সে অনেক আগের কথা। হিন্দুস্তান থেকে একদল
লােক একটি হাতি নিয়ে বের হলাে বিদেশ সফরে। যে সব দেশের মানুষ হাতি দেখেনি
সেসব দেশে তারা হাতির খেলা দেখাতাে আর এভাবে অনেক টাকা-পয়সা রােজগার
করতাে।
একদিন এ হিন্দুস্তানীরা এক শহরে গিয়ে পৌঁছলাে এবং রাত হয়ে
যাওয়ায় তারা একটি বাড়ি ভাড়া করে সেখানে অবস্থান নিলাে। এদিকে শহরগামী
কোন কোন লােক পথিমধ্যেই এই হাতি দেখে আসে। তারা জানতাে যে, পরদিন তাদের
শহরে হাতির খেলা হবে। তারা শহরে নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে যাদের সাথে দেখা
হলাে তাদের এ খবরটি দিতে ভুলে গেলাে না। কথাটি ঐ রাতেই সারা শহরে মুখ থেকে
মুখে ছড়িয়ে পড়লাে। শহরবাসীদের বেশীর ভাগই ভাবলাে, ঠিক আছে, পরদিন হাতির
খেলা শুরু হলে যাবাে সেখানে, হিন্দুস্তানী হাতি কেমন দেখবাে। কিন্তু এমন
অনেকে ছিলাে যাদের আর তর সইছিলাে না। তারা অন্যদের আগেই হাতি দেখে নিতে
অধীর হয়ে ওঠে। তাদের কথা হলাে সবার আগে হাতি দেখতে পেলে অন্যদের সাথে এ
নিয়ে গর্ব করতে পারবে যে, আমরা তােমাদের আগেই হাতি দেখে ফেলেছি। হাতি
দেখতে এরকম ওরকম ইত্যাদি। এতে করে শহরে তাদের নাম ডাক বেড়ে যাবে, তারা
অসাধারণ ও অভিজ্ঞ বলে প্রমাণিত হবে। ব্যস আর কোন কথা নেই, ওরকম কয়েকজন দল
বেধে ঐ রাতেই রওয়ানা হলাে হিন্দুস্তানীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়িতে
পৌঁছেই বুঝতে পারলাে যে, খবর ঠিকই আছে। তারা হাতির মালিকদের গিয়ে বললাে,
আমাদের হাতি দেখাও, আমরা এ রাতেই হাতি দেখবাে। মালিকরা বললাে, আমরা সবে
মাত্র এসে পৌঁছেছি, খুবই ক্লান্ত, খেলার কোন ব্যবস্থা এখনাে করা হয়নি।
তােমরা বরং আগামীকাল ভােরে আস। কিন্তু লােকগুলাে অস্থির চিত্ত; তারা বললাে,
অসম্ভব, আমরা হাতি না দেখে যাচ্ছি না। আমরা হাতি খুব ভালবাসি, আমরা হাতির
খেলা খুব পছন্দ করি, আজ রাতেই আমরা হাতি দেখবাে।
হাতির মালিকরা
বললেন, তা কেমন করে হবে? এখন অন্ধকার রাত, হাতির ঘরে কোন বাতি নেই। এতাে
অন্ধকারে কিছুই দেখা যাবে না। লােকগুলাে একেবারেই নাছােড়বান্দা। তারা
বললাে, আমরা অন্ধকারেই হাতি দেখবাে, আলাের প্রয়ােজন নেই। এখন হাতি না দেখে
ফিরে গেলে আমাদের সারারাত ঘুমই হবে না। আমরা অন্য সবার আগেই হাতি দেখে
ফেলতে চাই। হাতির মালিকরা বললাে, ঠিক আছে, এতই যখন তােমাদের তাড়াহুড়া
তাহলে অন্ধকারেই হাতি দেখাবাে। তবে হাতি দেখার জন্য কিন্তু প্রথম রাতে বেশী
টাকা দিতে হবে। রাতের জন্য দিনের দ্বিগুণ টাকা লাগবে। এ ছাড়া হাতি দেখা
যাবে না।
অতি আগ্রহীরা হিন্দুস্তানীদের কথা লুফে নিয়ে বললাে, আরে
বাপু টাকা পয়সার কোন চিন্তা নেই। এই নাও তিনগুণ বেশী টাকা রাখাে। আসো হাতি
দেখাও। মালিকেরা বললাে, হাতি খুবই ক্লান্ত। তাই এক মিনিটের বেশী কিন্তু
সময় দেবাে না। এক মিনিটেই দেখা শেষ করতে হবে।
নাছােড়বান্দা
লােকেরা বলল, আরে বাবারা, ওই এক মিনিটই দেখাও। তাই আমাদের জন্য শত মিনিট।
হাতি আমাদের লাথি দিলেও রাজি। মােট কথা হাতি এখনি দেখতে চাই। হয় হাতি নয়
মরণ।
বাধ্য হয়ে হিন্দুস্তানীরা লােকদের থেকে টাকা পয়সা গুণে নিলাে
এবং হাতির মাহুত তাদের নিয়ে গেলো হাতির ঘরে। তবে একজন লােক দাঁড়িয়ে
রইলাে। সে গেলাে না। হিন্দুস্তানীরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলাে, তুমি যাচ্ছাে না
কেনো?
লােকটি বললােঃ আমি বইয়ে পড়েছি যে, হাতি এক বিরাট প্রাণী।
তাই আমিও সবার আগে হাতি দেখতে আগ্রহী। কিন্তু আমি রাতকানা মানুষ। রাতের
আধারে কিছুই দেখি না। তােমাদের প্রতি আমার অনুরােধ ওই এক মিনিট সময় আমাকে
বুঝিয়ে দাও হাতি কি রকম ও কি কি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তােমরা তাে হাতি
বিশেষজ্ঞ। হাতির মালিকদের একজন বলে ওঠলাে, মাশাল্লাহ, মনে হচ্ছে তুমি
কিছুটা বুদ্ধিমান। কোন কিছু বুঝার পথই হচ্ছে ঐ বিষয়ে যারা অভিজ্ঞ তাদের
কাছ থেকে জেনে নেয়া। বই পড়ে আর বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে ভালাে করে শিখলেই
মানুষ কোন বিষয়ে পুরাে জ্ঞান লাভ করতে পারে।
হাতির একজন মাহুত
বললাে, হাতি ঘােড়া বা উটের মতােই একটি প্রাণী। তবে তার দেহ বিশাল এবং ওজনে
ভারী। অন্যান্য প্রাণীর ঘাড় আছে। হাতির ঘাড় নেই। তার মাথা শরীরের সাথেই
সংযুক্ত। তার মুখও তার চেহারার নিম্নভাগে। ঘাড় না থাকার ফলে মুখ মাটিতে
পৌঁছাতে পারে না, তাই ঘাস মুখ দিয়ে ছিড়ে খেতে পারে না। তবে এ জন্যে তার
একটি লম্বা শুড় আছে। হাতির শুড় দেখতে লম্বা রাবারের পাইপের মতাে। হাতির
শুড় নাকের কাজও করে। শুড় দিয়ে হাতি পানি টেনে নেয় শরীরে, খাদ্য সামগ্রী
পেচিয়ে ধরে মুখে পুড়ে দেয়। হাতির দুটো লম্বা দাঁতও আছে। কোন কোন সময়
এগুলাের দৈর্ঘ্য প্রায় এক গজও হয়ে থাকে। হাতির দাঁতের দাম হাতির দামেরই
সমান। তা অনেক কাজে লাগে। হাতি অনেক শক্তিশালী। তার ওপর অনেকেই একসাথে
চড়তে পারে। হাতির পিঠে চড়ে দীর্ঘ দুর্গম পথও ভ্রমণ করা আরামদায়ক। হাতির
পিঠে ছােট ঘর বেধে তাতে যাত্রীরা চড়ে বসে। হাতি সাধারণতঃ গরম প্রধান দেশের
জঙ্গলে পাওয়া যায়। ..........
এর ভেতরই এক মিনিট সময় পার হয়ে
গেলো এবং লােকজন হাতি দেখে ফিরে এলাে। এরা হাতির ঘরে গিয়ে অন্ধকারে কিছুই
দেখতে পাচ্ছিল না। শেষে চোখ কচলে ও হাতড়ে হাতড়ে হাতি পর্যন্ত পৌঁছে
যায়। তারা হাতির গায়ে হাত বুলাতে পেরেই হাতি দেখার পরম স্বাদ পেয়ে গেলাে
এবং গর্বে তাদের বুক ফুলে ওঠলাে। তবে আগে যেহেতু হাতি দেখেনি সেহেতু হাতির
যে অংশে যার হাত লেগেছে সেই অংশকেই সে হাতি বলে বুঝে নিলাে। কেউ হাতির
শুড়ে হাত বুলালাে, কেউ হাতির দাঁতে, কেউ বা হাতির সামনের অংশে, কেউ আবার
হাতির পায়ে হাতের ছোঁয়া লাগালাে। এভাবে এক মিনিট কাল দ্রুত পার হয়ে
গেলাে। তারা মাহুতের ডাকে হাতি ঘর থেকে উল্লসিত মনে বের হয়ে এলাে। এরপর দল
বেধে রওয়ানা হলো বাড়ির দিকে। রাস্তার শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেখতে পেলাে
এক দল জনতা। তারা এক বিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। প্রত্যেকেই সেখানে তার
চেনাশুনা লােককে খুঁজে পেলাে। ব্যস, আর যায় কোথায়! শুরু করলাে সবার আগে
তাদের হাতি দেখার গৌরব ও বাহাদুরীর আলাপ। তারা কিভাবে আজ রাতেই হাতি দেখে
ফেললো তার বিবরণ দিতে লাগলাে। শ্রোতারা অতি আগ্রহের সাথে বললাে, আশ্চর্যের
কথা! হাতি আসতে না আসতেই তােমরা দেখে ফেলেছাে? বলো দিকিন হাতি দেখতে কেমন?
শ্রোতাদের আগ্রহ দেখে বক্তারা হাতি বিশেষজ্ঞ হওয়ার ভান করে যে যেভাবে
হাতিকে মনে করেছে সে কথাই বলা শুরু করলাে। যে হাতির শুড়ে হাত বুলিয়েছিলাে
সে বললাে, সত্যি হাতি এক আজব জীব। একটি লম্বা প্রাণী, অজগর সাপের মতাে
যেনাে গাছ থেকে ঝুলে আছে নীচের দিকে। সােজা হয়, বাকা হয়, গােল হয়,
পাইপের মতাে হয়, আবার নড়াচড়াও করে। মােট কথা এক ভয়ঙ্কর প্রাণী এই হাতি।
আমি তাে ভয়ে অস্থির। চলে এলাম দ্রুত।
যে ব্যক্তি হাতির পায়ে হাত
বুলিয়েছিলাে সে বললাে, হাতি নিয়ে যে যত কথাই বলুক না কেনাে হাতি সে রকম
কিছু নয়। হাতি হলাে এমন দুইটি থামের মতাে যা কিছু ওপরের দিকে গিয়ে পরস্পর
মিলিত হয়েছে। দুইটি শক্তিশালী ও মজবুত থাম। তবে সব সময়ই নড়াচড়া ও
ওঠানামা করে এই হাতি। যদি তােমার পা হাতির নীচে চলে যায় তাহলে একেবারে
'কিমা’ হয়ে যাবে।
যারা হাতির পেট ও পিঠ ধরেছিলাে তারা বললাে, হাতি
আসলে একটি বড় উঁচু খাটের মতাে। চারটি পায়ের ওপর বিরাট একটি ছাদের মতাে
শরীর দাঁড়িয়ে আছে। এই ছাদের ওপরই মানুষ আরােহণ করে। যারা হাতির দাঁত
ছুঁয়েছে তারা বললাে, হাতি তলােয়ারের মতাে। পাশাপাশি দুটি তলােয়ার নাঙ্গা
অবস্থায় বের হয়ে আছে। তবে তাতে ধার নেই। হাতির লেজ যে স্পর্শ করেছে সে
বললাে, হাতি দেখতে অনেকটা চাবুকের মতাে৷ বিরাট এক স্থানে বাধা এই চাবুক।
বেশ নড়াচড়া করে।
এসব বিবরণ শুনে সে রাতে যারা হাতি দেখার সৌভাগ্য
অর্জন করতে পারেনি তাদের আর দুঃখের শেষ রইলাে না। তাদের আক্ষেপ ছিলাে যে
কেনো তারা আজ রাতেই হাতি দেখতে গেলাে না।
ইতিমধ্যে যে ব্যক্তি হাতির
ঘরে প্রবেশ করেনি সে প্রত্যক্ষদর্শীদের এসব বিবরণ মনােযােগ দিয়ে শুনার পর
আর নিজেকে সামলাতে পারলাে না। সে সবাইকে ডেকে বললাে, এরা হাতি সম্পর্কে যা
বলেছে তার কোনটাই ঠিক নয়। আমি ওদের চেয়ে ভালাে করে হাতি সম্পর্কে জ্ঞান
লাভ করেছি।
জনতা তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলোঃ তুমিও কি হাতি দেখেছাে?
সে জবাব দিলােঃ না, আমি নিজ চোখে দেখিনি। তবে বইয়ে পড়েছিলাম যে হাতি
বিশালদেহী একটি প্রাণী। ওরা যখন অন্ধকারে হাতির ঘরে হাতি দেখতে যায় তখন
আমি রাতকানা বলে তাদের সাথে না গিয়ে হাতির মালিক ও মাহুতদের সাথে
কথাবার্তা বলে হাতি সম্পর্কে অনেক তথ্য জেনে নেই। এখন বুঝতে পারছি যে আমার
বন্ধুরা প্রত্যেকে অন্ধকারে হাতির শরীরের যে অংশ স্পর্শ করেছে সে সেই
অংশকেই হাতি বলে মনে করেছে। আসলে হাতি এরকম ...........।
তার
বিস্তারিত বিবরণ শুনে অতি উৎসাহীদের কেউ আর কোন কথা বললাে না, চুপ হয়ে
গেলাে। পরদিন যখন হাতির খেলা হলাে তখন সবাই হাতি দেখে সাক্ষ্য দিলাে যে,
বইপত্র পড়াশুনা করে ও অভিজ্ঞ লােকদের নিকট থেকে শুনে যে ব্যক্তি হাতির
বর্ণনা দিয়েছিলাে তার কথাই ঠিক। কিন্তু যারা তড়িগড়ি করে হাতির গায়ে হাত
বুলিয়ে এসে হাতি সম্পর্কে বলেছিলাে পরদিন হাতি দেখে তারা নিজেরাই হেসে
ফেললাে নিজেদের বােকামী ও অজ্ঞতার জন্য। তবে তারা বুঝতে পারলাে যে অন্ধকারে
হাতি দেখা যায় না। দেখলে অবাস্তব ও আংশিক কিছু দেখা যায়। এভাবে দেখে কোন
কিছু সম্পর্কে কোন কথা বলা ঠিক নয়।
লেখকঃ মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী” কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।
No comments:
Post a Comment