Tuesday, November 27, 2018

কালা শাবানের গল্প

এক ছিল বৃদ্ধ মুদি। তার নাম সালমান। সালমান কানে খুব কম শুনতাে। কানের কাছে গিয়ে খুব জোরে কথা বললেই সে শুনতে পেতো। এজন্যে লােকেরা তার নাম দেয় কালা সালমান। কালা মানে বধির। সালমানের মুদি দোকান থেকে কেউ কিছু খরিদ করতে চাইলে উচ্চ কণ্ঠে বলতে হতাে। সালমান শুনতে না পেলে বলতাে, বাবা, আমি কানে কম শুনি। জোরে বলো কি চাও।

সালমানের পার্শ্বের মহল্লায় ছিলাে শাবান নামে এক যুবক। শাবানের একটি বদ অভ্যাস ছিলাে, সে দোকানদারদের কাছ থেকে বাকীতে জিনিস কিনতো কিন্তু টাকা পয়সা দেয়ার বেলা ফাঁকি দিতাে, অযথা গড়িমসি করতো কিংবা দিতােই না। এ কারণে দোকানীরা তার কাছে মাল বিক্রী করতে চাইতাে না। একদিন শাবান এলাে সালমানের দোকানে এবং বললাে, আমাকে বাকীতে কিছু মাল দিন। পরে টাকা দিয়ে দেবাে।

সালমান বললাে, আমি বাপু লেখাপড়া জানিনে, আমি মনেও রাখতে পারিনে, বুড়াে মানুষ। তাই বাকীতে কোন কিছু বিক্রয় করবাে না।

এ কথা শুনে শাবানের খুব রাগ হলাে। এরপর থেকে সে সব সময় কালা সালমানকে বিরক্ত করতো ও ঠাট্টা মস্করা করতাে। শাবান প্রতিদিন তার কতিপয় বখাটে বন্ধু নিয়ে যেতো সালমানের দোকানে এবং কোন একজন বখাটেকে বলতাে, যা, সালমানের সামনে গিয়ে শব্দ না করে শুধু ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কথা বল। সালমানতাে জোরে না বললে এমনিতেই শুনতে পেতাে না। তাই সে জিজ্ঞেস করতাে, জ্বী? কি চাও?

শাবানের বন্ধু আবারাে ঠোঁট নেড়ে কথা বলার অভিনয় করলে এবারও সালমান শুনতে পেতাে না। তাই বলতো, জোরে বলো কি চাও।

তখন শাবান এগিয়ে গিয়ে জোরে বললাে, চাচা, তুমি বধির নাকি? আমার বন্ধুতো তরকারী চাচ্ছে। শাবানের কথায় তার বন্ধুরা হেসে উঠতাে। সালমান এতে বিরক্ত হতো এবং বলতাে, আমার কাছে তরকারী নেই। এটা তরকারীর দোকান নয়, মুদি দোকান। শাবানের বখাটে বন্ধুরা বৃদ্ধের কথায় আবারাে হাসিতে ফেটে পড়তো।

পরদিন শাবান ও তার বন্ধুরা আবারাে যেতো সালমানের দোকানে। তাদের আরেকজন গিয়ে ফিসফিস করে কথা বলতাে। সালমান কিছুই শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলে শাবান এগিয়ে যেতাে এবং বলতাে, চাচা, তুমি কি কালা? আমার এ বন্ধু দুই গজ কাপড় চাচ্ছে। শাবানের কথায় তার বন্ধুরা হেসে উঠতাে। বৃদ্ধ মুদি বিরক্ত হয়ে জবাব দিতাে, আমার এখানে তাে কাপড়-চোপড় বিক্রী হয় না। এটা মুদি দোকান। মুদির কথা শুনে শাবানের বন্ধুরা ঠাট্টা মস্করা শুরু করতাে। এভাবে বেশ ক’দিন চললো। মুদি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠলাে বখাটেদের উৎপাতে। একদিন শাবানকে একা পেয়ে বললাে, দেখ শাবান, আমি ভালাে করেই জানি যে আমার কানের পর্দা অনেক ভারী হয়ে গেছে, কম শুনতে পাই। কিন্তু তুই এ ধরনের অসৎ কাজ করবিনে। মানুষকে বিরক্ত করা খুবই খারাপ। এতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। যদি তুই এসব বদমায়েশী করে আমাকে নরম করতে চাস তাহলে মনে রাখ আমি মােটেও তাের কাছে মাথা নত করবাে না। এই যে দেখছিস আমি কম শুনতে পাই এটি আমার রােগ, একটি অসুখ। এতে আমার কি অপরাধ দেখলি? আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা জুড়ে দিয়ে প্রকৃত পক্ষে তুই তােকেই ঠাট্টা করছিস। তাের খারাপ চরিত্রই এতে প্রমাণিত হচ্ছে। তুই যে একটা বেআদব বেতমিজ তা-ই বুঝাচ্ছিস। মানুষ এতে তাের উপর খুশী হবে না। তােকে ভাল মনে করবে না। এই যে রোগ তা একদিন তােরও হতে পারে। রােগ যে কার হবে কার হবে না তা কেউ বলতে পারে না। আমিও যখন তাের মতাে যুবক ছিলাম তখন আমারও ভাল স্বাস্থ্য ছিলাে। কোন খুঁ ছিল না। আমিও তাের মতাে নাদুস-নুদুস ছিলাম। এখন বৃদ্ধ হয়েছি, অসুখ-বিসুখ হয়েছে। কানেও ভালাে শুনতে পাইনে। তুইও জানিসনে যে, রােগ একদিন তােকেও ধরতে পারে। আগামীকাল যে তাের ভাগ্যে কি আছে তার কিছুই জানিসনে। তাই বলছি ওসব করিসনে। ভালাে নয়। আমার মনে কষ্ট দিসনে। তুই আমার ছেলের মতাে। শাবান বৃদ্ধের কথা শুনে বললাে, তাহলে আমাকে বাকীতে মাল দেবে?

সালমানঃ না, কক্ষণাে না। তাের মতো বেইনসাফ মানুষকে নয়। তুই একটা অমানুষ। তাের যদি ইনসাফ থাকতাে তাহলে আমার মতাে বৃদ্ধকে নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করতিনে। এরপরও তােকে অনুরােধ করছি আর বিরক্ত করিসনে। আমি এতে কষ্ট পাই। তাের এ কাজ মােটেও ভাল নয়।

শাবানঃ উহ্! তাহলে মানুষ যে বলে থাকে কালা সালমান সে কথাটা তবে ঠিকই।

সালমানঃ ভাল কথা। আশা করি একদিন তােরও এ রকম অবস্থা হবে।

সালমান মনের দুঃখে এই দুষ্ট যুবককে অভিশাপ দিলাে।

কিছু দিন পরের কথা। একদিন শাবান টের পেলাে তার কানে যেনাে কি হয়েছে। সে সব কিছু ভালভাবে শুনতে পাচ্ছে না। এর পেছনে হয়তাে অনেক কারণই থাকতে পারে। যা হােক, শাবানের কানও ভার হয়ে এলাে। সে মানুষের কথা বহু কষ্টে শুনতে পেতাে। একদিন সে তার এক পরিচিত লােকের সাথে আলাপ করার সময় কথাবার্তা না শুনেই উল্টো জবাব দিয়ে দিলাে। এতে সে ব্যক্তি হেসে উঠলাে এবং বললাে, কিরে, তুই কালা হয়ে গেলি নাকি?

শাবান এ কথা শুনে খুবই কষ্ট পেলাে। এরপর থেকে সে কারাে সাথে কথাবার্তা বলার সময় সমস্ত মনােযােগ দিয়ে কথাটি শুনার চেষ্টা করতো যাতে সঠিক জবাব দিতে পারে ও উপহাসের পাত্র না হয়। কিন্তু শাবান যতই চেষ্টা করতে লাগলাে ততই তার কান ভারী হয়ে এলাে। দেখতে দেখতে শাবান সম্পূর্ণ বধির হয়ে গেলাে।

অসুখ-বিসুখ বা রােগ-শােক মানুষের হয়েই থাকে। কারাে চোখ অন্ধ হয়। কেউ কানে শুনে না, কেউ বধির হয়ে জন্ম নেয়, কারাে পা খোঁড়া থাকে এ ধরনের খুঁত ও অসুবিধা মানুষের হয়ে থাকে, তা কোন অপরাধ বা গুনাহ নয়। এসব দোষ মানুষের হাতের বাইরে। যাদের এ ধরনের খুঁত আছে তারা এগুলােকে সহজভাবেই মেনে নেয়। এতে লজ্জা-শরমের কিছু নেই। কিন্তু শাবান ছিলাে উল্টো। সে নিজের খুঁত যাতে ধরা না পড়ে সে চেষ্টা করতাে। নিজের অযথা বাহাদুরী জাহির করার জন্য ভান করতো যে তার কোন ত্রুটি নেই। সে সুস্থ সমর্থ। তার মন চাইতাে না যে, কেউ বুঝে ফেলুক সে একজন কালা। যখনি কারাে সাথে কথা বলতাে তখনি খুব সতর্কতার সাথে হাবভাব ও পরিস্থিতি বুঝে সুজে কথা বলতাে। সে প্রতিপক্ষের ঠোঁট নড়াচড়া ও চোখ মুখের অবস্থা দেখে অনুমান করে নেয়ার চেষ্টা করতাে যে কি বলতে চাচ্ছে যাতে জবাবে উল্টা পাল্টা কথা বলে না বসে। কিন্তু তার এত সব চেষ্টা বিফল হলাে। কখনো কখনাে সে এতােই অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতাে যে নিজের দোষকে ঢেকে রাখার কারণে অনুতাপ ও অনুশােচনা করতাে। তার ইচ্ছে করতাে, বলেই ফেলি, আমি কালা, আমি বধির, শুনতে পাইনে, ইত্যাদি।

একদিন শাবান গেলাে গম ভাঙ্গাতে। তাদের শহরের আরেক পাড়ায় ছিলাে গম ভাঙ্গানাের যাঁতাকল। আগের দিনে আজকের মতাে যান্ত্রিক কল ছিলাে না। মানুষ পাথরের চাক্‌তি বা যাঁতা বানিয়ে তার ভেতর গম পেষতো। পাথরের চাকা নিজ হাতে ঘুরাতো। এ ছাড়াও ছিলাে এক ধরনের পানির যাঁতাকল। নদীর বা খালের পাশে কলুর ঘানির মতাে ঘর বানিয়ে নদীর স্রোতকে চাকা ঘুরানাের কাজে ব্যবহার করতাে। অনেকটা আজকালকার পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মতাে। বাধ দিয়ে পানি আটক করে একটি সরু পথ দিয়ে পানি ছাড়লে তা বেগে প্রবাহিত হতাে। আর ঐ প্রবল স্রোতের মুখে চাকা লাগানাের কারণে তা ঘুরতো। এ চাকার সাথে থাকতাে যাঁতাকলের সংযােগ। ব্যস্, এভাবেই তখনকার দিনে যব, ভুট্টা ও গম ভাঙ্গানাে হতাে। অবশ্য পানি না থাকলে বা কমে গেলে ঐসব হাইড্রোলিক যাঁতাকল বন্ধ থাকতাে। যাকগে। শাবান তার গাধার উপর গমের বস্তা চাপিয়ে গেলাে যাঁতাকলে। গলির পাশে একটি গাছের সাথে গাধাটিকে বেঁধে সে গেলাে গমের বস্তা নিয়ে। গম ভাঙ্গিয়ে আটার বস্তা নিয়ে ফিরে এলাে গাধার কাছে। ভালাে করে আটার বস্তা গাধার পিঠে বেঁধে নিলাে যাতে পড়ে না যায়। এর ভেতরই শাবানের চোখে পড়লাে এক চাষী। চাষী তার গাধা দিয়ে ঐ গলি বেয়ে আসছে। গাধার পিঠে একটি বস্তা। তার বস্তায় ছিলাে গােল আলু। চাষী গলির দু'পাশের ঘরবাড়িগুলাের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছে। কেউ তার কাছ থেকে ঐ আলু কিনে বাসার ঠিকানা দিয়ে এসেছিলাে। চাষী বেচারা ঐ আলু নিয়েই এসেছে। কিন্তু ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছে না। চাষী দূর থেকে শাবানকে দেখতে পেয়ে তার দিকেই হাঁটা শুরু করলাে যাতে তাকে জিজ্ঞেস করে আলু ক্রেতার বাড়ির হদিস করতে পারে।

এদিকে শাবান যেই দেখলাে যে চাষী তার গাধা নিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। তখন সে ভাবা শুরু করলাে যে, নিশ্চয়ই এ লােক গম ভাঙ্গাতে এসেছে কিন্তু যাঁতাকল কোথায় তার ঠিকানা জানে না। এখন তাকে দেখে তার কাছে আসছে এবং এসেই জিজ্ঞেস করবে, যাঁতাকল কি নিকটে? আমি জবাবে বলবাে, এই তাে, এখানে। এরপর হয়তাে জিজ্ঞেস করবে, আজ কি যাঁতাকল কাজ করছে? আমি বলবো, জ্বী হ্যাঁ, আজ পুরােদমে কাজ করছে। এরপর হয়তাে জিজ্ঞেস করবে, নিশ্চয়ই আজ পানি অনেক জমা আছে বাঁধে? আমিও বলবাে, জ্বী, অনেক পানি, একেবারে কোমর পর্যন্ত। এরপর নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে, এই যাঁতাকলে গম ভালাে ভাঙ্গা হয়তাে? বলবাে, চমৎকার।

শাবান জবাবগুলাে তৈরী করে প্রস্তুত হলাে। এদিকে গ্রাম্য চাষী কাছে এসে বললেন, আসসালামু আলাইকুম।

শাবান যেহেতু তার কানের দোষ গােপন রাখার চিন্তায় মশগুল ছিলাে সেহেতু সালামের কথা ভাবতেই পারেনি। জবাবে বললাে, এই তাে এখানে।

চাষীঃ সালামের জবাব কই? আমি তাে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি? এখানে আবার কি রয়েছে বলছো? মাথায় কি ঘিলু নেই?

শাবান জবাব দিলােঃ জ্বী হ্যাঁ, আজও অন্যদিনের মতাে।

চাষীঃ ভাতিজা, কি আবােল-তাবােল বকছাে? এতাে বড় দেহটা কি কাদামাটি দিয়ে বানিয়েছাে?

শাবান তখন বাধের পানির কথা ভাবছিলাে। তাই নিজের কোমরের দিকে ইশারা করে বললাে, জ্বী হ্যাঁ!, এ পর্যন্ত।

চাষী শাবানের জবাব শুনে রেগে গেলাে এবং বললো, জ্বী না, কোমর পর্যন্ত নয়, আরাে উপর। একেবারে মাথা পর্যন্তই কাদা মাটি। ব্যাটা নচ্ছার কোথাকার! তাের যা আক্কেল বুদ্ধি তাতে তােকে দিয়ে শুধু বােঝা বহানাে উচিত।

শাবান মনে করলাে চাষী নিশ্চয়ই বলছে যে, তুমিও কি গম নিয়ে এসেছিলে! এ ভেবে শাবান বললাে, ঠিকই বলেছো, গাধার বােঝায় এক বােঝা।

চাষীঃ তাই উচিত।

শাবানঃ চমৎকার, অনেক ভালাে।

চাষী মনে করলো শাবান আসলে তাকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করছে। তাই রেগে গিয়ে শাবানের মাথায় আঙ্গুল ঠুকে বললাে, তাের মাথায় ঘােল ঢালা দরকার, ছাই ঢালা উচিত।

শাবান মনে করলাে চাষী তাকে মারতে চাচ্ছে। তাই তাজ্জব হয়ে বললাে, ব্যাপার কি? আমাকে মারতে চাও কেনো? আমি তাে তােমাকে কিছুই বলিনি।

চাষীঃ আসলে তােকে লাথি গুতা দিলেই তাের আক্কেল বুদ্ধি গজাতাে। আফসােস যে, হাতে সময় নেই, অনেক কাজ। এ কথা বলেই চাষী তার গাধার রশি টেনে চলে গেলাে অন্যদিকে কাউকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করার জন্যে। তখন শাবান মনে মনে বললাে, মানুষ কতাে আজব ধরনেরই না হতে পারে। তার উপকার করে পথ বাতলে দিলাম অথচ সে কিনা আমাকে মারতে এলাে। শাবান এরপর তার গাধা ও আটা নিয়ে বাড়ির দিকে চললো।

শাবান বাড়ি পৌঁছে মনে মনে বললাে, শুনেছি মহল্লার কসাই বেচারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একেবারে রােগশয্যায় শায়িত। আজ তাকে এক নজর দেখে আসা উচিত। রােগী দেখতে যাওয়া সওয়াবের কাজ। এ ছাড়া কসাইকে তার প্রায় প্রতিদিনই প্রয়ােজন হয়। তার কাছ থেকে গােশত কিনতে হয়। সুতরাং তাকে দেখতে না যাওয়া অন্যায়।

শাবান তার কাপড়-চোপড় পাল্টিয়ে বিকেলে বের হলো কসাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথে যেতে যেতে সে ভাবলাে রােগী দেখা তাে তেমন লম্বা চওড়া কাজ নয়। উপস্থিত হয়েই সালাম জানাবাে। সালামের জবাব দেবে। জিজ্ঞেস করবাে ওষুধ পথ্য কি খাচ্ছাে? হয়তাে বলবে স্যুপ, অথবা বন রুটি কিংবা অন্য কিছু খাচ্ছি। আমি বলবাে, খুব ভালাে ব্যবস্থা। এটাই তােমার উপযুক্ত পথ্য। এরপর জিজ্ঞেস করবাে তােমার অবস্থা এখন কেমন? নিশ্চয় জবাব দেবে, কিছুটা ভালাের দিকে। তখন আমি বলবাে, আলহামদুলিল্লাহ। এরপর জিজ্ঞেস করবাে, তােমার ডাক্তার কে? তখন নিশ্চয়ই কোন ডাক্তারের নাম বলবে। আমি তখন বলবাে, বেশ তাে, ভালাে ডাক্তার তিনি। এ ঘরে তার পদার্পণ শুভ হােক। এ ডাক্তার যেখানেই গেছেন বিরাট সেবা করেছেন। হাতের খুব যশ। এরপর খােদাহাফেজ বলে চলে আসবাে। ব্যস্, খুব সােজা কাজ।

বধির শাবান এসব সওয়াল জবার মনে মনে তৈরী করে পৌঁছে গেলাে কসাইয়ের বাড়ি। রােগীর ঘরে প্রবেশ করেই সালাম বিনিময় করলাে। এরপর রােগীর বুক বরাবর এসে বসলাে। রােগীর অবস্থা তখন খুবই খারাপ যাচ্ছিলাে। শাবান তার হাত দিয়ে রােগীর বাহু ধরে জিজ্ঞেস করলােঃ তােমার কেমন অবস্থা ভাই, কিছুটা ভালাে হয়েছে?

রােগী গােঙ্গাতে গােঙ্গাতে বললাে, না বাবা, আমার অবস্থা খুবই খারাপ, একেবারে মরে যাচ্ছি।

শাবানঃ আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর বহুত বহুত শুকরিয়া। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।

রােগী শাবানের কথা শুনে বিরক্তি বােধ করলাে। রােগীর পাশে আরাে যারা ছিলাে তারা তাে বিস্ময় প্রকাশ করলাে। এরপর শাবান জিজ্ঞেস করলাে ওষুধ-পথ্য কি খাচ্ছাে?

রােগীর মেজাজ প্রথমেই তিরিক্ষি হয়ে গিয়েছিলাে। তাই জবাব দিলাে, যন্ত্রণা খাচ্ছি, মরণ খাচ্ছি, সাপের বিষ খাচ্ছি।

শাবানঃ খুব ভালাে পথ্য। রােগীর জন্য এগুলােই উত্তম খাদ্য।

রােগীর মেজাজ আরাে বিগড়ে গেলাে। রােগীর একজন আত্মীয় বললাে, এই ব্যাটা, এসব কি যা-তা বকছিস? রােগীর সাথে তাের কোন শত্রুতা আছে নাকি?

শাবান তার কথা কিছুই বুঝতে পারলাে না। তাই জবাব দিলাে না। কিছুক্ষণ পর আবার রােগীকে জিজ্ঞেস করলাে, তােমার ডাক্তার কে ভাই?

রােগীঃ আজরাইল! যা ব্যাটা এখান থেকে। দূর হ। পশু কোথাকার!

শাবান বললোঃ বেশ ভালাে ডাক্তার। এ বাড়িতে তার আগমন শুভ হােক। তার মতাে ডাক্তারই হয় না। যে রােগীকেই দেখেছেন একদিনেই তার সবকিছু সেরে দিয়েছেন।

শাবানের কথা শুনে রােগী চেঁচিয়ে ওঠে বললাে, এ নচ্ছারকে এখান থেকে ঘাড় ধরে বের করে দাও। এই আহাম্মক আমাকে নিয়ে তামাশা জুড়েছে। সে কি চায় এখানে?

ঘরের লােকজন শাবানের হাত ধরে তাকে বাইরে নিয়ে এলাে এবং বললাে, একটা বড় বদমায়েশ লােক তুই। ব্যাটা অসভ্য কোথাকার! তুই কি বলতে চাস? রােগী তাের সাথে কি দুশমনি করেছে যে এরকম করছিস?

রােগীর একজন আত্মীয় শাবানকে ধাক্কা মেরে রাস্তার দিকে ঠেলে দিলাে। আরেকজন তাে তেড়ে গেলো তাকে মারতে। ঠিক ওসময়ই ঐ রাস্তায় দেখা গেলাে গাধার ওপর সওয়ার সকাল বেলার সেই চাষীকে যার সাথে শাবানের কথাবার্তা হয়েছিলাে। চাষী বললাে, মারাে শালাকে। এই ব্যাটা পাগলও নয়, বেকুবও নয়, সে এক ফালতু বাজে লােক। মানুষকে উপহাস ও ঠাট্টা বিদ্রুপ করে বেড়ায়। শুধু ফাজলামী ছাড়া কিছু বুঝে না এই বেতমিজ। মারাে তাকে। একমাত্র লাথি গুতা খেলেই সে ঠিক হবে। মার-ধােরেই কেবল তার জ্ঞান ফিরবে। এই অসভ্য কিছুক্ষণ আগে আমার সাথেও বেআদবী ও মস্করা করে এসেছে। ইয়ার্কী করবার জায়গা পায় না।

এই বলে চাষীও দৌড়ে এলাে শাবানকে মারতে। সবার এই মারমুখী অবস্থা দেখে শাবানতাে হাউমাউ শুরু করে দিলাে। সে চিল্লিয়ে বলতে লাগলােঃ আমাকে কেনো মারছাে? আমি তােমাদের কি ক্ষতি করেছি? আমি তােমাদের কি বলেছি?

রাস্তার হৈ চৈ শুনে পাশের বাড়ি থেকে একটি যুবক বেরিয়ে এসে দেখলাে হাঙ্গামা বেধেছে। সে বললােঃ কি হয়েছে? থামুন থামুন, কেনো এ লােককে মারপিট করছেন? কয়েকজন উত্তেজিত লােক জবাব দিলােঃ মানুষকে নিয়ে উপহাস করতে এসেছে এই ব্যাটা। রােগীর পাশে বসে রােগীকে যা-তা বলছে যেনাে রােগী তার চিরশত্রু।

যুবক সবাইকে থামিয়ে বললােঃ একটু থামুন! দেখি সে কি চায়।

এই বলে যুবক শাবানের কাছে গিয়ে বললােঃ বলতাে দেখি এ বাড়িতে কেনো এসেছিলে?

বধির মনে করলাে যুবক তাকে বলছেঃ কেনো চিৎকার করছাে? এই ভেবে জবাব দিলােঃ এরা আমাকে মারতে চায়। আমি তাে কোন অপরাধ করিনি।

যুবক বললােঃ কিছু তাে নিশ্চয়ই করেছো। শুনি, তােমার নাম কি?

বধির মনে করলাে যুবক তাকে জিজ্ঞেস করছে, তুমি কি কাজে এসেছিলে এ বাড়িতে? তাই সে জবাব দিলােঃ এই মহল্লার কসাই বেচারা অসুস্থ শুনে তাকে দেখতে এসেছিলাম।

যুবক জিজ্ঞেস করলােঃ বেশ ভালাে কথা। তােমার বাসা কোথায়?

বধিরঃ বাবা, আমার কোন অপরাধ নেই। আমি নির্দোষ। শুধু রােগী দেখতে এসেছিলাম।

ঘটনাক্রমে যুবকটি ছিলাে বৃদ্ধ মুদি সালমানের পুত্র। সে এতক্ষণে আসল রহস্য বুঝে ফেললাে। সে কিছুটা চিন্তা করে অনুমান করলাে যে, এ লােকটিও নিশ্চয় তার বাবার মতই কালা। কানে শুনে না। অনুমানের ওপর কথা বলছে। কেননা তার কথাগুলাে কিন্তু গুছানােই ছিলাে। তবে কিনা যথাস্থানে বলছে না। ব্যস, এই ধারণা করে যুবক এক টুকরাে কাগজ ও কলম পকেট থেকে বের করে তার ওপর লিখলােঃ “তুমি কি লেখা পড়া জানাে?’’ এরপর, এ লেখাটি বধিরের চোখের সামনে তুলে ধরতেই শাবান বলে উঠলাে, হ্যাঁ হ্যাঁ , আমি পড়াশুনা জানি। এই যে আমি লেখাটি পড়তে পারছি।

কথা শুনে যুবকের বদ্ধমূল ধারণা হলাে যে, এ বেচারাও তার বৃদ্ধ বাবার মতাে কানে কম শুনে কিংবা একেবারেই শুনে না। যাকে বলে পুরােদস্তর কালা। তার দোষ কেবল এখানেই যে, সে তার ঐ অক্ষমতার কথা ফাঁস করতে চায় না। কাউকে জানাতে চায় না যে, সে কালা। এটা তার মিথ্যা অহমিকা, আত্মগরিমা। যুবকটি এরপর জনতাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে তাদের বিদায় করলাে। তারপর কাগজের ওপর লিখলােঃ চাচা মিয়া, বধির হওয়াতো কোন অপরাধের বিষয় নয়। এতে লজ্জা শরমের কি আছে? আমার বাবা সালমান মুদিও বধির। তাতে কি? এটা তাে রােগ। অপরাধ ও অপমানের কিছু নয়। তুমি তাে মানুষের সব কথাবার্তারই উল্টোপাল্টা জবাব দিয়ে যাচ্ছো। মানুষ এতে কষ্ট পায়, বিরক্ত হয়। মনে করে তুমি তাদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও উপহাস করছো। যদি মানুষ বুঝতে পারে যে, তুমি কানে শুননা তাহলে কোন বিপদই নেই। কেউ তােমাকে ভুল বুঝবে না। নিজের আত্মগরিমা ত্যাগ করে বলো, “আমি বধির”। তাহলেই বেঁচে যাবে। নইলে মারধাের তােমার ভাগ্যে নিশ্চিত।

এতক্ষণে শাবান সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললােঃ অনেক অনেক শুকরিয়া তােমাকে। সত্য কথা বলেছো। আমি বধির। কোন এক সময় আমি তােমার বাবা সালমান মুদিকে ঠাট্টা-মস্করা করতাম। আজ তওবা করলাম। আর কাউকে মস্করা করবাে না। আমি আসলে মানুষকে মস্করা করিনি। নিজেকেই নিজে মস্করা করেছি। তুমি সত্য কথাই বলেছো। নিশ্চয়ই এখন থেকে নিজের রােগের কথা মানুষকে জানাবাে, বলবােঃ আমি বধির, আমি কালা।

শাবান এরপর থেকে সব সময় পকেটে কাগজ কলম রাখতাে। যখনি কেউ তার সাথে কথা বলতে আসতাে তখনি সে কাগজের ওপর লিখে জানাতাে, আমি কালা। কিছুই শুনিনে। আমার সাথে কোন প্রয়ােজন থাকলে এই কাগজে লিখে জানান। আমি পড়তে জানি, লেখা পড়ে জবাব দেবাে।

লেখকঃ মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী” কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।

No comments:

Post a Comment