Wednesday, November 28, 2018

দানা ও ফাঁদ

সে অনেক আগের কথা। একদিন এক শিকারী পাখি শিকারের জন্য গেলো বনবাদাড়ে। এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করে শেষ পর্যন্ত একটি ঝোপঝাড়ের নিকট উপস্থিত হলো। দূর থেকেই দেখতে পেলো পাখিরা উড়া উড়ি করছে। শিকারী তার পাখি শিকারের জাল বিস্তার করলো। জালের একমাথা গাছের শাখায় আটকিয়ে মূল সুতা হাতের কাছে রাখলো। জালের নিচে কিছু পরিমাণ গম ও শস্যদানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলো। এরপর একটি ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দিলো এবং সারা গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে নিশ্চল হয়ে শিকারের অপেক্ষা করতে লাগলো।

একটি পাখি অনেক দূর থেকে এই সবুজ ঝোপঝাড়টি দেখে খাবার-দাবারের নেশায় উড়ে এলো এবং শিকারী যেখানে আত্নগোপন করে অপেক্ষা করছিলো ঠিক সেখানে নামলো। এরপর শুরু করলো শস্যের দানা খোঁজা। পাখিটি যখন শিকারীর একেবারে কাছে পৌঁছে গেলো তখনি শিকারীর ভীষণ হাঁচি পেলো। হাঁচি থামাতে শিকারী অনেক চেষ্টা করেও বিফল হলো এবং বিকট শব্দে বেরিয়ে এলো। পাখিটি হাঁচির শব্দে টের পেল যে, কেউ নিশ্চয়ই এখানে লুকিয়ে আছে। তাই ভালো করে চারদিকে অনুসন্ধান করতে করতে হঠাৎ দেখতে পেলো যে, সারা গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ। পাখিটি বললো, “হে সবুজ পোশাকধারী, কে তুমি? লতাপাতা ঝোপঝাড়ের ভেতর কি করছো?”

শিকারী বললো, “প্রিয় পাখি আমার! আমাকে বিরক্ত করো না। তোমার কাজ তুমি করো। আমি একজন সূফী দরবেশ। ইবাদত বন্দেগী করেই আমার দিন কাটে। দুনিয়াদারী ছেড়ে দিয়ে বনবাসি হয়েছি। এখানে সাধনা আরাধনা করছি। ইবাদত-বন্দেগী ছাড়া আর কিছুতেই মন বসে না।

পাখি, “এ-যে নতুন কথা শুনছি। বনবাদাড়ের ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে ইবাদত-বন্দেগীর অর্থ কি? আমার মতে দুনিয়া ত্যাগ করা ও বনবাসে সাধনা চালানো ভালো কাজ নয়। ইবাদত-বন্দেগীর জন্য ঘাস লতাপাতার নিচে গা ঢাকা দেয়া ও মরুজঙ্গলে বনবাসের কোন প্রয়োজন নেই। তুমি তো শহর-গঞ্জ, গ্রাম---যেখানে মানুষ বনবাস করে সেখানেই আল্লাহর ইবাদত করতে পারো। সাথে সাথে কাজকর্মও করতে পারো, মানুষের খেদমত করতে পারো। তুমি এখানে বিজন বনবাদাড়ের আজেবাজে জায়গায় লতাপাতার নিচে এসে গা ঢাকা দিয়েছো ইবাদত বন্দেগী করতে?

তুমি কি শুননি যে,

"মানুষের খেদমত ছাড়া নেই কোন ইবাদত
তসবিহ, জায়নামাজ ও জোব্বায় নেই পথ।"

শিকারী, “বুঝা যাচ্ছে যে, তুমি একটি অতি সরল সাদাসিদে পাখি। মানুষকে এখনো চিনোনি। মানুষ খুবই খারাপ, কাউকেই শান্তিতে থাকতে দেয় না। মিথ্যা বলে, ফাঁকি দেয়, বাটপারি করে। একজনের উপর আরেকজন জুলুম করে। সবাই দুনিয়া ও দুনিয়ার মালের চিন্তাতেই মশগুল। কিন্তু আমার দিল খুব নরম। এতোসব অনাচার দেখা আমার সহ্য হয় না। আমিতো সারা জিন্দেগী কাজ করেছি, মানুষের বহু খেদমত করেছি। এখন এই বৃদ্ধ বয়সে একা, শুধু একাকী থাকতে চাই, শুধু আখেরাতের চিন্তাই বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারলে বাঁচি। আমার খাওয়া-দাওয়ার জন্য বনের ফলমূলই যথেষ্ট, আমার পোষাক হলো লতাপাতা। আর কতো দিন দুনিয়াদারীর চিন্তা করবো বলো?”

পাখি, “তা বাপু ঠিকই বলছো। কিন্তু তুমিতো বনের পাখি নও। মানুষ যদ্দিন জিন্দা আছে তদ্দিন অন্য সব মানুষের সাথেই তাকে থাকতে হবে। অন্যরা না হয় খারাপ লোক, তুমি ভালো হয়ে চলো, তাহলে অন্যরা তোমাকে দেখে ভালো হতে চেষ্টা করবে। তুমি ভেবে দেখোতো, ভালো কাজ যদি বনবাস ও এরকম কিছু হয়ে থাকে এবং সব মানুষই যদি তোমার মতো সংসার ত্যাগী হয়ে এতেকাফ শুরু করে তাহলে যে দুনিয়ার সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। ভালো কাজ তাকেই বলে যা সবসময় সকল মানুষই সম্পাদান করতে সক্ষম। তোমার কাজটি বরং ভালো নয়, ইবাদত নয়। ইবাদত হচ্ছে ঐ কাজ যা সকল মানুষই করতে পারে। তখন দুনিয়ার জিন্দেগী ভালো হয়ে যাবে। এতে দুনিয়া খারাপ হবে কেনো? সকল পয়গম্বর, অলি-আউলিয়া, পীর-দরবেশ, ইমাম, জ্ঞানীগুণী ও ভালো লোকেরা সবাই মানুষের সাথে জীবন যাপন করছেন, জনগণের সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী হয়েছেন। তুমি নিজেই কি কখনো শুনেছো যে, কোন মানুষ বনবাদাড়ে গিয়ে ঘাস লতাপাতার নিচে লুকিয়েছে এবং শুধু নিজের চিন্তাতেই মশগুল হয়েছে? আমি তো শুনিনি এমন কথা। এসব হলো আত্নবিলাসিতা। সমাজের মানুষকে পরিত্যাগ করে এসেছো একাকী আখিরাতের চিন্তা করতে! এটা স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

শিকারী, “হে পাখি! দয়া করে আমাকে একা থাকতে দাও। আমি মানুষ ও সমাজ থেকে মন্দ ছাড়া ভালো কিছু পাইনি। আর এখন তো আমার প্রতিবেশীর মৃত্যুই আমার জন্য বড় শিক্ষা হয়েছে। আর মৃত্যুর কথা ভুলে থাকা অসম্ভব। তুমি আমাকে মোটেই দিচ্ছো না আল্লাহর জিকির আজকার করতে। দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করো না। নিজের কাজে যাও।

বেশ ভালো কথা,” বলেই পাখিটি নিজের পথ ধরলো। কিন্তু কয়েক কদম যেতে না যেতেই দেখতে পেলো বেশ কিছু গম ও কাউন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এগুলোর উপর একটি জাল। মনে মনে ভাবলো জঙ্গলের ভেতর তো একটি গমও পাওয়া যায় না কিন্তু এখানে এতো কোত্থেকে এলোতার মন চাইলো এক্ষুণি ঝাঁপিয়ে পড়ে খাওয়া শুরু করতে। কিন্তু শিকারীর কথা এখনো তার কানে বাজছেঃ আল্লাহ, আখেরাত, ইবাদত, মৃত্যু ইত্যাদি। এছাড়া ভয় পাচ্ছিলো যে, লতাপাতা পরিহিত লোকটি হয়তো প্রতিবাদ করে বসবে। তাই সে ফিরে এলো এবং শিকারীকে জিজ্ঞেস করলো, “শুনো! এই গম কাউন কি তোমার ?”

শিকারী জবাব দিলো, “না না, আমার কোন সহায় সম্পদ নেই। আসলে আমার দুনিয়ার কোন কাজকর্মই নেই যে, এসব গম কাউন আমার হতে যাবে। তবে আমি যতটুকু জানি এগুলো দুটি এতিম শিশুর। ওরা এসে নিয়ে যাবে। ঐসবে মোটেও মুখ দিয়ো না। তুমি তো সবুজ বনবাড়ারে ঘুরে ফিরে খানাদানা জুটাতে পারবে। তাই এগুলো তোমার জন্য হারাম। তবে কেউ যদি খুবই আভাবী হয় এবং ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরে যাওয়ার উপক্রম হয় তবেই কেবল এগুলো খেতে পারে। থাকগে বাপু, আমার এসবে কোন মাথা ব্যথা নেই। আসলে তা আমার কোন বিষয়ই নয়।

পাখিটির কিন্তু মুখে পানি এসে গেছে, এমন পরিষ্কার গম, কাউনের লোভ মোটেই সামলাতে পারছে না। তাই বললো, “ভাগ্যের পরিহাসে আমি খুবই আভাবী ও ক্ষুধার্ত। একেবারে মরে যাচ্ছি। আমার ধারণা আমার মতো ক্ষুধার্তের জন্য মরা লাশ খাওয়াও হালাল।

শিকারী, “আমি বাপু এসব কিছু বুঝিসুঝি না। তুমি তোমার অবস্থা ভালো জানো। তবে কথা হলো প্রকৃত অভাবী না হলে এগুলো খাওয়া তোমার জন্য গুণাহ হবে। তাছাড়া কেউই তোমার পথ রোধ করে দাঁড়াচ্ছে না।

পাখি কিছু চিন্তা করলো। এরপর এগিয়ে গেলো সামনে এবং শুরু করলো খাওয়া। কিন্তু পয়লা দানা মুখে দিতেই জালে আটকা পড়লো এবং দেখতে পেলো যে, জাল থেকে বেরিয়ে আসার কোন পথ নেই। তখন বুঝতে পারলো যে, এতোসব কথাবার্তা তাকে ফাঁকি দেবার জন্যই শিকারী বলেছে। শিকারী যখন দেখলো শিকার তার জালে আটকা পড়েছে তখন লতাপাতার আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো এবং পাখিটি ধরতে ছুটলো।

পাখি বললো, “কি যে করেছি তা এতোক্ষণে বুঝতে পেরেছি। আর এটি হলো তারই শাস্তি যে, আমি ভণ্ড দরবেশ, লোক দেখনো সূফী ও প্রতারকের দুনিয়া ত্যাগী ফাঁকিবাজি কথায় বিশ্বাস করেছি।

শিকারী, “তুমি যা বলছো তা আমি জানি না। তবে এখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি এমন কোন বেহিসেবী কথা বলিনি যে, তোমাকে ফাঁকি দেবো। আমি শুধু বলেছি যে, সাধনা করছি আর তুমি বলেছো, খুবই অভাবী। একথা ঐ কথারই বদলা হয়ে গেলো। এখন তুমি গম খাও আর আমি খাবো তোমাকে। আমি আমার ইবাদত বন্দেগী ও সাধনার পুরস্কার পেয়ে গেছি। তবে একথা নিশ্চয়ই মানতে হবে যে, তোমার লোভই তোমাকে প্রতারণা করেছে। যে কেউ ফাঁদে পড়ে সে তার লোভের কারণেই ফাঁদে পড়ে। আমি যদি হাঁচি নাও দিতাম ও আমাকে যদি নাও দেখতে তবুও গম খাওয়ার জন্য এগিয়ে যেতে এবং ফাঁদে আটকা পড়তে। তোমার উচিত ছিলো একথা চিন্তা করা যে, যেখানে গম আছে সেখানে যমও আছে। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছোএর কোন প্রতিকার নেই।

লেখকঃ মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির মসনবীকাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।

No comments:

Post a Comment