সে
যাক, একদিন
দুপুরে হযরত সুলায়মান আলাইহেস সালাম তার শাহী দরবারে বসে আছেন। এমন সময় এক লোক দন্তদন্ত হয়ে ছুটে
এলো সেখানে এবং আল্লাহর নবীকে দেখেই পড়ে গেলো তার পায়ে। আর কোন কথা
নেই, জুড়ে
দিলো হাউমাউ কান্না। ভয়ে তার সারা শরীর কাঁপছে। হযরত সুলায়মান
তার এরকম অবস্থা দেখে বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন, হয়েছে কি তোমার? এমন করছ কেনো? বলো কি চাও?
আগন্তুক
বহু কষ্টে
নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, হে
আল্লাহর নবী, হে
মহামহিম বাদশাহ! আমাকে আজরাইলের হাত থেকে বাঁচান। আজ আমি আজরাইলকে
দেখেছি। আমার দিকে ভীষণ ক্রোধের দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। আমাকে ভয় দেখিয়ে পাশ
কেটে চলে গেলো। আমার ভয় হচ্ছে আজরাইল ফিরে আসবে এবং আমার জান কবজ করে
নেবে।
হযরত
সুলায়মান পয়গম্বর অভয় দিয়ে বললেন, বেশ ভালো কথা। এতে ভয়ের কি আছে। আজরাইল
হচ্ছেন আল্লাহর একজন মহান ফেরেশতা। তিনি কেবল আল্লাহর
হুকুমেই জান কবজ করেন। আল্লাহ হুকুম না করলে এই ফেরেশতা কক্ষনো কারো ক্ষতি
করেন না, জানও
কবজ করেন না। আমিতো প্রায় প্রতিদিনই আজরাইলকে দেখে থাকি।
কিন্তু কই আমিতো ভয় পাইনে। ভয়ের কিছুই নেই। এখন বলো তোমার জন্য আমি কি করতে
পারি, তুমিই
বা কি চাও?
লোকটি বললো,
না না, আমি সব সময়ই আজরাইলকে ডরাই। কিন্তু আজ
তার রাগ দেখে আরো ভয় করছে। আমি তার হাত থেকে বাঁচতে চাই।
লোকেরা বলে থাকে বায়ু সুলায়মান নবীর হুকুম পালন করে। এখন আপনি বায়ুকে হুকুম
করুন আমাকে এ দেশ থেকে দূরে নিয়ে যাক। মানুষ একথাও বলে থাকে যে, সুলায়মান বাদশাহ মানুষের চাওয়া পাওয়া
পূরণ করে
থাকেন। এখন আমার দাবী হলো, বাতাসকে
এক্ষুনি হুকুম দিন আমাকে হিন্দুস্তান নামক দেশে নিয়ে যাক। আমি
চাই আজরাইল যেহেতু এদেশে আমার ঠিকানা জেনে গেছে সেহেতু এদেশে আর থাকবোনা। এই
আমার দাবী, আপনি
দয়া করে আমার আরজু মিটান। আমি মরতে চাইনে, আমি আজরাইলের থাবায় পড়তে চাইনে।
হযরত সুলায়মান
(আঃ) বেচারার কাকুতি-মিনতি ও কান্নাকাটি দেখে বললেন, বেশ ভালো কথা। জীবন-মরণের ভার আমার হাতে নেই। তবে
বায়ু আমার কথা শুনে থাকে। যাও তোমার দাবী আমি মিটাবো। এখনি বায়ুকে
বলছি তোমার যেখানে ইচ্ছে বায়ু তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাক।
হযরত
সুলায়মান নবী বায়ুকে বললেন, দেখো
বায়ু এই লোক যেখানে যেতে চায় তাকে সেখানে নিয়ে যাও।
বায়ু
লোকটিকে হযরত সুলায়মানের গালিচায় সওয়ার করলো এবং কয়েক মুহুর্তেই বনবাদাড়,
মরু সাহারা, নদ-নদী ও সাগর-দরিয়া পার করে
হিন্দুস্তানের এক শহরে পৌঁছে দিলো।
সেদিন
পার হলো। পরের দিন হযরত সুলায়মান তার শাহী দরবারে বসা। এমন সময় হযরত আজরাইল সেখানে এসে
উপস্থিত। আল্লাহর এই ফেরেশতাকে তিনি কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, হে আজরাইল! গতকাল এক লোক হয়রান ফেরেশান
হয়ে আমার
দরবারে এসেছিলো এবং তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করেছে। সে বললো, আজরাইল আমার দিকে ক্রোদের দৃষ্টিতে তাকিয়েছে,
তাই মারাত্মক ভয়
পেয়েছি। লোকটি আমার কাছে অনুরোধ জানালো আমি যেন বায়ুকে হুকুম করি
যাতে তাকে ঐ মুহূর্তেই এই শহর থেকে বের করে হিন্দুস্তান নিয়ে যায়। আমি
তাকে অখুশি করতে চাইনি। বায়ুকে তার ইচ্ছেমতো হিন্দুস্তান নিয়ে যাওয়ার হুকুম
করলাম। সে এখন হয়ত হিন্দুস্তানে আছে। কিন্তু আমি খুব তাজ্জব হয়েছি যে,
আল্লাহর এতো বড়
ফেরেশতা হয়ে তাকে কি কারণে ভয় দেখালে। বেচারা সেই ভয়ে আজ
ঘরবাড়ি ও দেশছাড়া হলো।
আজরাইল
(আঃ) জবাব দিলেনঃ আমি
আল্লাহর হুকুম পালন ও তার ফরমান মানা ছাড়া আর কিছুই করিনে। ঐ লোকটির প্রতি আমি রাগ করে বা
ক্রোধের দৃষ্টিতে মোটেই তাকাইনি। সে ঠিকই বলেছে, তাকে আমি গতকাল এই বায়তুল মুকাদ্দাস
শহরে দেখেছি। তার প্রতি আমি যে দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম তা আসলে
তাজ্জব ও বিস্ময়ের দৃষ্টি ছিলো। কারণ আল্লাহর নির্দেশ ছিলো গতকালই যেনো
হিন্দুস্তানে তার জান কবজ করি। তাই তাকে তার মৃত্যুর মাত্র সামান্য সময় পূর্বে
বায়তুল মুকাদ্দাসে দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে যাই যে, কি করে সে এখন এই বায়তুল মুকাদ্দাসে
চলাফেরা করছে। তার রুহ যে হিন্দুস্তানে কয়েক মুহূর্ত পর কেড়ে নিতে
হবে। মনে মনে ভাবলাম, তার
যদি শত শত
পাখাও গজায় তাহলেও সে আছরের আগে হিন্দুস্তান পৌঁছুতে পারবেনা। যা হোক, যেহেতু তখনো তার মরণের সময় উপস্থিত হয়নি
সেহেতু খুব আশ্চর্য হয়েই তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ও পাশ কেটে চলে গেছি।
কিন্তু সময় মতো হিন্দুস্তান পৌঁছেই দেখি সে হিন্দুস্তানের নির্ধারিত স্থানে
হাযির। আর ঐখানেই তার মৃত্যু এলো। তৎক্ষণাৎ তার রুহ কবজ করে নেই।
হযরত
সুলায়মান (আঃ) বললেন, হক
কথা। সব
কিছু থেকেই পালানো সম্ভব কিন্তু মউতের হাত থেকে পালানো অসম্ভব। তার সেই মুহূর্তে
অবশ্যই হিন্দুস্তানে থাকা আবশ্যক ছিলো। কিন্তু সেখানে বায়ু ছাড়া তাকে
সেই মুহূর্তে হিন্দুস্তান নিয়ে যাওয়া কারো সাধ্য ছিলো না। সে নিজেই নিজ
ইচ্ছায় আমার কাছে ছুটে এলো এবং নিজের মুখেই কাকুতি-মিনতি করে নিশ্চিত পরিণতির
দিকে ছুটে গেলো।
এ
গল্প থেকে শিক্ষণীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমরা যারা মৃত্যুকে অবহেলা করে
আল্লাহ (সুঃ) পরিবর্তে তার সৃষ্ট বিপথগামী দাসদের উপাসনা করি অথবা নিজের
প্রবৃতির খেয়াল খুশি মত চলি এবং মৃত্যুকে ভুলে গিয়ে আল্লাহর হুকুম লঙ্গন
করি, আসলে
আমরা সবাই প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি সৃষ্টির নিশ্চিত
পরিণতি মৃত্যুর দিকেই হেঁটে যাচ্ছি। আর এই মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো পথ
নেই। তাই আমাদের সবার উছিত প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর কথা স্মরণে রেখে
আল্লাহর হুকুম মতো প্রতিটি কাজ করা।
লেখকঃ
মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী” কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।
No comments:
Post a Comment