Wednesday, November 28, 2018

বুদ্ধিমান ও বুদ্ধিহীন

এক ছিলাে বুদ্ধিমান। মাথা তার ভালাে কাজ করলেও ধনসম্পদ কিছুই ছিলাে না। তার কাজই ছিলাে হেঁটে হেঁটে শহরে শহরে ঘুরে বেড়ানাে। একবার এই বুদ্ধিমান রওয়ানা হয়েছে এক শহর থেকে অন্য শহরের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে এক বিজন মরুতে গিয়ে পৌঁছলাে। চলার পথে হঠাৎ এক আরব গেঁয়াে পথিকের দেখা। আরব তার উটে চড়ে পথ চলছে। উটের পিঠে দু’দিকে দু'টি বড় বস্তা ঝুলানাে ছিলাে। পদচারী ভাবলো, যদিও আমি পায়ে হেঁটে চলছি ও ক্লান্ত এবং এই আরব উটের পিঠে ও আরাম আয়েশে চলছে, তথাপি সফরসঙ্গী তাে পাওয়া গেলাে। তার সাথে গল্প গুজব করা যাবে, ব্যস্ত থাকা যাবে। পথের দূরত্ব কথায় কথায় ততো টের পাওয়া যাবে না।

উট সওয়ারীর কাছে পৌঁছেই লম্বা করে সালাম দিলাে এবং বললাে, স্বাগতম, স্বাগতম। তােমাকে দূর থেকে দেখেই খুশি হয়েছি। পায়ে হাঁটা ও ক্লান্তির কথা না হয় বাদই দিলাম ভাই, একা পথ চলতে চলতে একেবারে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখন যতক্ষণ এক পথে চলবাে অন্ততঃপক্ষে দু’চারটে কথা বলার মানুষ পেলাম।

উট সওয়ারী সালামের জবাব দিয়ে বললাে, আমিও ভাই একা চলতে চলতে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজে নিজেই গান গাওয়া শুরু করলাম। তবে ভাই পায়ে হাঁটা আর উটে চড়ার মধ্যে তেমন কোন ফারাক নেই। আসলে পায়ে হাঁটাই ভালাে। তােমার যদি উট না থাকে তাহলে সে উটের কখনাে রােগ হবে না, উট কখনাে চোরে নেবে না, কোন সময় উট রশি ছিড়ে পালাবে না, কোন মঞ্জিলে পৌঁছুলে উট, ঘােড়া বা গাধার জন্য ঘাস লতাপাতা খোঁজার কোন চিন্তা নেই। একেবারে নিশ্চিন্তে থাকবে, কোন ভাবনা নেই। কবি ঠিকই বলেছেনঃ

“চিন্তা নেই ভাবনা নেই যার নেই গাধা
ঘাস পাতা খড়ের তরে মন নেই বাধা”

পদচারী বললাে, না ভাই, সে কেমন কথা। যদি কারাে গাধা না থাকে তাহলে তাে তার বােঝা তার মাথাতেই চাপে। পথ যদি দূরের হয় তাহলে তার পায়েরই কষ্ট। তবে হ্যাঁ, আমার কিন্তু হেঁটে চলতে তেমন খারাপ লাগে না। যখন ভাবি যে আমার দেহের বােঝা আমি নিজেই বইছি তখন মনে মনে খুশীই লাগে। কিন্তু উটের ওপর চড়লে মনে হয় আমার পায়ের নিচে উট বেচারা নালিশ করছে।

সওয়ারী হেসে বললাে, তাও বটে। যাদের উট নেই তাদের এ রকমই ভাবনা। নতুবা আল্লাহ উট বানিয়েছেন তাে বােঝা টানার জন্যেই। জঙ্গলের কাঁটা ও খড়কুটা খেয়েই উট তৃপ্ত। তুমি সওয়ার না হলে কি হবে আরেকজন সওয়ার হবেই।

পদচারী বললাে, সে যাক, উটটি কিন্তু বেশ ভালাে, নাদুস নুদুস। আল্লাহ তােমাকে মাফ করুক ভাই, উটের বােঝা দুটি কিন্তু অনেক ভারী বলে মনে হচ্ছে। বস্তা দুটোতে এমন কি বােঝাই করেছাে?

সওয়ারী বললাে, একটিতে গম। জমি থেকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। আর অন্যটি ভর্তি করেছি বালি আর মাটির ঢেলা দিয়ে।

পদচারী বিস্ময় প্রকাশ করে বললােঃ কি বললে? বালি আর মাটির ঢেলা? ওসব কেনো বাড়ি বয়ে নিচ্ছাে? তােমার বাড়িতে কি ওসবের কোন অভাব আছে?

সওয়ারীঃ মাটির ঢেলা কোনো কাজের জন্য নিচ্ছিনে। গম এক বস্তার বেশী ছিলাে না বলে তা উটের পিঠে আটকানাে যাচ্ছিলাে না। তাই আরেক বস্তা ভর্তি করলাম মাটি দিয়ে যাতে উটের পিঠে দু'পাশ থেকে বস্তা দু’টি ঝুলে থাকে। মাঝখানে আমি চড়ে বসেছি।

পদচারী এ জবাব শুনে হাসিতে ফেটে পড়লাে। বললাে, আজব বুদ্ধি আবিষ্কার করেছো। একেবারে বুদ্ধির ঢেঁকি! আরে ভাই এর চেয়ে ভালাে হতাে না যদি গমগুলােকে দুই বস্তায় সমান সমান করে ঢেলে নিতে। তাহলেই তাে যুৎসই হতাে। এতে বস্তা ওঠানাে নামানাে যেমন সহজ হতাে, উটের কষ্টও কম হতাে।

এই গ্রাম্য আরব লােকের বুদ্ধিসুদ্ধি আসলেই কম ছিলাে। পথচারী সঙ্গীর কথা শুনে বলে উঠলাে, বাহবা, সুন্দর বুদ্ধিতো তােমার। শত চিন্তা ফিকির করেও আমার বুদ্ধি এতদূর পৌঁছায়নি। বােঝা যাচ্ছে তুমি একজন বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও মহাপুরুষ।

পদচারীঃ না, না, ওসব কিছু নই। তবে ভাই এটাতাে খুব সহজ হিসাব।

সওয়ারীর মন কিন্তু নরম হয়ে এসেছে। ভাবলাে, এই জ্ঞানী লােকটিকে উটের পিঠে চড়ানাে মন্দ হবে না। খানিকক্ষণ চিন্তা করে জিজ্ঞেস করলাে, হে জ্ঞানী মহাপুরুষ, আসলে তুমি কে? এতাে জ্ঞান বুদ্ধি যেহেতু আছে সেহেতু নিশ্চয়ই তুমি কোন উজির-নাজির, আমীর-ওমরাহ হবে। নিশ্চয়ই কোন মহাপুরুষ তুমি।

পদচারী বললাে, না ভাই, আমি অন্যদের মতাে একজন সাধারণ পথিক। বিদ্যাবুদ্ধিও তেমন কিছু নেই। আমার অবস্থাতাে দেখতেই পাচ্ছাে। পােষাক-আশাকও সাদাসিধে, অন্যসব মানুষের মতাে।

সওয়ারী বললাে, না, তা মােটেই হতে পারে না। এতসব আক্কেল বুদ্ধি দিয়ে নিশ্চয়ই বহু ধনসম্পদের মালিক হয়েছো। শুধু সখে সখে পায়ে হাঁটছো। সুখি ও মুক্ত মানুষ তাে, চিন্তা ভাবনার বালাই নেই। দেখাে দিকিন কতাে সহজে গম বােঝাই করার এতো বড় সমস্যা সমাধান করতে পারলে।

পদচারী এ কথা শুনে বললাে, প্রকৃত কথা হলাে ভাই এই ইহজগতে আমার কানাকড়ি অর্থও নেই। এই যে এখন তােমার সাথে সাথে চলছি দেখতে পাচ্ছাে, অথচ জানি না আগামীকাল আমার ভাগ্যে কি আছে, কি কাজ করবাে আর কিইবা খাবো!

সওয়ারী জবাব দিলাে, হয়তাে দোকান পাট আছে, যন্ত্রপাতি আছে কিংবা নগদ অর্থ না থাকুক ধনসম্পদ আছে। আসল কথা হলাে জ্ঞানী লােকের ক্ষমতাও আছে। ধনসম্পদ ও ভাগ্য জ্ঞানীদের থাকেই। কথায় বলেঃ “জ্ঞানী যে ধনী সে।”

পদচারী বেচারা বললাে, তাও নয়। দোকান থাকলে তাে তাতেই বসতাম, কারবার করতাম। এই মরু বিজনে পায়ে হাঁটার কোন দরকারই ছিলাে না।

সওয়ারী বললাে, বুঝতে পারছি তুমি নিজের পরিচয় দিতে চাও না। হয়তাে বা তােমার অসংখ্য উট, গরু ও ভেড়া-বকরী রয়েছে, এখন রাখাল খােঁজ করতে চলেছো। সে যাই হােক তােমার মতাে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মানুষের ভাগ্য নিশ্চয়ই সর্বোত্তম।

পদচারী মন খুলে জবাব দিলাে, আসলে কি জানাে ভাই, আমার গরু-ঘােড়া, উট-গাধা, ভেড়া-বকরী, দোকান-পাট ও অর্থকড়ি কিছুই নেই। তবে একেবারে বদ্‌বখ্‌ত নই। কিন্তু দুনিয়াবী কোন সহায় সম্পদ আমার নেই। আমার স্বাস্থ্য বেশ তালাে। কাজ করি, রুজি-রােজগার করে খাই। আজ কাজ নেই, বেকার। তাই সামনের শহরে যাচ্ছি কাজের খোঁজে। তুমি যে জ্ঞান ও বুদ্ধির কথা বলছো তা আমার যৎসামান্য সাধারণ জীবন পরিচালনা ব্যতীত আর কিছুই দিচ্ছে না। বৎস, আর কিছুই না।

সওয়ারী তাজ্জব হয়ে বললাে, এ্যাঁ, তুমি দেছি একেবারে নিঃস্ব ফতুর মানুষ। বেশ অভাগা মানুষ তুমি। এই যে দেখছাে আমার এক বস্তায় গম আর অন্য বস্তায় মাটির ঢেলা এবং জ্ঞানবুদ্ধি বলতে কিছুই নেই তবুও তাে আমার বাড়িতে দশটি উট, একশাে ভেড়া ও পঞ্চাশটি গরু রয়েছে। দুটি বড় বড় কৃষি জমি আছে, গমের গােলা, চাকর-চাকরানী রয়েছে। সবাই ইজ্জত সম্মান করে। জুতা, কাপড়-চোপড় আর দশ বারাে কামরার বাড়ি আছে। কোন সভা-সমিতিতে গেলে উঠে দাঁড়ায়, সালাম জানায়। আরামের নিশ্চিন্ত জীবন কাটাচ্ছি। শহরের জনকল্যাণ সমিতির মেম্বার আমি। আমা বাড়ির একটি কামরা শুধু পুরানাে আমলের পান্ডুলিপিতে ভর্তি। পাড়ার মােল্লা মুন্সী তা দেখে ঈর্ষা করে। আর এসব কিছুতাে আমার এই অল্প বুদ্ধি দিয়েই করেছি। অথচ তুমি গম বােঝাই করার এতাে কঠিন হিসেবটি সহজে সমাধান করার মতাে এতাে বেশী জ্ঞানবুদ্ধি মাথায় রেখেও একেবারে নিঃস্ব ফকীর? তাহলে এতােসব জ্ঞানবুদ্ধি ও লেখাপড়ার ফায়দা কি? জ্ঞানবুদ্ধির অর্থ যদি এই হয় যে, ফালতু খেয়াল খুশীমতাে যেদিকে মন যায় সেদিকেই নির্ভাবনায় হেঁটে হেঁটে হেলেদুলে চলবাে তাহলে সত্তর বছর মূর্খ নাদান থাকাও উত্তম। আসলে আমার কৃষিজমিতে শ্রমিকের প্রয়ােজন। কিন্তু তােমাকে নিতে আমার বড়ই ভয় হচ্ছে। আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও, তােমার পােড়া কপাল হয়তাে আমার ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। “ফলহীন বুদ্ধি অভিশাপ।”

পদচারী বললাে, ঠিক আছে, আমি অন্যপথেই যাব। তবে তুই ব্যাটা যা কিছু বলেছিস তাতে আমার দৃষ্টিতে তুই এক আহাম্মক, বেআক্কেল ও হতভাগা বই আর কিছুই নস। এতােসবের কথা যা উল্লেখ করেছিস সবই টাকা দিয়ে কিনেছিস, নতুবা তুই নিজে এক গর্ধভের বেশী আর কিছুই না। আমি কখনাে তাের মতাে গাধা গরু হতে চাইনে।

এ কথা বলেই পদচারী ভিন্ন পথ ধরে দূর হয়ে গেলাে। ঘটনাচক্রে উট সওয়ারী যখন কিছুদূর পথ চললাে অমনি বিপরীত দিক থেকে দুই ঘােড় সওয়ারের দেখা পেলাে। ওরা ছিলাে ডাকাত। তাকে দেখেই ডাকাতেরা জিজ্ঞেস করলাে, বল্ ব্যাটা উটের বােঝায় কি নিচ্ছিস?

সওয়ারী চাষা জবাব দিলাে, এই কিছুক্ষণ আগেও আমার সাথে এক সঙ্গী ছিলাে। সে বলে গেলে আমি নাকি এক বুদ্ধিহীন হতভাগা। হয়তাে বা তাই। তাহলে হতভাগার উটের বোঝাতেও বুঝতেই পারছাে কি থাকবে।

ডাকাতদের একজন চাকু বের করে বস্তা দুটির একটি এক ঘায়ে কেটে ফেললাে। ঘটনাক্রমে বস্তাটি ছিলাে বালি আর মাটির ঢেলার। এসব দেখে ডাকাতের দল সওয়ারীকে উটের ওপরই কয়েকটি লাথি লাগিয়ে সামনের দিকে চলে গেলাে। যাওয়ার সময় বলে গেলােঃ আসলেই তুই এক গাধা। মরুভূমি ঢেলাবালিতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে, অথচ তুই কিনা উটের ওপর এসব বােঝাই করেছিস। ব্যাটা গরু কোথাকার!

ডাকাতের দল চলে যেতেই আরব চাষী তার গমের বস্তা হাতছাড়া না হওয়াতে হাসিতে ফেটে পড়লাে। আনন্দ উল্লাসে বলতে লাগলাে, “এরকম বোকামী হাজার ভালাে। জিন্দাবাদ এ বােকামী। বােকার মতাে বালি আর ঢেলা বােঝাই না করলে আমার কষ্টের উপার্জন গমের বস্তাই ডাকাতের হাতে পড়তাে।’’

এরপর থেকে মানুষ সব সময়ই দেখতে পেতাে এই আরব চাষী একশাে উট বােঝাই করলেও এক পাশের বস্তায় গম ও অন্য পাশের বস্তায় ঢেলা বালি বােঝাই করছে। কারাে উপদেশই মানতাে না। কারাে বুদ্ধি পরামর্শে কান দিতাে না। মানুষ তার বুদ্ধির বহর দেখে হাসি-তামাশা করলে জবাবে সে বলতাে “আমি এমন কিছু জানি যা তােমরা জান না।”

মানুষ সবসময়ই এই চাষী বেচারাকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতাে কিন্তু সে তার এই জ্ঞান নিয়েই খুশী ছিলাে যে, সে এমন কিছু জানে যা অন্যরা মােটেই জানে না।


লেখকঃ মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী” কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।

No comments:

Post a Comment