অনেক অনেক আগের কথা। একদিন এক লােক হযরত
মূসা আলাইহেসসালামের দরবারে এসে হাযির হলাে এবং বললাে, হে মূসা নবী! আমি
বহু বছর ধরে আপনার উপর ঈমান এনেছি কিন্তু আপনার ধর্ম থেকে কোন ফায়দা
পাইনি। আজ আপনার কাছে একটি আবেদন নিয়ে এসেছি।
হযরত মূসা জিজ্ঞেস করলেন, বলো তুমি কি চাও। যদি পারি তাহলে পূরণ করতে চেষ্টা করবাে।
আগন্তুক বললাে, আমি চাই আল্লাহ আমাকে পশুপাখির ভাষা শিক্ষা দিন। আমি পশুপাখির কথাবার্তা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ লাভ করতে আগ্রহী।
মূসা নবী বললেন, আমি কৃপণ নই, তবে এ কাজ তােমার জন্য মঙ্গলজনক নয়। তুমি
তাে তােমার যে আক্কেল বুদ্ধি আছে তা খাটিয়ে নিজের ও বন্ধুদের জীবনী,
বইপত্র, লেখনী ও অন্যান্যদের জীবনী অধ্যয়ন করে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারাে।
তুমি কি মনে করছো, সবার থেকেই শিক্ষা গ্রহণ শেষ করে ফেলেছো যে, এখন
পশুপাখি থেকে শিক্ষা গ্রহণের পালা এসে গেছে? যাও, মানুষের যে ভাষা তােমার
জানা আছে তা থেকেই যত পারাে উপদেশ গ্রহণ করাে---এটাই তােমার সারা জীবনের
জন্যে যথেষ্ট হবে। কিন্তু পশুপাখির ভাষা জানা একটি বাজে চিন্তা,
লােভ-লালসার ফল। জেনে রেখাে অতি লােভ মানুষকে বিপদে ফেলে।
লােকটি
বললাে, না বাবা, আমি তাে পশুপাখির ভাষা শিখে ব্যবসা করতে চাইনে। শুধু জানতে
চাই এরা কি কি কথা বলে। আমার ঘরে কুকুর আছে, হাঁস-মুরগী আছে, ঘােড়া-গাধা
আছে, ছাগল-ভেড়া আছে। আমার কথা হলাে, ওরা পরস্পর কি কথা বলে শুধু তাই জানা।
এ ছাড়া ওদের কথাবার্তা থেকে নিজের চরিত্র সংশােধন করাই আমার আসল
উদ্দেশ্য।
হযরত মূসা আলাইহেসসালাম বললেন, ভালাে কথা, তুমি তাে
জ্ঞান লাভ করতে চাও, তাই না? আমিও বহু কিছু জানতে আগ্রহী, কিন্তু যখন দেখি
যে, কোন কোন জ্ঞানে আমার মঙ্গল নেই তখন তা জানতেও চাইনে। এসাে, আমার কথা
শােন, এই বাজে খেয়াল ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজ করােগে। অতো বেশী চালাক-চতুর
হতে চেয়ো না, অতি চালাকের গলায় দড়ি।
লােকটি নাছােড়বান্দা,
বললাে, হে রাসূল, আমার যে শান্তি নেই, মনটা খালি ছটফট ছটফট করে, পশুদের
ভাষা যে আমার জানতেই হবে। এ জন্যে প্রয়ােজনে না হয় বিপদাপদ ও বালামুছিবতও
মাথা পেতে নেবাে। আপনি তাে বখিল বা কৃপণ নন, আল্লাহর কাছে মুনাজাত করুন,
আমাকে যেনাে অন্ততঃপক্ষে মােরগ ও কুকরের ভাষা হলেও শিক্ষা দেন। এ দুটোতেই
আমি রাজি।
হযরত মূসা নবী বললেন, ঠিক আছে। বিপদাপদই যখন মাথা পেতে
নিতে রাজি আছো তাহলে যাও, আমি দোয়া করছি, আল্লাহ তােমাকে মােরগ ও কুকুরের
ভাষা শিক্ষা দিন। তবে শুনে যাও, এতে যদি তােমার কোন ক্ষতি হয় তাতে কিন্তু
আমি দায়ী নই।
লােকটি খুশীতে গদ গদ হয়ে বাড়ি চলে গেলাে। সারাটা
রাত সুখস্বপ্নে কাটিয়ে দিয়ে ভােরে খুব তাড়াতাড়িই জেগে উঠলাে। চাকরদের
হুকুম দিলাে, যাও আমার নাশতা নিয়ে এসাে, সাথে সাথে ঐ কুকুর ও বড় মােগরটিও
আনতে ভুল করাে না।
একজন চাকর গিয়ে মনিবের আদরের কুকুর ও বড়
মােরগটি নিয়ে এলাে। ইতিমধ্যে নাশতাও হাযির। মনিব দস্তরখানায় বসে নাশতা
খাওয়া শুরু করলাে। এক টুকরাে রুটি ছুঁড়ে দিলাে কুকুরের দিকে। রুটির
টুকরাে দেখামাত্রই মােরগ লাফ দিয়ে ছুটে এসে মুখে লুফে নিলাে৷ কুকুরটি এতে
আপত্তি জানিয়ে বললাে, আজব বদ চরিত্রের মােরগ তাে তুই। গম খাস, যব খাস,
ভুট্টা খাস, মাছ খাস, কীটপতঙ্গ খাস, বাগানে বাগানে ঘােরা ফেরা করিস,
পােকামাকড় খাস, আরাে কতাে হাজার হাজার কিছু। ভালাে করেই জানিস যে, ঐ
সামান্য রুটি ছাড়া আমার ভাগ্যে আর কিছুই জুটে না---আর সেই এক টুকরাে রুটিও
লুফে নিলি। আমাকে দিলিনে যে খাবাে!
মােরগ বললাে, রাগ করিসনে ভায়া।
আজ ধৈর্য কর, কাল তাে তাের খুশীর দিন। তাের কাছে তাে গােশত সবচে' মজার
জিনিস তাই না! আগামীকাল মনিবের ঘােড়াটি হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাবে।
তখন তাের মন যতো চায় গােশত খেতে পারবি। আমি তাে গােশত খাই না। কুকুর শান্ত
হয়ে বললাে, আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, কথাটা আমার মনে ছিলাে না। যা ব্যাটা
রুটি তুইই খেয়ে নে।
পাশে বসা মনিব তাজ্জব হয়ে ওদের কথা শুনলাে এবং
মনে মনে বললাে, আজব ব্যাপার, তাহলে আমার ঘােড়াটি কাল মারা যাচ্ছে। বেশ
ভালই হলো বিষয়টি জেনে গেলাম। পশুপাখীদের ভাষা জানার ফায়দা তাে এটাই! এ
কথা ভেবেই মনিব ঘােড়া পালককে ডেকে পাঠালাে এবং বললাে, জল্দি ঐ ঘােড়াকে
বাজারে নিয়ে যা আর যে দামে পারিস বিক্রী করে ফেল।
ঘােড়া পালক
বাজারে ঘােড়াটি নিয়ে গিয়ে বিক্রী করে মনিবকে বিক্রিলব্ধ টাকা বুঝিয়ে
দিলাে। মনিব টাকা পেয়ে খুশী হলাে এ কারণে যে, তার আর ক্ষতি হলাে না।
সেদিন গেলাে। পরেরদিন নাশ্তা খাওয়ার সময় মনিব ইচ্ছে করেই এক টুকরা রুটি
কুকুরের সামনে ছুঁড়ে মারলাে। কিন্তু মােরগ এক লাফে তা লুফে নিলাে। কুকুর
বললাে, এ কি কাণ্ড, আজও নিয়ে গেলি! গতকালতাে বড় গলা করে বলেছিলি মনিবের
ঘােড়া মারা যাবে আর আমি মজা করে খাবাে। কিন্তু কই! মনিব তাে ঘােড়া বিক্রী
করে দিলেন। আজও তুই আমার ভাগ ছিনিয়ে নিলি, আমাকে যে দুপুর পর্যন্ত
একেবারে উপােস থাকতে হবে।
মােরগ বললাে, আরে ভাই আমি কি মিথ্যা
বলেছিলাম? ঘােড়াটির তাে মারা যাওয়ারই কথা ছিলাে। কিন্তু মনিব তা বিক্রী
করে দিলেন। ঘােড়া মরলাে তবে খরিদ্দারের ঘরে গিয়েই মরলাে। সে যাক। যেহেতু
মনিবের মালের কিছু ক্ষতি হওয়ার কথাছিলাে তা হবেই। গতকাল না হয়েছে তাে কি
হয়েছে, এর বদলে আজ তার গাধাটি মারা যাবে। আর গাধার মরণ মানেই কুকুরের ঈদ।
আগামীকাল তুই পেট পুরে গােশত খাবি কিন্তু আমি একটুও খাবাে না।
কুকুর
একথা শুনে বললাে, ওহো! তাই তাে। আমার মােটেও স্মরণ ছিল না৷ ভালাে কথা
তাহলে রুটি আজও তাের পেটেই যাক। মনিব কুকুর মােরগের একথা শুনামাত্রই চাকরকে
ডেকে পাঠালাে এবং বললাে, শিগগির বাজারে যা, গাধাটি বিক্রী করে আয়।
চাকর মনিবের কথা মতাে গাধাটি বাজারে নিয়ে বিক্রী করে এলাে।
তৃতীয় দিন ভােরে নাশতার সময় কুকুর মােরগকে লক্ষ্য করে বললাে, তুই ব্যাটা
একেক দিন একেক কথা বলিস আর আমাকে মিছামিছি রঙ্গিন স্বপ্ন দেখাস। শুধু
বলিস, আগামী কাল এই হবে সেই হবে। কিন্তু গােশতের কোন খবরই নেই। পয়লা
দিনতাে কথা ছিলাে মনিবের ঘােড়া মারা যাবে, সে আশায় ছিলাম। কিন্তু মনিব তা
বিক্রী করে দিলেন। পরের দিনও গাধার মৃত্যুর আশায় উতলা হয়েছিলাম। কিন্তু
গাধাটাও বিক্রী হয়ে গেলাে। সুতরাং প্রত্যেকদিন সকালে আমার ভাগের রুটিটা
এসব আশা দিয়ে খেয়ে ফেলা তাের উচিত নয়। এ ঘরে আমারও তাে অধিকার আছে।
মােরগ বললাে, উচিত কথাই বলেছিস। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা মনিব কোথেকে
এতাে বড় চালাক-চতুর হয়ে গেলেন যে, প্রতিদিনই তার মালের ক্ষয়ক্ষতিকে
এড়িয়ে যাচ্ছেন ও দূর করে দিচ্ছেন নিজের উপর থেকে। যাক ভাই যার বদলা আছে
তার জন্য দুঃখ করার কি আছে। আজ প্রত্যুষে যখন আমি মুনাজাতে মশগুল ছিলাম তখন
শুনতে পেয়েছি যে, ঘােড়া ও গাধার বদলে এবার মনিবের পালের চারটা কালাে
দুম্বা মারা যাবে। যখন ওগুলাে মারা যাবে তখন তাে ওসবকে তুলে নিয়ে বিলে
ফেলে আসবে। তখন তুই গিয়ে যত ইচ্ছে গােশত খাবি, ব্যস।
কুকুর জওয়াবে
বললাে, আমিও তা টের পেয়েছি। কোন কোন ক্ষয়ক্ষতিকে একেবারে ঠেকানাে যায়
না, ঘােড়াকে বিক্রী করেছেন, গাধাকে বিক্রী করেছেন, এবার কালাে দুম্বাগুলাে
মারা যাবে। ঠিক আছে আজো না হয় ধৈর্য ধরবাে।
মনিব মােরগ ও কুকুরের
কথাবার্তা শুনামাত্রই রাখালকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, শীগগির যা, ঐ চারটে
কালাে দুম্বাকে বাজারে বিক্রী করে আয়। রাখাল মনিবের নির্দেশ মতাে তাই
করলাে। মনিব মনে মনে বললেন, পশুপাখির ভাষা শেখার এই তাে লাভ। বেশ খুশী হলাে
মনিব।
“খুশীতে মনিব আটখানা,
আদায় করে শােকরানা,
বলে আমার নেই ক্ষতি
উড়িয়ে দিলাম দুগর্তি |
শুপাখির ভাষা শেখার
বিরাট ভাল হলাে আমার
যেনাে কিনলাম হিরামােতি
বিকিয়ে দিয়ে সকল ক্ষতি।”
আরেকদিন সকালে নাশতার সময় মােরগ ও কুকুর যখন একত্রিত হলাে কুকুর মােরগকে
গালাগালি শুরু করলাে ও বললো, আজ কিন্তু আমার পালা। এতদিন আমিও তাের মতাে
কিছু কিছু বিষয় বুঝেছিলাম। কিন্তু সবই মিথ্যা প্রমাণিত হলাে। মনিব ঘােড়া
বিক্রী করলেন, গাধা বিক্রী করলেন, শেষ পর্যন্ত দুম্বাগুলােও বিক্রী করলেন।
আমি আর দুপুর পর্যন্ত উপােস করতে পারবাে না। মনিব খুবই চালাক। যে কোনভাবেই
ক্ষতিকে ঠেকাচ্ছেন।
মােরগ পাণ্ডিত্যের সাথে বললাে, আরে ভাই মনিবের
চালাকীর ওপর এতাে ভরসা করিসনে। অতি চালাকীর ফল ভালাে নয়। আজ তাে ওসবের
জায়গায় মনিব নিজেই মারা যাবেন। তখন মনিবের আত্মীয়-স্বজন ও জ্ঞাতি
গােষ্ঠী দান খয়রাত করবে, পােলাও-কোর্মা বিলাবে, খিচুড়ী খাওয়াবে, দুম্বা,
ভেড়া, গরু কোরবানী করবে, প্রচুর নেয়ামত ও খানাদানার জেয়াফত হবে, তাের
ভাগটা এবার হিসেব করে দ্যাখ।
কুকুর বললাে, রাখ তাের গলাবাজী। তুই কোথেকে জানলি একথা?
মােরগ বললাে, আজ শেষরাতে যখন মুনাজাত করছিলাম তখনই শুনেছি। জানিসতাে
মনিবের হায়াত এখনাে শেষ হয়নি। তার কাছে কিছু হারাম মাল ছিলাে এবং তার
কিছু রক্তও দূষিত ছিলাে। কারাে রক্ত দূষিত হয়ে পড়লে তার শরীরে নানা ধরনের
উপসর্গ ও রােগ দেখা দেয়। মাথা ঘুরে রগ ফেটে যায়, আরাে কত কি। তখন ঐ শরীর
থেকে দূষিত রক্ত বের করতে হয়। কথা ছিলাে মনিবের মালের ওপর দিয়েই বিপদ
চলে যাবে ও ঘােড়াটি মারা যাবে। কিন্তু মনিব বড় চালাকী করেছেন ও ঘােড়াটি
বিক্রী করে দিলেন। এরপর কথা ছিলাে সেই বিপদ গাধার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে উতরে
যাবে। মনিব গাধাটাও বিক্রী করে দিলেন। এরপর কথা ছিলাে তার চারটে দুম্বা
মারা যাবে, কিন্তু তাতেও মনিব বাধ সাধলেন। ঐসব ছিলাে মনিবের স্বীয় জানের
বিনিময়। মনিব যেহেতু সবটাতেই বাধা দিলেন সেহেতু এবার তার জানের ওপরই
মুছিবত নেমে আসবে। এবার তাে নিজেকে বিক্রী করতে পারবে না।
কুকুর বললাে, আজব! তাের কথাই ঠিক!
মােরগ বলল, হ্যাঁ, অতি চালাকীর শাস্তি যৌবনে মরণ। এবার ঠেলা সামলাক।
মনিব যেই একথা শুনলাে অমনি ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলাে। হাতের
নাশতার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে দিলাে ছুট হযরত মূসা আলাইহিসসালামের বাড়ির
উদ্দেশ্যে। তার আর দিকবিদিক খেয়াল নেই। পারে তাে উড়ে চলে। মনিব বেচারা
শেষ পর্যন্ত হাঁপাতে হাঁপাতে হযরত মূসা নবীর বাড়ী গিয়ে উপস্থিত হলাে এবং
হযরত মূসাকে দেখামাত্রই তার পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাে আর ফরিয়াদ
করতে লাগলােঃ হে মূসা আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান! আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে,
কপাল পুড়ে গেছে। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছি।
হযরত মূসা তাজ্জব হয়ে বললেন, হয়েছেটা কি বলো দেখি। কিসের ভয়? এতো আতঙ্কিত কেন?
লােকটি বললাে, ভয় অহেতুক নয়। আমি নিশ্চিত যে মাথার উপর বিপদ আসছে। এরপর
সে হযরত মূসা আলাইহেসসালামের নিকট সবকিছু খুলে বললাে এবং আরজ করলেন, হে
মূসা নবী! এখন বলুন কোন্ ছাই মাথায় ঢালবাে? আমি মরতে চাইনে, মরতে চাইনে। এ
বলে পশুপাখির ভাষাবিদ হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলাে।
হযরত মূসা
নবী বললেন, বাপু! আমি তাে তখনি তােমাকে বলেছিলাম পশুপাখির ভাষা জানা তােমার
জন্য ক্ষতিকর। এখন আমার করার কিছুই নেই। আমি আল্লাহর কাজে হাত দিতে চাইনে,
কারাে বাঁচা-মরার এখতিয়ারও আমার হাতে নেই। তােমার কথা অনুযায়ীই তােমার
কিসমতে ছিলাে যে, তােমার মালের কিছু ক্ষতি হবে কিন্তু তুমি তাতে বাধা
দিয়েছো। ওসব ছিলাে তােমার বিপদাপদের ঢালস্বরূপ। এখন নিজেই বিপদের হাতে
ধরা দিয়েছো। তুমি তাে নিজের চরিত্র ঠিক করার জন্যে পশুপাখির ভাষা শিখবে
বলেছিলে। কিন্তু উল্টো তা না করে বিপদ টের পেয়েই ঘােড়া, গাধা ও দুম্বা
বিক্রী করে দিয়েছো। আর এর বদলে স্বীয় বিপদকেই খরিদ করেছো। আল্লাহর কাজে
বাপু কারচুপি করার পথ নেই, আমার এখন করার কিছুই নেই। তবে এক কাজ করতে
পারাে।
লােকটি হযরত মূসার কথা কেড়ে নিয়ে বললাে, হে নবী, আমার জান এখন আপনার হাতে, আপনার হাতে পায়ে ধরে বলছি, বলুন আমাকে কি করতে হবে?
হযরত মূসা আলাইহেসসালাম বললেন, কথাতাে এটাই ছিলাে যে, ঘােড়া, গাধা ও
দুম্বাগুলাে তােমার জানের প্রতিরক্ষা ঢাল হবে। এখন এক কাজ করতে পারাে, যাও
ওগুলাের ক্রেতাদের কাছে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের কাছে গিয়ে ক্ষমা
চেয়ে তাদের ক্ষতিপূরণ করাে। তাদের কারাে একজনের টাকা অন্ততঃ ফেরত দাও আর
নিজেই এ ক্ষতিটা মেনে নাও, যদি তারা রাজি হয় তাহলে হয়তাে বা তােমার এই
বদ্বখ্তি বদলাতেও পারে।
লােকটি বললাে, হক কথা বলেছেন। এক্ষণি
যাচ্ছি, বলেই সে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চললো বাড়ি পানে। রাখালকে গিয়ে জিজ্ঞেস
করলাে, দুম্বাগুলাে কার কাছে বিক্রী করেছিস? রাখাল জানালাে, ঐ গ্রামের
কৃষক ইউনুসের কাছে।
ব্যস, মনিব দৌড়ালাে ইউনুছের বাড়ীর উদ্দেশ্যে। ইউনুছকে পেয়েই বললাে, ভাই ইউনুস তুমি কি গতকাল চারটি কালাে দুম্বা খরিদ করেছিলে?
ইউনুস জবাব দিলাে, হ্যাঁ, আমিই খরিদ করেছিলাম। কতইনা ভালাে হয়েছে ওগুলাে কেনায়। কারণ গতকালই সবকটা মারা গেছে।
মনিব বললাে, না, না কিসের ভালাে হলাে। বরং তােমার ক্ষতি হয়েছে এতে--বড়ই
খারাপ হয়েছে। এখন আমি এলাম তােমার ক্ষতিপূরণ করতে। তােমার টাকা ফেরত দিতে
চাই, তুমি আমার ওপর রাজি হয়ে যাও, কেননা আমি জানতাম যে, ওগুলাে বাঁচবে না।
কিন্তু ওগুলাে বিক্রয়ের পর আমি সত্যিই অনুতপ্ত হয়েছি।
ইউনুস
বললাে, আজ্ঞে না, টাকা ফেরত নেয়া অসম্ভব। যা ঘটেছে তাতেই আমি সন্তুষ্ট,
আমি বাবা বহুত খুশী। জানাে কেনো? আমি একজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম। আমি এ
দুম্বাগুলাে কিনে ওগুলােকে কাজীর বাড়ীতে ঘুষ হিসেবে দিতে চেয়েছিলাম যাতে
আমার পক্ষে রায় দান করেন। কিন্তু দুম্বাগুলাে মারা যাওয়ায় তা আর করা
হলাে না। পরে শুনতে পেলাম যে কাজী নয়া নির্দেশ জারি করেছেন, যে কেউ কাজীর
বাড়ীতে ঘুষ নিয়ে আসবে তাকেই যেনাে গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখা হয়।
কাজী আরাে বলেছেন, যে ঘুষ দিতে চায় সে হককে নাহক করতে চায়। আর এ অপরাধের
কারণে তার শাস্তি হওয়া আবশ্যক। দেখাে তা কতই না ভালাে হলাে যে,
দুম্বাগুলাে মারা গেলাে। তা নাহলে আমি এখন জেলখানায় পচে মরতাম। আল্লাহর
হাজার শুকরিয়া যে, এই ছােট ক্ষতির মাধ্যমে তিনি আমাকে বিরাট বিপদ থেকে
নাজাত দিলেন। আমার জন্যে এ দুম্বা কেনা বিরাট লাভজনক হয়েছে। তােমার টাকা
তােমারই থাকুক বাপু। আমি আচ্ছা শিক্ষা গ্রহণ করেছি। এ শিক্ষার মূল্য শত
দুম্বা আর হাযার স্বর্ণমুদ্রার চেয়েও দামী।
মনিব দেখলাে এখানে তার
মাথা গিয়ে পাথরে ঠেকেছে। তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে দৌড়াতে লাগলাে তার
চাকরের উদ্দেশ্যে। তাকে পেয়ে বললাে, শিগগির বল্ গতপরশু গাধাটা কার কাছে
বিক্রী করেছিস? সে জবাব দিলাে, ও পাড়ার ইলিয়াসের কাছে। মনিবের আর তর সইছে
না---সটান হাযির হলো ইলিয়াসের বাড়ি। ইলিয়াসকে বললাে, গত পরশু তুমিই কি
আমার গাধাটা কিনেছিলে?
সে জবাব দিলাে, জ্বী হ্যাঁ। আর কতই না
মঙ্গলজনক হয়েছে ঐ গাধা কেনা। কারণ বেচারা গাধা ঐ দিনই মারা গেছে। গাধা
মালিক বললাে, না, না, কিসের মঙ্গল হলাে! ইস! গাধাটা কিনা মারা গেলাে। অনেক
ক্ষতি হয়েছে তােমার। এখন আমি এলাম তােমার ক্ষতিটা পুষিয়ে দিতে। ঐ গাধাটা
আমার ছিলাে। আমি জানতাম যে, গাধাটা মারা যাবে। এসাে ভাই, তােমার টাকা তুমি
নিয়ে যাও আর আমাকে মাফ করে দাও।
ইলিয়াস কিন্তু বেঁকে বসলাে এবং
বললাে, অসম্ভব, যা ঘটেছে তাতেই আমি খুশী। কেনো জানাে? আমি গাধাটা এজন্যেই
খরিদ করেছিলাম যে, গাধার অভাবে আমি বেশ মনমরা ছিলাম। আমার কয়েকজন বন্ধুর
গাধা ছিলাে, তারা গত পরশু গাধায় চড়ে সফরে যাওয়া ঠিক করে। আমার যেহেতু
গাধা ছিলাে না তাই তাদের সাথে যেতেও পারছিলাম না। খুবই দুঃখ ছিলাে আমার।
কিন্তু ঐ দিন সকালেই সস্তায় গাধাটি পেয়ে খুশীতে আত্মহারা হয়ে যাই আর
বন্ধুদের খবর দেই যে, আমিও তাদের সাথে আসছি। কিন্তু পরদিন দুপুরেই গাধার
অবস্থা খারাপ হয়ে গেলাে এবং মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই মারা গেলাে। নিরাশ
হয়ে বন্ধুদের জানিয়ে দিলাম যে, আর আসা হলাে না, তােমরা চলে যাও। সত্যিই
এতে আমার মন একেবারে খারাপ হয়ে গেলাে, শেষ পর্যন্ত তারা চলে গেলাে। কিন্তু
তাদের কপাল বড়ই খারাপ। রাতের বেলায় মরু বিয়াবানে এক পাল নেকড়ে তাদের
ওপর হামলা চালায়। গাধাগুলােকে মেরে টুকরা টুকরা তাে করলােই বন্ধুদের
পর্যন্ত কামড়ে আহত করেছে। এখন তারা হাসপাতালে জান নিয়ে লড়ছে। এ খবর
পেয়ে আমি আল্লাহর হাযার শুকরিয়া আদায় করেছি যে, আমার গাধাটি সফরে
রওয়ানা হওয়ার আগেই মারা গেছে। নতুবা আমার অবস্থাও বন্ধুদের মতােই হতাে।
যদি অন্য কোন ভাল গাধা খরিদ করতাম আর তা মারা না যেতাে তাহলে তাে বন্ধুদের
সাথে সফর সঙ্গী হয়ে তাদের দশাই ভােগ করতে হতাে আমাকে। গাধা মারা গেছে তাে
ভালােই হলাে, জানে বেঁচে গেলাম। তাই বহুত খুশী আমি, আলহামদুলিল্লাহ। তােমার
টাকায় আমার কোন দরকার নেই। যদি গাধা বাবদ আরাে টাকা চাও তাও দিতে রাজি
আছি।
গাধার মালিক দেখলাে এখানেও তার কোন গতি হলাে না। দ্রুত ছুটে
গেলো ঘােড়া পালকের কাছে। বললাে, শিগগির বল্ কার কাছে ঘােড়াটা বিক্রী
করেছিলি। গােলাম জবাব দিলাে, পাশের গ্রামের ইব্রাহিমের কাছে। মনিব ছুটলাে
ইব্রাহিমের খােঁজে। ইব্রাহিমকে পেয়েই বললাে, ইব্রাহিম, তুমি কি সেদিন
ঘােড়া খরিদ করেছিলে? ইব্রাহিম বললাে, হ্যাঁ আমিই। কতোই না ভালাে হয়েছে যে
ঘােড়াটি কিনেছিলাম আর তা ঐ দিনই মারা গেলাে।
ঘােড়া মালিক বললাে,
না বাবা, কোথায় ভালাে হলাে? বিরাট ক্ষতি হয়েছে তােমার। জানাে, ঘােড়াটি
ছিলাে আমার, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ঘােড়াটি আর বাঁচবে না। তাই সেদিন
বিক্রী করে দিলাম। কিন্তু পরে অনুতপ্ত হয়েছি। এখন তােমাকে তােমার টাকা
ফেরত দিতে এলাম, তুমি আমাকে মাফ করে দাও ও রাজি হও।
ইব্রাহিম বললাে,
অসম্ভব। ঘােড়ার টাকা মােটেও ফেরত নিতে পারি না। ঘােড়াটি মারা যাওয়াতে
আমার বিরাট ফায়দা হয়েছে। যা হয়েছে তাতেই আমি অনেক অনেক খুশী। জানাে কি
কারণে? ঐ দিন পার্শ্ববর্তী শহরে আমার একটি জরুরী প্রয়ােজন পড়ে। একই পথের
একজন সফরসঙ্গীও মিলে গেলাে। তবে তার ঘােড়া ছিলাে, আমার ছিলাে না। তাকে
জানালাম, আমি ঘােড়ার খোঁজে আছি। পেয়ে গেলেই খরিদ করবাে আর এক সাথে
রওয়ানা হবাে। বাজারে গিয়ে সেই ঘােডাটি সস্তাদামেই পেয়ে গেলাম। কিন্তু
বাড়িতে আসার কয়েক ঘন্টা পরই ঘােড়াটি হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে পড়ে গেলাে
আর সাথে সাথে তার জীবন লীলাও শেষ। এতে আমার মন একেবারেই বিষন্ন হয়ে গেলাে।
সফরে আর যেতে পারলাম না। পরে শুনতে পেলাম যে, আমার সফরসঙ্গী সেদিনই
রওয়ানা হয়ে যায়। পথে ডাকাত দলের হামলায় পতিত হলে ডাকাতরা তার
ঘােড়াটিতো ছিনিয়ে নিলােই উপরন্তু তাকে পিটিয়ে মৃত্যুর দোরগােড়া পর্যন্ত
পৌঁছিয়েছে। এখন তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। ঘটনা শুনে আমি আল্লাহর হাজার
শুকরিয়া আদায় করেছি যে, আমার ঘােড়াটি মারা যাওয়াতেই আমি সফরে বের
হইনি। তা না হলে আজ আমার ভাগ্যে যে কি ঘটতাে তা খােদা মালুম। তাই তাে আমি
ঘােড়া মারা যাওয়ায় খুবই খুশী। আমার মালের উপর দিয়ে বালামুছিবত দূর হয়ে
গেছে।
ঘােড়া মালিক বললাে, হে ভাই, তােমার বিপদ যখন পার হয়ে গেছে
আর চিন্তা কি। এবার তােমার টাকা ফেরত নাও। আমি মৃত্যু পথযাত্রী। ঘােড়া
বিক্রী করে খুবই অনুতপ্ত, বিরাট বিপদে এখন পতিত হয়েছি, আমাকে তুমিই পার
উদ্ধার করতে।
ইব্রাহিম জবাব দিলাে, যেহেতু তুমি ঘােড়া মারা যাওয়ার
খবর জেনেও তা বিক্রীর চালাকী করেছো সেহেতু তােমার টাকা মােটেই ফেরত নেবাে
না। কোথা থেকে জানবাে যে টাকা ফেরত দেয়ার পেছনেও তােমার কোন ফন্দী ও
কুমতলব নেই। যা হবার হােক, অন্য পথ ধরাে। আমি আমার ক্ষতিতেই রাজি, তােমার
থেকে অনর্থক টাকা নেয়ার কোন প্রয়ােজনই আমার নেই।
পশুপাখির
ভাষাবিদ লােকটি এখানেও নিরাশ হলাে এবং মনে মনে বলতে লাগলাে, আবারাে ছুটে
যাবাে মূসার কাছে, একটা উপায় নিশ্চয়ই বের করতে হবে। এই লােকগুলাে
পশুপাখির ভাষা না জেনেও আমার থেকে অনেক অনেক বুদ্ধিমান। নিজের ভাষা থেকেই
তারা শিক্ষাগ্রহণ করছে। হায় হায়। আমিও যদি পশুপাখির ভাষা না জানতাম।
হতাশাগ্রস্ত লােকটি ছুটে চললাে তার বাড়ির পানে। বাড়ির কাছে এসেই দেখতে
পেলাে দেয়ালের ওপর তার পােষা মােরগটি বসে আছে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলাে
তার। মােরগকে লক্ষ্য করে বললাে, এই মােরগ, আমার যাবতীয় বালামুছিবতের জন্যে
দায়ী তুই। সারাজীবন আমার খাবার-দাবার খেয়ে কেনাে তুই এসব ভবিষ্যতবাণী
শুনাতে গেলি?
মােরগ জবাব দিলাে, আমরা আমাদের কাজ করেছি---তুই বেটা
যেখানে আদম জাতির ভাষা থেকেই শিক্ষাগ্রহণ করিসনে সেখানে কি কারণে পশুপাখির
ভাষা শিখতে গেলি?
এমনি সময় মনিব বেচারার অবস্থা শােচনীয় আকার ধারণ
করলাে। আছাড় খেয়ে পড়ে গেলাে মাটিতে। আর সাথে সাথেই জান চলে গেল জানের
মালিক আল্লাহর হাতে।
লেখকঃ মোঃ ফরিদ উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির “মসনবী” কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুবাদ কৃত।
[বিঃ দ্রঃ উক্ত ঘটনাটিকে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি তার মসনবী কাব্যগ্রন্থে
মূসা (আঃ) এর যুগের ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি উক্ত ঘটনাটিকে সম্মানিত
নবী ও রাসূল মূসা (আঃ) এর সাথে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত করেছেন। কিন্তু ঘটনাটির
কোনো গ্রহণযোগ্য রেফারেন্স উল্লেখ করেননি। কুরআন, কুরআনের তাফসীর ও হাদিস
গ্রন্থেও ঘটনাটির কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়না।
এছাড়া, ঘটনাটিতে এমন কিছু
কথার উল্লেখ পাওয়া যায় যা ইসলামী আকীদার সাথে সাংঘর্ষিক। যেমনঃ লােকটি হযরত
মূসার কথা কেড়ে নিয়ে বললাে, হে নবী, আমার জান এখন আপনার হাতে, আপনার
হাতে পায়ে ধরে বলছি, বলুন আমাকে কি করতে হবে?
হয় মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি নিজেই একথাটি লিখেছেন আর না হয় এটি অনুবাদের ভুল। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই এ ধরনের কথা গ্রহণযোগ্য নয়।
গল্পটিকে একটি সাধারণ শিক্ষামূলক গল্প হিসেবে গ্রহণ করার জন্য পাঠকমহলকে অনুরোধ করছি।]
No comments:
Post a Comment