘটনায় একবার তাকে বন্দী হিসেবে আটক করা হয়। পরে তখনকার রেওয়াজ অনুসারে তাকে এক ধনী লোকের কাছে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হলো। মনিব এই ক্রীতদাসের কার্যকলাপ যতই পর্যবেক্ষণ করতে থাকে ততই তার মধ্যে বুদ্ধি, বিবেক, জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং ঈমান দেখতে পায়। শেষ পর্যন্ত লোকমান হাকিম তার মনিবের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও সন্মানিত হয়ে ওঠেন। 

দেখতে দেখতে মালিক লোকমান হাকিমকে আপন সন্তান ও ভাইবেরাদরের মতো ভালোবাসতে শুরু করলো এবং তাকে নিজের সহকর্মী, সহচর ও সুহৃদ হিসেবে গণ্য করলো। 

মনিব সবসময় চেষ্টা করতো লোকমান হাকিমের ইজ্জত-সন্মান যে কোন অবস্থায় বজায় রাখতে। খাওয়ার পাটিতে সর্বোত্তম খাওয়া দিয়ে লোকমানের (আঃ) আপ্যায়ন করতো এবং যে কোন উত্তম জিনিস লোকমানকে (আঃ) দেওয়ার চেষ্টা করতো। 

একদিনের ঘটনা। তখন খুরবুজা” (তরমুজ জাতীয় ফল) ওঠার সময় হয়ে আসছে। মনিবের জমি থেকে নতুন কাটা একটি খুরবুজাঘরে আনা হলো মনিবের জন্য। মনিব চাকু নিয়ে নিজ হাতেই খুরবুজার একটি ফালি কাটলো এবং নিজে না খেয়ে লোকমানকে (আঃ) খেতে অনুরোধ জানালো। লোকমান (আঃ) শেষ পর্যন্ত ফালিটি নিয়ে খেলেন। তার চেহারা দেখে মনে হলো খুরবুজাটি বেশ মজা ও সুস্বাদু। মালিক খুব খুশি হলেন এতে। আবারো এক টুকরা কেটে লোকমানকে (আঃ) খেতে দিলেন। লোকমান (আঃ) খুব আদবের সাথে মনিবের অনুরোধ রাখলেন এবং খুব তৃপ্তির সাথে খেলেন। হযরত লোকমান হাকিমের তৃপ্তি দেখে মালিক আরো খুশি হলেন এবং প্রিয়জনকে আরো তৃপ্ত করার জন্য আরেক ফালি খুরবুজা কেটে দিলেন। লোকমানও (আঃ) খেলেন। এভাবে মনিব দিতেই থাকলেন আর হযরত লোকমান হাকিম পরম আনন্দের সাথে খেয়েই চললেন। আর মাত্র এক টুকরা বাকি রইলো। মনিব মনে মনে বললেন, “এবার আমার পালা। ক্ষেতের নতুন খুরবুজার স্বাদ নেয়া উচিত।এই বলে খুরবুজার টুকরায় কামড় দিতেই তার মুখ আড়ষ্ট হয়ে এলো। মনিবের বুঝতে বাকি রইলো না যে খুরবুজাটি দোষী ও অতিমাত্রায় তিতা। খুরবুজার তিতায় মনিবের মুখ ও জিহবা একেবারে তেতো হয়ে গেলো। বেচারা চরম বিরক্ত হয়ে তাড়াতাড়ি পানি এনে মুখ ভালো করে ধুয়ে ফেললো। এরপর লোকমানকে (আঃ) লক্ষ্য করে বললো, “বন্ধু আমার! এতো তিতাও খুরবুজা হতে পারে! আমিতো বুঝতে পারিনি যে এতো খারাপ এটি। কিন্তু তুমি সেই প্রথম থেকে কেনো টু শব্দটিও করলে না? এতো বিচক্ষণতা ও জ্ঞান দেখানো কি সহজ ব্যাপার? কি প্রয়োজন ছিলো এ তিতা খুরবুজা এভাবে খাওয়ার?” 

হযরত লোকমান হাকিম (আঃ) জবাব দিলেন, “খুরবুজা অবশ্যই তিতা ছিলো। কিন্তু আমি দীর্ঘদিন যাবত তোমার হাতে শুধু মজাই খেয়ে আসলাম। তাই কোনমতেই তোমাকে বুঝাতে চাইনি যে খুরবুজাটি ভীষন তিতা। তুমি আমাকে ইজ্জত-সন্মান করে এসেছো, আমি তোমাকে ইজ্জত-সন্মান করার চেষ্টা করেছি। আমি মানুষকে সবসময় উপদেশ দিয়ে এসেছি, তারা যেনো মানুষের ভালো কাজ ও আচরণকে সব সময় ভালো ভাবেই মুল্য দেয়, নিমক হালাল যেনো হয়। আজ কি করে আমি নিজেই তোমার এতসব ভালো কাজের জায়গায় একটিবারের বেমজার জন্য নেমক হারামী করতে পারি? আহ! কতোইনা উত্তম হতো যদি খুরবুজার শেষ টুকরাটিও আমাকে দিয়ে দিতে আর আমার প্রতি স্বীয় ভালবাসার জন্য পরিতৃপ্ত থাকতে! যেমনি করে আমিও তোমার মহিমা ও সদাচরণের জন্য তোমার ওপর সন্তুষ্ট ও রাজী আছি তুমিও তেমনি রাজী থাকতে পারতে! 

লেখকঃ মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির মসনবীকাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।

No comments:

Post a Comment