Wednesday, November 28, 2018

দোকানী ও তােতা

সে অনেক আগের কথা। এক ছিলাে মুদি। তার ছিলাে খুব সুন্দর একটি তােতা পাখি। তােতাটি যেমনি সুরেলা কন্ঠে কথা বলতো তেমনি ছিলাে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। মুদির দোকানে অনেক দিন থাকার ফলে খদ্দেরদের সবাইকে বেশ ভালাে করে চিনে ফেলেছে এই পাখি। খদ্দেরদের দেখলেই “আসসালামু আলাইকুম” বলে, ভালমন্দ জিজ্ঞেস করে, আরাে কতাে কি! দোকানী কোন প্রয়ােজনে বাড়ি গেলে দরজার সামনে তােতার খাঁচাটি ঝুলিয়ে রেখে যেতাে। তােতা বুঝতাে যে, দোকানী যদি দোকানে না থাকে তাহলে খরিদ্দারদের উচিত নয় দোকান থেকে কিছু নেয়া। তাই দোকানীর অনুপস্থিতিতে কোন ক্রেতা এলে তােতা তাকে সালাম দিয়ে বলতাে, “কিছুক্ষণ বস, দোকানী এখনি ফিরবে।”

যারা তােতার চেনাজানা ছিলাে তারা তােতার কথা মতােই অপেক্ষা করতো। কিন্তু অচেনা ক্রেতারা তােতার কথাবার্তা ও হাবভাব দেখে মনে করতাে এ তােতা যেমন তেমন তােতা নয়--একেবারে মানুষের মতাে পাহারাদার। তাই হয় তারা অপেক্ষা করতাে নয়তাে বা চলে যেতো। পরে দোকানী ফিরে এলেই যে যার বস্তু ক্রয় করতাে।

সে যাক, একদিনের ঘটনা বলি। একদিন দোকানী তােতাকে সঠিকভাবে বুঝিয়ে গেলাে যে, বাইরে কাজ আছে, কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরবাে। দোকানী চলে যাওয়ার পর এক অচেনা বিড়াল এসে ঢুকলাে দোকানে। হঠাৎ ইঁদুরের সাড়া শব্দ পেয়েই বিড়াল ঝাঁপিয়ে পড়লাে ইঁদুরের ওপর। তােতা এর আগে কখনাে বিড়ালের এরকম হামলা দেখেনি। তাই জানের ভয়ে লােহার খাঁচার দরজা পথে পাখা ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে এলাে এবং ঘরের নিরাপদ কোণে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করলাে। কিন্তু তার পায়ের শিকল ছুটে লাগলাে বাদাম তেলের বােতলে। বােতল কাৎ হয়ে পড়ে গেলে তেলও মাটিতে পড়ে যায়। বিড়াল তােতার পাখা ঝাপটা ও উড়াউড়ি দেখে ভয় পেয়ে দোকান ছেড়ে পালালাে। তােতাও গিয়ে বসলাে তার পিঞ্জরায়।

দোকানী বাড়ি থেকে ফিরে গদিতে বসলাে। প্রথমতঃ ঘটনার কিছুই বুঝলােনা। কিন্তু খানিকক্ষণ পর ভালাে করে তাকাতেই দেখলাে তেলের বােতল ভাঙ্গা ও তেল মাটিতে পড়ে গেছে। পাশে তােতার পাখার পালক কয়টিও পড়ে আছে। সে ভাবলাে তােতাই বুঝি বােতল ভেঙ্গেছে। তাই তার মেজাজ গেলাে চটে। তােতাকে ধরে কয়েকটা বকা দিলাে। বললাে, হে দুষ্ট পাখী, শেষ পর্যন্ত আমার তেলও ফেললি বােতলও ভাঙ্গলি! দেখ, তােকে কেমন মজা দেখাই। এ কথা বলেই হাতের কাছের বেত দিয়ে তােতার মাথায় কয়েকটা ঘা লাগালাে; এরপর এক ঢিলে ছুঁড়ে মারলাে দোকানের এক কোণায়।

বেতের পিটুনীতে তােতার মাথা ফেটে গেলাে এবং মাথার চামড়া গেলাে কেটে। কিছুক্ষণ পর দোকানীর মাথা ঠাণ্ডা হলে তােতাকে মারধর করার জন্য অনুতপ্ত হলাে। কিন্তু তােতা জানতাে যে, সে নির্দোষ বেগুনাহ। অথচ তাকে বকা ঝকা করা হলাে এবং বেত লাগালাে। তাই অপমানে কথা বলা দিলাে বন্ধ করে। দোকানী তােতার মাথা পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিলাে। কিছু দিনের ভেতর তােতার মাথার ঘা ভালাে হয়ে নয়া চামড়া দেখা দেয়। কিন্তু মাথার উপরিভাগে চুল না ওঠায় টাক পড়ে যায়। তােতার রাগ কিন্তু মােটেও কমেনি। তাই কথা বলা একেবারে বন্ধ করে দিলাে।

দোকানীর পরিচিত ক্রেতারা যতই আসা-যাওয়া করুক ও তােতার সাথে কথা বলুক না কেনো কোন ফায়দা হলাে না। দোকানী এরকম অবস্থায় বেশ দুঃখিত হলাে। কেননা, তােতাকেই সে তার দোকানের উন্নতির কারণ বলে মনে করতাে। তােতার কথাবার্তা শুনার জন্যই লােকজন এ দোকানে ভীড় জমাতো ও এখান থেকে সওদাপত্র খরিদ করতাে। তােতাকে মেরে দোকানী খুবই আফসােস করতে লাগলাে। তােতাও তার রাগ ও জেদের বশে চুপচাপ থাকতে লাগলাে।

দোকানীর বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতরা দোকানীকে জিজ্ঞেস করতাে যে, কেনো তােতা আর কথা বলে না, তার মাথায় কি হয়েছে? দোকানী জবাব দিতাে, একদিন বাড়ী থেকে ফিরে দেখি তােতা তেলের বােতল ভেঙ্গে সব তেল মাটিতে ফেলে দিয়েছে। আমি রাগে বেত দিয়ে তার মাথার ওপর পিটুনি দিলাম। এর ফলেই তােতার এ অবস্থা। মাথায় যেমন টাক পড়েছে তেমনি কথাও বন্ধ হয়ে গেছে। এ ভাবেই কিছু দিন কেটে যায়। দোকানী ক্রেতাদের বিভিন্ন প্রশ্নে যা বলেছে ও বলছে তাহলাে “তােতা তেলের বােতল ভেঙ্গেছে, তাই পিটুনী খেয়েছে আর এতে তােতার মাথায় টাক পড়েছে। এ কথাগুলাে তােতা মনে মনে প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছে। সে প্রায়ই আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের টাকু মাথাটি লক্ষ্য করতাে আর মনে মনে আওড়াতাে বােতল ভেঙ্গেছে, মার খেয়েছে; মার খেয়েছে, টাকু হয়েছে ইত্যাদি। তবে তােতা কথা বলতাে না।

দোকানী তােতাকে কথা বলানাের বহু চেষ্টা চালাতে লাগলাে। ক্রেতা বন্ধুরা দোকানে আসলেই তােতার কাহিনী জুড়ে দেয়, তােতা কি কি বলতো, কি গান গাইতাে, কোন্ কিচ্ছা ইনিয়ে বিনিয়ে মজা করে বলতো প্রভৃতি। কিন্তু তাতেও তােতা মুখ খুলছে না। তােতাকে দোকানী খুব আদর আপ্যায়ন ও ভাল ভাল খাবার দিতে লাগলাে। তাহলে কি হবে সবই ব্যর্থ। তােতা জানতো যে, সে বােতল ভেঙ্গেছে, মার খেয়েছে ও মাথায় টাক পড়েছে। তাই চুপ করে থাকাই তার জন্য শ্রেয়।

একদিন দোকানীর কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশী দোকানে বসে গল্প মারছিলাে। তাদের মধ্যে একজন ছিলাে টাক মাথার। মাথায় একটি চুলও নেই। এই লােকটি গল্প-গুজব সেরে চলে গেলে উপস্থিতদের একজন বললাে, আমি তাকে আগে দেখেছি। কয়েক বছর পূর্বেও তার মাথায় অনেক ঝাঁকড়া জুলফী চুল ছিলাে। বেশ দেখার মতাে চুল। কিন্তু জানিনে কি কারণে তার মাথার চুল ওঠে গেলাে এবং বিরাট টাক পড়লাে?

তার এ কথার মাঝে হঠাৎ তােতার যবান খুলে গেলাে। বললাে, "আমি জানি কেনো তার মাথায় টাক পড়েছে। সে তেলের বােতল ভেঙ্গেছে, পিটুনি খেয়েছে আর তাই মাথার চুল ওঠে টাক পড়েছে।"

তােতার এ কথা শুনে দোকানে বসা সবাই জোরে হেসে একেবারে গড়াগড়ি। তারা বুঝতে পারলাে যে, তােতা সেই প্রথম থেকেই যেহেতু তার মাথা নিয়ে ভেবে এসেছে সেহেতু টাক মাথার কাউকে দেখলে তার মাথার ঘটনার সাথেই তুলনা করে নিচ্ছে।

দোকানী তােতার মুখে কথা ফুটতে দেখে খুশিতে আত্মহারা। বন্ধুদের বললাে, “তােতার এ কথা আমাদের সবাইকে একটি সুন্দর শিক্ষা দিয়েছে। আমরাও অনেক সময় নিজেদের হাল অবস্থা দিয়ে অন্যদের বিচার করে থাকি। যেমন কেউ হয়তাে খারাপ কাজ করেছে এবং জেলে আটক হয়েছে। এখন অন্য কোন লােকও যদি তদ্রুপ জেলে আটকা পড়ে তখন ভেবে নেই যে, তার মতােই বােধ হয় একই ধরনের অপরাধ এই ব্যক্তিও করেছে। কেউ নিরপরাধভাবে বন্দী হলে সেও হয়তাে অন্য বন্দীদের সম্পর্কে ধারণা করে বসে যে, তারাও হয়তাে তার মতােই বেগুনাহ নিরীহ মানুষ। আসলে একজনের সাথে আরেকজনের ঘটনার হুবহু তুলনা চলে না, বরং ওল্টো ব্যাপারও হতে পারে।”

লেখকঃ মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী” কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।

No comments:

Post a Comment