একবার সওদাগর বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে হিন্দুস্তান যাওয়া ঠিক করলো। সফরের সব ব্যবস্থা হয়ে গেলে সওদাগর আপন লোকজন ও দাস-দাসীদের ডেকে বললোঃ
“তোমাদের কার জন্য কি উপহার আনবো বলো।”
সওদাগরের কথায় সবাই নিজ নিজ দাবী পেশ করলো। কেউ বললো কাশ্মিরী শালের কথা,
কেউ ময়ূরের পাখা,
কেউ হাতির দাঁতের চিরুনী,
আবার কেউ দারুচিনি,
লং, এলাচী, আদা, মরিচ প্রভৃতিও আবদার করলো।
সওদাগর একে একে সবার কথাই টুকে নিলেন। সবশেষে গেলেন তার আদরের তোতার কাছে,
বললোঃ “হিন্দুস্তান থেকে তুই কি চাস?”
তোতা বললোঃ আমি কেবল তোমার কল্যাণ ও সুস্বাস্থ্য চাই। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। তবে শুনেছি হিন্দুস্তানে অনেক অনেক তোতাপাখির বসবাস। আমার আবদার হলো,
হিন্দুস্তানে যখন পৌঁছুবে এবং সবুজ শ্যামল বন-জঙ্গল চোখে পড়বে তখন দেখতে পাবে যে হিন্দুস্তানী তোতারা মনের আনন্দে নেচে গেয়ে উড়াউড়ি করছে। তাদের আমার সালাম জানাবে এবং বলবে আমার পোষা তোতাটি তোমাদের কাছ থেকে উপদেশ চেয়েছে এবং এ বাণী পাঠিয়েছে যে,
“বন্ধুত্বেরও জাতিভাই হওয়ার শর্ত হলো এই যে,
আমার কথাও তোমরা স্মরণ করবে। আমিও তোমাদের মতো খুশী ও আনন্দিত হতে চাই।”
এসব কেমন হতে পারে থাকবো বাধা শিকল পায়
সবুজ বনে তোমরা রবে সুখ করিবে গাছের ছায়?
সবুজ বনে তোমরা রবে সুখ করিবে গাছের ছায়?
ব্যস,
এটাই আমার পয়গাম। তাদের জবাব আমার জন্য নিয়ে আসবে। আমি আর কিছু চাইনে।”
সওদাগর তোতার আবদার রক্ষারও ওয়াদা করলো এবং তার বাণী খাতায় নোট করে নিলো।
সওদাগর ভারতে পৌঁছেই তার ব্যবসা-বাণিজ্যে লেগে গেলো। একদিন অবসর পেয়ে ঘোড়ায় চড়ে বনের ভেতর দিয়ে বেড়াতে বের হলো। এক জায়গায় খুব সুন্দর এক ঝাঁক তোতাপাখি দেখতে পেলো। ওরা গাছের ডালে মনেরে সুখে গান গেয়ে চলেছে আর এ ডাল থেকে ও ডাল উড়াউড়ি করছে। তোতাদের এ দৃশ্য দেখে সওদাগরের মনে পড়লো তার তোতার কথা। ঘোড়া থামিয়ে তোতাদের ডেকে তার পোষা পাখিটির বাণী শুনালো এবং জিজ্ঞেস করলোঃ
“তোমাদের কোন কথা থাকলে আমাকে বলো আমি তার কাছে পৌঁছাবো।”
সওদাগরের কথা শেষ হতে না হতেই তোতা পাখিদের এক সঙ্গীর গায়ে ভীষ্ণ কাঁপন ধরলো এবং ধপাস করে গাছের ডাল থেকে মাটিতে পড়ে নীরব নিথর হয়ে গেলো। অন্যান্যরা একেবারে নীরব নিশ্চুপ,
কোন জবাব দিলো না।
সওদাগর অবাক হয়ে গেলো। কিন্তু তার তোতার জন্য যে বাণী নিয়ে যেতে হবে। তাই আবারো বললোঃ
“হে তোতা পাখির দল!
আমার তোতাটিও তোমাদেরই জাতি ভাই,
সে তোমাদের জবাবের আশায় অপেক্ষা করছে,
তাকে একটা জবাব দাও।”
এ কথার পর আরেকটি তোতা কেঁপে ঊঠলো এবং গাছ থেকে পড়ে গেলো। অন্যসব তোতারা চুপচাপ,
কিছুই বললো না।
সওদাগর তোতা দু’টির এরকম অবস্থায় থতমত খেয়ে গেলো এবং মনে মনে বেশ দুঃখ পেলো। তোতা দু’টির এরকম মৃত্যুতে সওদাগর নিজেকে দোষী মনে করে অনুতাপ করতে লাগলো আর নিজে নিজেই বলতে লাগলো,
“কি খারাপ কাজই না করেছি। আমার তোতার দুঃখের কাহিনী,
বিরহ-ব্যথা তাদের বলাতেই এরকম হলো। কতো সুন্দর তোতা দু’টো
বন্ধুর দুঃখে মারা গেলো। আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনে,
হয়তো বা আমার তোতাটি ওদের আত্নীয়স্বজন হতে পারে। তার কথা তাদের স্মরণ হতেই বিরহ বেদনায় মারা গেলো,
তার দুঃখে তোতারা সব কথা বলাই ভুলে গেলো। হায় হায়।”
যাক যা হবার তাতো হলোই। সওদাগর বহু দুঃখ নিয়ে সেখান থেকে ঘোড়া হাঁকিয়ে চলে গেলো নিজ পথে। এরপর সওদাগর অনেকবারই তোতাপাখিদের ঝাঁক দেখেছে,
কিন্তু তার তোতার বাণী তাদের আর শুনায়নি,
চেপে গেছে। নিজের কাজে,
বেচাকেনায় মন দিলো। এ সফরে সওদাগরের অনেক লাভ হলো। এবার দেশে ফেরার পালা। যার যার আবদার অনুসারে উপহার উপঢৌকন কিনে ফিরে এলো নিজ দেশে। সওদাগর বাড়ি ফিরলে সবাই আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠলো। সওদাগরও প্রত্যেককে সুন্দর সুন্দর উপহার দিয়ে আরো খুশি করলো।
এদিকে সওদাগরের পিঞ্জরাবদ্ধ তোতা অপেক্ষা করতে লাগলো মনিবের। মনিব কিন্তু তোতাকে এড়িয়ে চলতে লাগলো। একদিন মনিবকে দেখতে পেয়েই তোতা জিজ্ঞেস করলোঃ
“হে দোস্ত আমার!
সবার জন্যেই তো উপহার উপঢৌকন এনেছো,
আমার সংবাদ কই?
হিন্দুস্তানী তোতাদের সাথে দেখা হয়েছে কি?
তারা আমার পয়গাম শুনে কি জবাব দিলো?”
সওদাগরঃ
“প্রিয় তোতা আমার,
তোর বাণী তাদের শুনিয়েছি আর এ কাজের দরুন নিজেই দুঃখিত ও অনুতপ্ত হয়েছি। যদি আগে জানতে পারতাম যে ঐ রকম হবে তাহলে তোর বাণী তাদের মোটেও পৌঁছাতাম না। আমার কথা শুনে ওরা দারুণ কষ্ট পেলো এবং কোন কথাই বললো না।”
তোতাঃ “এটা হতেই পারে না। আমি তোতাদের চিনি। অসম্ভব যে তারা কোন জবাব পাঠাবে না। তোতারা মানুষের চেয়ে অনেক ভালো এবং বন্ধুপ্রিয়। আমার বাণী তাদের কাছে যদি পৌঁছে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই তারা জবাব দেবে।”
সওদাগরঃ
“আরে বাপু যা বললাম তাই,
এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। ওদের কথা আর না বলাই ভালো। ওসব শোনা ছেড়ে দিয়ে যা চাইবি তোকে সবই দেবো।”
তোতাঃ
“আমি কিছু চাইনে। শুধু জানতে চাই তোতারা আমার পয়গাম শোনার পর কি বলেছে ও কি করেছে,
ব্যস।”
সওদাগরঃ
“এতোই যখন নাছোড়বান্দা তবে শোন্,
হিন্দুস্তানী তোতারা তোর কথা শুনে টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। তবে তোর অবস্থা ও বাণী এবং কবিতা শুনানোর পর তোতাদের একটির অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো। তার সারা শরীর কেঁপে উঠতেই গাছের শাখা থেকে পড়ে গেলো মাটিতে,
আর কোন নড়াচড়া নেই,
শেষ। তোতাদের কোন জবাব না শুনে আবারো তোর কাহিনী বললাম ও জবাব চাইলাম। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার আবারো ঘটলো। আরেকটি তোতা বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো,
কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। ঝাঁকের অন্য তোতারাও নিশ্চুপ ছিলো। ওদের কোন জবাব না পেয়ে এবং তোতা দু’টির অবস্থা দেখে খুবই দুঃখিত হলাম। কেননা আমার এ কাজের দরুন দুটো তোতাই মারা গেলো। আমিতো কিছুই জানিনে,
হয়তো বা ঐ ঝাঁকের তোতারা তোর আত্নীয়-স্বজন ছিলো,
হয়তো অন্যকিছু। তবে এতা সত্য যে,
ওরা কিছুই বলেনি,
অন্ততঃ আমিতো কিছুই বুঝিনি।”
সওদাগর এ পর্যন্ত বলতেই তোতা পাখি তার স্বজাতীয়দের কার্যকলাপ বুঝতে পারলো এবং হঠাৎ এক বিকট চিৎকার করে খাঁচার ভেতর কাঁপতে শুরু করলো ও বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলো।
সওদাগর এ দৃশ্য দেখে অতিমাত্রায় দুঃখিত হলো। বুঝতেই পারলোনা যে কিসে কি ঘটে গেলো। সওদাগর তোতার খাঁচা নাড়াচাড়া করে দেখলো তোতা নিষ্প্রাণ,
মরে গেছে। মনের দুঃখে মাথা চাপড়াতে লাগলো। আর কি,
তোতাতো শেষই হয়ে গেলো।
সওদাগর খাঁচার দরজা খুলে নিষ্প্রাণ তোতাকে বের করে আনলো আর আক্ষেপ করতে করতে পার্শ্ববর্তী ঝোপঝাডের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তোতার বাণী পৌছানো ও তার এহেন ফলাফলে সওদাগরের মন ভীষণ খারাফ হয়ে গেলো। শুধু আফসোস করা ছাড়া করার আর কিছুই পেলো না।
এদিকে কিন্তু ঘটে গেলো আরেক আজব ব্যাপার। তোতাকে ঝোপঝাড়ের ওপর ঢিল মেরে ফেলে দিতেই দেখা গেলো তোতা তার পাখা ঝাপটা মেরে উড়া শুরু করলো এবং উঁচু গাছের ডালে গিয়ে বসলো।
সওদাগর তোতার এ অবস্থা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। মাথা তুলে ওপরে তোতার দিকে তাকিয়ে বললোঃ এ্যাঁ!
ব্যাপার কি?
এ আবার কি দেখতে পাচ্ছি?
এ রকম কেনো হলো?
বেশ ভালো কথা,
এখন তো গাছের ডালে হাতের নাগালের বাইরে আছিস এবং যে কোন সময় পাখা মেলে উড়তে পারবি। কিন্তু আমি জানতে চাই এ ফাঁকি ও ফন্দি কোথেকে শিখলি?
আমি তোকে হিন্দুস্তানি তোতাদের কাহিনী সত্যাসত্য বলেছি,
তাই তোরও উচিত এখন সত্য জবাব দেয়া।
তোতাঃ ঠিক আছে,
তাহলে শোনো। তোমরা মানুষের জাত উপদেশ নসিহত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো না। এতোসব কথাবার্তা যে শুনে থাকো,
এতোসব বইপত্র যে পড়ো তার থেকেও কোন উপকার গ্রহণ করোনা। কিন্তু আমরা তোতা পাখিরা কথার চেয়ে কাজকেই ভালো বুঝি এবং এ থেকে ফায়দা গ্রহণ করি। তবে তুমি যেহেতু ভালো মানুষ এবং আমার পয়গাম ঠিকমতো পৌঁছিয়েছো ও ঠিকমতো জবাব এনেছো সেহেতু তোমাকে সত্য কথাই বলবো। আমি তোতাদের কাছে আমার বাণীতে আমার বন্দী জীবনের দুক্ষ-দুর্দশার কথা জানিয়ে তাদের কাছ থেকে মুক্তির উপায় জানতে চেয়েছিলাম। হিন্দুস্তানি তোতারা আমাকে কাজের মাধ্যমে দুটি শিক্ষা দিয়েছে। প্রথমতঃ বন্ধীত্বের জন্য দায়ী আমার মুখের সুমধুর ভাষা,
আর এ থেকে মুক্তির উপায় নীরব নিশ্চুপ হওয়া। দ্বিতীয়তঃ দুটি তোতার মৃত্যুই ছিলো সর্বোত্তম শিক্ষা। তারা আসলে মরেনি,
মৃত্যুর অভিনয় করেছে। তারা আমাকে বুঝাতে চেয়েছে যে,
যদি তুমি খাদ্যশস্যের মতো লোভনীয় হও তাহলে অন্যসব পাখি তোমাকে খেয়ে ফেলবে আর যদি আদুরে পাখি হও তাহলে শীকারীরা তোমাকে শিকার করবে। তাই এখন যেহেতু তোমার থাবাও নেই,
ধারালো দাঁতও নেই বরং শিকল ও খাঁচায় বন্দী হয়ে আছো সেহেতু তোমার একমাত্র পথ হলো তোমাকে অকেজো অপদার্থ হতে হবে। উপকারহীন হতে হবে,
কথাবার্তা বন্ধ করে বেহুঁশ হয়ে খাঁচার ভেতর পড়ে যাবে এবং কোনপ্রকার নড়াচড়া করবে না। এতে করে তোমার ওপর কারো লোভ-লালসা থাকবেনা। তখনি তোমার মুক্তির দরজা খুলে যাবে। ময়ূর তার সৌন্দর্যের কারণেই বন্দী হয়,
তোতাপাখি বাধা পড়ে তার সৌন্দর্য ও মধুর ভাষার জন্য। হ্যাঁ,
আসলেই আমার মিষ্ট কথা আমার জানের শত্রুতে পরিণত হয়েছিলো। হিন্দুস্তানী তোতারা আমাকে বলেছিলোঃ অবশ্যই নীরব নিথর হবে এবং একেবারে প্রাণহীন স্পন্দনহীন হয়ে পড়বে। তবেই পুনরায় যিন্দা হতে পারবে ও মুক্তি পাবে। এই কার্যকরী শিক্ষাই তারা আমাকে দিয়েছে। এখন নিজেই তো দেখতে পেলে আমি তাদের উপদেশ পালন করেছি আর মুক্তি পেয়েছি। তোতাপাখি একথা বলেই পাখা মেললো মুক্ত সীমাহীন আকাশে।
লেখকঃ মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান
(সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী” কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী” কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।
No comments:
Post a Comment