আগেরকার দিনে
পশু-পাখির মতো মানুষও কেনাবেচা হতো। বিত্তবান ধনী লোকেরা দাসদাসী হিসেবে তাদের ক্রয় করতো। মনিব
ইচ্ছে করলে তাদের পুনরায় বিক্রি করে দিতে পারতো আবার কখনো অতিশয় সদয় হলে কোন
কোন দাসদাসীকে মুক্ত করে দিতো। একবার এক ধনী লোক বাজার থেকে দু’জন গোলাম ক্রয়ের নির্দেশ দিলে হাটে গিয়ে তার
লোকেরা দু’জন
গোলাম কিনে আনলো। একজনের দাম একশো দেরহাম এবং আরেকজনের দাম বিশ দেরহাম।
গোলামদের বাড়ি নিয়ে
আসা হলে মনিব একজনকে ডেকে পাঠালো। গোলামটি ছিল বেশ সুদর্শন যুবক,
গায়ের রঙ ফর্সা।
গোলাম মনিবের ঘরে ঢুকেই সালাম জানিয়ে কুর্নিশ অবস্থায়
দাঁড়ালো। মনিব জিজ্ঞেস করলেন তোর নাম কি?
গোলামঃ জামাল।
মনিবঃ বাহবাহ্,
খুব সুন্দর নামতো,
তুই নিজেও সুন্দর।
এরপর মনিব তাকে আরোও
অনেক প্রশ্ন করে এবং তার সাথে কথাবার্তা বলে বুঝতে পারলেন যে, সে বেশ চালাক চতুর, সুন্দর, কথাবার্তা বলতে পারে ও আদব-কায়দা জানে।
মনিব খুব খুশী হলেন এবং বললেন, তোকে
একশো দেরহাম দিয়ে কিনলেও তোর দাম কিন্তু হাজার দেরহাম হবে রে।
মনিব এরপর দ্বিতীয়
গোলামকে ডেকে পাঠালেন। তার চেহারা সুরত তেমন সুশ্রী নয়। অনেকটা বিশ্রিই বলা
যায়। সে এক কৃষ্ণকায় খাটো এবং দুর্বল ও শীর্ণদেহী যুবক। দেখতে খুবই মনমরা।
গোলাম ঢুকেই সালাম জানালো এবং মনিবের সামনে চৌকির উপর বসে পড়লো। মনিব
জিজ্ঞেস করলেন, তোর
নাম কিরে?
গোলামঃ কমাল।
মনিব বললেন, কমাল আবার নাম হয় নাকি?
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা
জামাল কিন্তু দ্বিতীয় গোলামের কথা বলার ধরনে হেসে ফেললো এবং মনিবকে বললো, সে বলতে চাচ্ছে তার নাম কামাল। কিন্তু
তার উচ্চারনে ভুল হয়।
মনিব বললেন, বেশ ভালকথা। ঠিক আছে। এরপর তিনি কামালকে
কটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন এবং তার উত্তরে বুঝলেন যে, কামাল বেশ বুদ্ধিমান ও বুঝ ক্ষমতার
অধিকারী। তবে কথা বলতে গেলে তার মুখে গন্ধ হয়। মনিব জামালকে বাইরে নিয়ে
যাওয়ার হুকুম দিলে জামাল বাইরে চলে গেলো। তখন মনিব কামালকে বললেন, মনে হচ্ছে তোর আক্কেলবুদ্ধি আছে। তোর
দাঁতগুলো খারাফ এতে মুখে গন্ধ হচ্ছে। একটু দূরে গিয়ে বস। খুব কম কথা বলবি।
তোকে ডাক্তারের কাছে পাঠাবো চিকিৎসার জন্য।
মনিব এরপর নির্দেশ
দিলেন জামালকে যেন হাম্মামে নিয়ে যাওয়া হয় এবং গোসলের পর কাপড়-চোপড় বদলিয়ে কাজের
জন্য তৈরি করা হয়।
প্রথম গোলামকে
হাম্মামে নিয়ে যাওয়ার পর মনিব দ্বিতীয় গোলাম কামালের সাথে
আরো কথাবার্তা বলে
তার চরিত্র ও আচার ব্যবহার সম্পর্কে পরীক্ষা নেয়া শুরু করলেন। মনিব বললেনঃ শুনেছি তোরা দু’জন এক বাড়িতে কাজ করতি। কি হলো যে তোদের বিক্রি
করে দিলো?
কামালঃ জানিনে কেনো।
তবে একদিন মনিব নির্দেশ দিলেন আমাদের যেনো বিক্রি করে দেয়া হয়।
হয়তো বা আমাদের চেয়ে আরো ভালো গোলাম পেয়েছেন কিংবা গোলামের প্রয়োজন শেষ হয়ে
গেছে। মনিবেরা তাদের গোপন কথা আমাদের কাছে বলেন না। আমরাতো গোলাম,
আমাদের বিশ্বাস করেন
না। আমাদের কাছে অবশ্য মনিব বদলে কিছু আসে যায় না।
সবখানেই গোলামী করি।
মনিবঃ ওখানে তোদের
জীবন কেমন কেটেছে? মনিবের
উপর রাজি ছিলিতো?
গোলামঃ আমাদের যা
অবস্থা তাতে রাজি হওয়ার কি আছে! মানুষ মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত রাজি হতে পারেনা। কিন্তু তবু
কাজ করে গেছি, অন্যদের
মতোই জীবন কেটেছে। কাজ করেছি খানা-দানা পেয়েছি। মনিবও বেকার ছিলেন না।
আমাদের সাথেই কাজ করতেন।
মনিবঃ এবার বল দেখি,
জামাল তোর সম্পর্কে
আমাকে যা বলেছে তা কি সত্য?
কামালঃ আমার মনে হয়
না আমার সহকর্মী আমার সম্পর্কে মিথ্যা বলবে। কারণ, আমি কখনো তার কোন ক্ষতি করিনি। সে যদি কিছু
বলে থাকে তাহলে হয়তো সত্য কথাই বলেছে।
মনিবঃ আমার কাছেতো
তোকে ভালই মনে হচ্ছে। তুই বেশ বুদ্ধিমান যুবক, জ্ঞান আছে তোর। কিন্তু সেতো বললো তুই
নাকি ইর্ষা পরায়ণ, অবিশ্বস্ত,
গোপনে খবর সংগ্রহ
করিস এবং বাইরের লোকদের বলে দিস্?
কামালঃ জামাল যদি
এসব বলে থাকে তাহলে হয়তো বা সত্যই বলেছে। জানি না আমি ইর্ষা পরায়ণ কিনা তবে
উন্নতি চাই, যারা
আমার চেয়ে ভালো তাদের নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি। এর নাম ইর্ষা হলে হতেও পারে। অবিশ্বস্ত কিনা
বলতে পারবো না, তবে
কেউ যদি আমাকে ফুসলাতে আসে ও মনিবের বিরুদ্ধে খিয়ানত করতে চায় তখন আমি এর
বিরোধিতা করি, তার
সাথে সহযোগিতা করিনা। এর নাম অবিশ্বস্ততা হয়তো বা বলা যেতে পারে। আমি গোপন
খবর সংগ্রহকারী কিনা জানিনে, তবে
আমাকে কোথাও কোন সংবাদ আনার জন্যে পাঠানো হলে ঐ বিষয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজ
খবর নিয়ে থাকি। সবকিছু বুঝে শুনেই সংবাদ নিয়ে আসি। তখন নিজের মতামতও
ব্যক্ত করি। এর নাম গুপ্তচরবৃত্তি বললে কথাটা সত্যই। জামাল হয়তো মিথ্যে কিছু
বলেনি। তাছাড়া কেউই তার নিজের দোষত্রুটি জানে না। আমিও না। জামাল
নিশ্চয় এগুলোই বুঝাতে চেয়েছে।
মনিবঃ যাক ওসব,
এখন বল দেখি জামালের
দোষত্রুটি কি কি? নিশ্চয়ই
তার সম্পর্কে তোর কথা থাকতে পারে। তুই সত্য কথা বললে আমি জামালের সাথে কি
রকম আচরণ করতে হবে তার সিদ্ধান্ত নেবো।
কামালঃ আমি তো তার
ভেতর তেমন কোন দোষত্রুটি দেখিনি। সেতো বেশ সুন্দর চেহারার যুবক। বেশ
আদব-কায়দা জানে। সবখানেই আমার থেকে তার কদর ও আদর বেশী।
তার দামও একশো দিরহাম আর আমার দাম মাত্র বিশ দিরহাম। আমার ধারনা তার ভেতর
এমন সব ভালো গুন আছে যা সবার চোখেই ধরা পড়ে। এ কারণেই তার মূল্য আমার মূল্য
থেকে কয়েকগুন বেশি। ভালমন্দ কখনো চাপা থাকেনা।
মনিবঃ বেশ ভালো কথা।
এবার বল দেখি এখানে আসতে পেরে কি সন্তুষ্ট হয়েছিস? এ স্থান কি আগের চেয়ে ভালো?
কামালঃ আমার দায়িত্ব
কেবল কাজ ও সেবা করা। যেখানেই থাকিনা কেনো এতে কোন ফারাক
নেই। তবে গোলাম ও ক্রীতদাস হওয়ায় এবং মুক্ত মানুষ নই বলে আমি রাজি নই।
কিন্তু আমার হাতে তো ক্ষমতা নেই। এছাড়া আজ এখানে নতুন এসেছি। তাই জানিনে
এখানে ভালো আছি না সেখানে ভালো ছিলাম। কিছুদিন গেলেই আমিও যেমন আপনাকে
অনেক চিনতে পারবো আপনিও তেমনি আমাকে চিনতে পারবেন। এখন কিছুই বলা যাবেনা।
তবে সব সময় চেষ্টা করবো আমার উপর যে দায়িত্ব দেবেন তা সুচারুরূপে সম্পন্ন
করতে।
কামালের ভদ্রতা ও
সত্যবাদীতায় মনিব মনে মনে বেশ খুশী হলেন ও তার প্রশংসা করলেন। এমন সময়
জামাল গোসল সেরে ও জামা বদলিয়ে চলে এলো। মনিব তার বৃদ্ধ গোলামকে নির্দেশ দিলেন
যাতে কামালকে এখনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। কামাল চলে গেলে মনিব জামালকে
পরীক্ষা করা শুরু করলেন। কামালকে যেরূপ প্রশ্ন করেছিলেন সেরূপ তাকেও
প্রশ্ন করতে লাগলেন। মনিব বললেন, শুনলাম তোরা দু’জন এক বাড়ীতে কাজ করেছিস। কিন্তু কি হলো
যে মনিব তোদের বিক্রি করে দিলো?
জামালঃ আমার কোন দোষ
ছিলনা। এই কামালটাই সব দোষের মূল। সে প্রথম থেকেই ছিলো অলস। এছাড়া মুখের উপর
কথা বলার বদঅভ্যাস তার আছে। মনিব তা অপছন্দ করতেন। তাই শেষ পর্যন্ত আমাদের
দু’জনকেই বিক্রি করার
সিদ্ধান্ত নিলেন। কেননা, আমরা দু’জন
এক সাথে বসবাস করতাম। তবে মনে হয়না যে আমার চেয়ে ভাল কোন গোলাম ক্রয় করতে পারবেন।
মনিবঃ ওখানে তোদের
জীবনযাত্রা কেমন ছিল? মনিবের
উপর রাজি ছিলি তো?
জামালঃ না বাবা,
কিসের জীবন? ওখানে কুকুরের মতো শুধু খেটে মরতাম।
এরপরও মনিব
শুধু দোষ ধরতেন। কামালতো কয়েকবার বলেই ফেললো, চল মনিবের অর্থকড়ি নিয়ে কেটে
পড়ি। কিন্তু আমি বলেছি, না,
তা অন্যায়। অবশ্য
শেষতক মনিবই কিনা বেইনসাফী করলেন। আমাদের বিক্রি করে
দিলেন। যাক, আমরা
তার অনিষ্টতা থেকেই উদ্ধার পেলাম।
মনিবঃ এই যে তোর
সহকর্মী কামাল তোর সম্পর্কে এতো সব বললো তা কি সত্য?
জামালঃ না, মোটেও না। আল্লাহর কসম সে মিথ্যা বলেছে।
আসলে সে একটা কমজাত বদমাশ। সব সময়ই আমার মন্দ খোঁজে বেড়ায়।
তার চেহারা থেকেই বুঝা যায় যে, সে একটা
অসৎ মানুষ। তার সে কালো চেহারা আর বিশ্রী শরীর দিয়ে যদি আমার বদনাম করে
বেড়ায় তাকি শোভা পায়? আসলে
তাকে দেখতেও মানুষের মত মনে হয়না। তার বাহ্যিক চেহারাই তার ভেতরের কথা বলে
দেয়। এই কুৎসিত লোকটির কথা কখনো বিশ্বাস করবেন না।
মনিবঃ আমার তো মনে হয়,
তুই একজন সদাচারী সৎস্বভাবের
যুবক। আমি সেই প্রথম থেকেই বুঝে নিয়েছি যে, তুই খারাফ নস। কিন্তু কামাল বললো যে, তুই নাকি ঈর্ষাপরায়ণ, অবিশ্বস্ত, খবরা খবর গোপনে
সংগ্রহ করে বলে দিস,
আরো কত কি।
জামালঃ দেখুন জনাব,
যখন আমি বলি যে,
কামাল একটা ছোটলোক
কমজাত তা তো তার এই সব কথা থেকেই বুঝা যায়। বরং কামালই ইর্ষাপরায়ণ। সে নিজেকে আমার চেয়ে ভালো
মনে করে। ঈর্ষার কারণেই তার গায়ের রং কালো হয়েছে। অবিশ্বস্ত ও বেঈমান তো এই
কামালই। সব সময়ই আমার বদনাম করে বেড়ায়। এছাড়া খবরা খবর খোঁজে বেড়ানোটা
তারই বদ অভ্যাস। যা সে জানতো সবই আপনার কাছে বলে দিলো যাতে আমাকে না
রাখেন। কিন্তু আমি তার সম্পর্কে যা জানি তা যদি বলে দেই তাহলে একঘন্টাও তাকে
রাখবেন না, বিক্রি
করে দেবেন। অর্ধেক দামে বিক্রি করতেও রাজি হবেন। কতো বড়
বজ্জাত ছেলে সে। চোর কোথাকার। লজ্জাও করে না আমার বদনাম রটাতে।
মনিবঃ ঠিক আছে,
এখন বল দেখি কামালের
দোষত্রুটি কি আছে। এতে করে তার সাথে কেমন আচরণ করতে হবে তার সিদ্ধান্ত নেবো।
কামালঃ কি আর বলবো।
তার আগাগোড়া সবটাই দোষে পরিপূর্ন। সে একটা দোষের হাঁড়ি। চেহারা যে কতো বিশ্রি তাতো
দেখলেনই। কথাও বলতে জানে না। আঞ্চলিক কথা বলে। নিজের নামটাও শুদ্ধ করে উচ্চারণ
করতে পারেনা। বলে কিনা কমাল। কোন কাজও জানে না। জানে কেবল মুখের উপর কথা
বলতে। একেবারে ঠোটকাটা যাকে বলে। সবার সম্পর্কে ও সব বিষয়েই তার বদনাম
করা চাই। কাল যদি তাকে কোথাও পাঠান তাহলে দেখবেন যে যত্রতত্র আপনার বদনাম
ছড়িয়ে এসেছে। এই কালো বিশ্রি চেহারার কামাল গলাবাজী ছাড়া আর কিছুই জানে না।
মনিবঃ যাক ওসব কথা।
এবার বল্ এখানে এসে খুশী হয়েছিস কিনা? এস্থান ভাল না মন্দ?
জামালঃ কি যে বলেন
প্রভু! আমি অতিশয় খুশী হয়েছি এখানে এসে। কোথায় আপনি আর কোথায় আগের মনিব! আপনি তো সোনার মানুষ,
দুনিয়ার সবার সেরা।
আমিতো সব সময় স্বপ্নে আপনার চেহারাই দেখতাম। আজ এখানে আসতে পেরে নিজের
কামনা-বাসনাকেই পূরণ করতে পারলাম। আমি তো আগের মনিবের
হাতে অতিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। এখানকার মতো ভালো জায়গাই হয় না।
মনিবঃ ঠিক আছে,
আমার যা জানার ছিলো
জেনে গেলাম। এখন বাইরে গিয়ে অপেক্ষা কর। কামাল ফিরে এলে কাজের নির্দেশ দেবো।
কামাল ডাক্তারের কাছ
থেকে ফিরে এলে মনিব জামাল ও কামাল উভয়কে ডেকে পাঠালেন। তাদের দু’জনকে লক্ষ করে বললেন, আমি তোদের দু’জনকেই পরীক্ষা করেছি। হে
কামাল, তোর
কোন দোষত্রুটি পাইনি। শুধু তোর আগের অবস্থাটা ভালো ছিলনা এবং তুই অসুস্থ ছিলি। তাই তোর মুখে গন্ধ
ও শরীর শীর্ণকায়। যাক তোকে ভালো করে চিকিৎসা করাবো এবং সব সময় আমার পাশে
থাকবি।
কিন্তু হে জামাল,
তুই তোর বাহ্যিক
চেহারা সুরতের কারণে খুব অহংকারী হয়ে গেছিস। সবাইকেই তোর নিজের মত বাহ্যদর্শী বলে মনে করিস।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বলে এসেছে “বাহ্যিক চেহারা কিছুই নয়, নিজের কার্যকলাপ ও স্বভাব চরিত্রকে
সুন্দর করো”। দেখ্
কামালের নিয়ত কতো ভালো। তার সহকর্মীর অবর্তমানেও সে কোন বেঈমানী করেনি
ও কোন বদনাম রটায়নি। আমি তাকে বিশ্বাস করছি। এখন থেকে তুই কামালের অধীনে
কাজ করবি। তোষামোদে ও অযথা প্রশংসা না করে কি করে সঠিক কাজ করতে হয় এবং
ভেতর ও বাহিরকে এক রাখতে হয় তার শিক্ষা কামালের কাছ থেকে গ্রহন করবি। এরপর
দেখা যাবে কি করা যায়। মোটকথা কামাল যা বলে তাই মেনে চলবি।
মনিবের বাড়ির পেছন
দিকেই ছিলো একটি বাগান। কামাল ও জামাল এ বাগানে নালা কাটার ও সেখানে পানি সরবরাহের কাজে
নিয়োজিত হলো। সেই প্রথম দিনই ঘন্টা খানেক কাজ করার পর জামাল বসে পড়লো নালার
পাশে এবং বললো, আর
পারিনে, ক্লান্ত হয়ে
পড়েছি। এ কাজ আমার দ্বারা অসম্ভব। এক খারাপ মনিবের হাতে এসে পড়লাম। চল্
দু’জনে মিলে এতো খারাপ
কাজ করি যাতে মনিব অতিষ্ট হয়ে আমাদের বিকিয়ে দেন। হয়তো এরপর ভালো কোন মনিবের হাতে
গিয়ে পড়বো।
কামালঃ জামাল! ও রকম
চিন্তে করবিনে। মন খারাপ করিসনে ভাই। আমিই না হয় বেশীর ভাগ কাজ করবো, তোর কাজও করে দেবো। মনিবের বদনাম করার
দরকার নেই। ধৈর্য্য ধর, সব
ঠিক হয়ে যাবে। কোথা থেকে জানবো যে, পরবর্তী মনিব আরো খারাপ হবে না?
জামালঃ এখন
যে ভাল মানুষ হয়ে গেছিস! কিন্তু মনিবের সাথে যখন একা ছিলি তখনতো আমার সম্পর্কে
এতো মন্দ বলেছিলি যে, শেষ
পর্যন্ত মনিব তোকে সর্দার বানিয়ে দিলেন।
কামালঃ না বন্ধু,
মোটেও তা নয়। এ ধরনের
খারাপ ধারণা করবিনে। যদি জানতে চাস মনিবের সাথে কি কথাবার্তা হয়েছে আমি তার
সবকিছু তোকে হুবহু খুলে বলবো।
এরপর কামাল তার সাথে
মনিবের যা সওয়াল জওয়াব হয়েছে সবই খুলে বললো। পরে জামালকে জিজ্ঞেস করলো, এবার বল্ তোর সাথে মনিবের কি আলাপ-সালাপ
হয়েছিলো?
জামাল যখন বুঝতে
পারলো যে, উভয়ের
সাথে মনিবের প্রশ্ন একই ধরনের ছিলো এবং কামাল তার সম্পর্কে মনিবের কাছে খারাপ
কিছু বলেনি তখন লজ্জায় তার চেহারাই লাল হয়ে গেলো। সে মুখ নীচু করে বললোঃ
মনিবের সাথে আমার যা কথাবার্তা হয়েছে তা আমি বলতে পারবো না। মনিব যখন আমাকে
বললেন যে, তুই
তার কাছে আমার বদনাম করেছিস তখন আমি মনিবের কথা বিশ্বাস করে
ফেলি। তাই নিজেকে ভালো ও তোকে খারাপ বলে প্রমাণের চেষ্টা চালাই। এখন বুঝতে
পারছি যে, মনিব
আসলে আমাদের পরীক্ষা করে দেখেছেন আর আমি সে পরীক্ষা খুব
খারাপভাবেই দিলাম। অথচ তুই এখনো আমার হয়ে পরিশ্রম করতে চাচ্ছিস। আমি মেনে
নিচ্ছি যে তুই-ই বড়, তুই-ই
মহৎ।
এরপর দু’জন মিলেমিশে কাজ করতে লাগলো। কিছুকাল পর
মনিব অন্যত্র চলে যেতে চাইলে গোলাম দু’জনকেও বিক্রি করতে পাঠালেন। জামালকে দু’শো দিরহামে বিক্রি করা
গেলেও কামালের জন্য ভালো দামে কোন গ্রাহক পাওয়া গেলোনা। মনিব আসলে কামালকে
বিক্রি করতেও চাননি। তিনি তাকে আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত করে দিয়ে নিজের
সন্তান হিসেবে গ্রহন করলেন। এরপর পিতাপুত্র এক সাথেই চলে গেলেন অন্যত্র।
লেখকঃ মোঃ ফরিদ
উদ্দিন খান (সুলতান মাহমুদের দাড়ি)
গল্পটি মাওলানা জালাল
উদ্দিন রুমির “মসনবী”
কাব্যগ্রন্থ থেকে
অনুবাদ কৃত।
No comments:
Post a Comment