ওহোদ যুদ্ধের মতোই এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি। ছড়ানো-ছিটানো
বিশাল রণাঙ্গনের এক স্থানে মহানবী তাঁর শ্বেত অশ্বের উপর বসে।
মুসলিম পতাকাগুলো ভূলুণ্ঠিত। মুসলিম বাহিনী সম্পূর্ণ
বিশৃংখল হয়ে পড়েছে। ওহোদ যুদ্ধে বিপর্যয় হয়েছিল মহানবীর যুদ্ধ-সংক্রান্ত একটা আদেশ
থেকে সরে আসার কারণে। আর হুনাইন যুদ্ধে বিপর্যয়ের কারণ কারো কারো মধ্যে
সংখ্যাধিক্যের উপর নির্ভরতা এবং মুসলিম সেনাদলের
অংশ হিসেবে আসা পৌত্তলিক সৈন্যদল ও সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী মুসলমানদের অতি
উৎসাহ ও অপরিণামদর্শিতা এবং তাদের কারো কারো ষড়যন্ত্রও।
হুনাইন যুদ্ধের দু’টি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল। এক. এ যুদ্ধে মুসলিম পক্ষের সৈন্য
সংখ্যা ছিল বার হাজার, যা
তখন পর্যন্ত সংঘটিত যুদ্ধের মধ্যে সর্বোচ্চ (বদরে সৈন্য সংখ্যা ছিল ৩১৩, ওহোদ যুদ্ধে এক
হাজার এবং খন্দক যুদ্ধে তিন হাজার)। দুই. এই যুদ্ধে প্রায় দুই হাজার পৌত্তলিক
সৈন্য মুসলমানদের পক্ষে যোগদান করে।
এ যুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ ছিল আরবের সুদক্ষ ও
সর্বশ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হাওয়াজিন, সাকিফ এবং তাদের
মিত্র গোত্রসমূহের বিশাল বাহিনী।
হুনাইন প্রান্তরে আগে থেকেই হাওয়াজিন ও সাকিফরা সুকৌশলে
সৈন্য মোতায়েন করে ওৎ পেতে ছিল।
মুসলিম বাহিনীর অগ্রভাগে ছিল পৌত্তলিক সৈন্য ও নব্য
মুসলমানরা। তাদের উৎসাহ-আস্ফালন যতটা আকাশস্পর্শী ছিল, তার স্থায়িত্ব
ততটাই ছিল পাতালস্পর্শী।
অগ্রভাগে থাকার কারণে হাওয়াজিন ও সাকিফদের পরিকল্পিত
প্রচণ্ড ও অব্যাহত আক্রমণ তাদের উপর প্রথম আসে। আক্রান্ত হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য
অবস্থায় তারা পালাতে শুরু করে। ভয়ানক বিশৃংখল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শুরুতেই ভেঙে
পড়ে মুসলিম বাহিনীর গোটা শৃংখলা। এই শৃংখলা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মহানবী (সাঃ) স্থিরভাবে বসেছিলেন তাঁর
ঘোড়ার পিঠে। হযরত আব্বাস (রাঃ) দাঁড়িয়েছিলেন ঘোড়ার লাগাম ধরে, আর
আবু সুফিয়ান ধরেছিলেন ঘোড়ার রেকাব। আশেপাশে ছিল দু’তিনজন মাত্র মুসলিম সৈনিক।
মহানবী (সাঃ)-কে একা দেখে ছুটে আসছে শত্রু-বাহিনী মহা
সোরগোল তুলে, আর
আস্ফালন করতে করতে।
এই ঘোরতর বিপদ মুহূর্তে মহানবীর মুখে ভয় বা ভাবনার কোন
চিহ্ন নেই।
এ সময় মহানবী (সাঃ) ধীর-স্থিরভাবে ঘোড়া থেকে মাটিতে অবতরণ করলেন
এবং নতজানু হয়ে পরম প্রভু রব্বুল আলামিনের কাছে একান্ত প্রার্থনা জানালেন।
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আরোহণ করলেন ঘোড়ায় এবং দ্রুত ছুটলেন
অগ্রসরমান সহস্র শত্রুসেনার দিকে।
হযরত আব্বাস ও আবু সুফিয়ান আতংকিত হয়ে মহানবীকে বাধা দেবার
চেষ্টা করলেন।
মহানবী (সাঃ) দৃঢ়কণ্ঠে, গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘আনান্নাবী লা কাজেব, আনা ইবন আবদুল মোত্তালেব’ (আমি নবী, আমাতে মিথ্যার লেশমাত্র নেই, আমি আবদুল
মোত্তালিব বংশের সন্তান)।
মহানবী (সাঃ)-এর মুখমণ্ডল তখন বিশ্বাসের প্রভায় অপরূপ, দীপ্ত।
মহানবীর দিকে তাকিয়ে এবং তাঁর তেজোদীপ্ত ঘোষণা শুনে হযরত
আব্বাস এবং আবু সুফিয়ান বিহবল হয়ে পড়লেন এবং তাঁকে বাধা দেবার আর শক্তি পেলেন না।
একদল শত্রু মহানবীর (সাঃ) একদম সামনে এসে পড়েছিল।
মহানবী তাদের বিরুদ্ধে কোন অস্ত্র ব্যবহার করলেন না। তিনি
এক মুষ্ঠি ধুলা মাটি তুলে নিয়ে ছুড়ে মারলেন তাদের দিকে।
দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়া ধুলাক্রান্ত সৈনিকরা চোখ মুছতে মুছতে
পেছনে হটে গেলে।
ইতোমধ্যে মহানবী (সাঃ) একা একা ছুটে যাবার দৃশ্য দেখে
এখানে-সেখানে বিক্ষিপ্ত মুসলিম সৈনিকরা ছুটে আসতে লাগল মহানবীর দিকে।
অন্যদিকে হযরত আব্বাস উঠেছেন এক পাহাড় টিলায়। সেখান থেকে
হযরত আব্বাসের স্বভাবসিদ্ধ দরাজ কণ্ঠে ধ্বনিত হলোঃ “হে আনসার বীরগণ, হে শাজরার বাইয়াত
গ্রহণকারীগণ, হে
মুসলিম বীরবৃন্দ। হে মুহাজিরগণ, কোথায় তোমরা? এদিকে ছুটে এসো।”
বিক্ষিপ্ত, বিশৃংখল সৈনিকরা সমবেত হবার জন্যে একটা কেন্দ্রের সন্ধান
করছিল।
এই আহবানের সাথে সাথে মুসলিম সৈনিকরা বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রের
যে যেখানে ছিল সেখান থেকে দলে দলে ছুটে আসতে লাগল। শত শত কণ্ঠে আওয়াজ উঠল, “ইয়া লাব্বায়েক, ইয়া লাব্বায়েক” (এই যে হাজির, হাজির)।
হযরত আব্বাসের ভাষায় “সদ্যপ্রসূত গাভী যেমন তার বাছুরের বিপদ দর্শনে চিৎকার
করতে করতে ছুটে আসে, আমার
আহবান শুনে মুসলমানরা সেভাবে ছুটে আসতে লাগল।”
মুসলিম বাহিনীর ব্যুহ আবার নতুন করে রচিত হলো। পতাকাগুলো
আবার তুলে ধরা হয়েছে।
মহানবী (সাঃ) এক মুঠো কংকর শত্রুর দিকে নিক্ষেপ করে বললেন, ‘শত্রু পরাস্ত, যাও অগ্রসর হও।’
মুসলিম বাহিনী বন্যাবেগের মতো আপতিত হলো শত্রু সৈন্যের উপর।
প্রচণ্ড যুদ্ধ চলল।
অবশেষে হাওয়াজিন ও সাকিফদের অজেয় বলে কথিত বাহিনী
স্ত্রী-পুত্র, রণসম্ভার
ও সমস্ত ধনদৌলত যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে রেখে পালিয়ে বাঁচল।
লেখকঃ
আবুল আসাদ
বইঃ
আমরা সেই সে জাতি [তৃতীয় খণ্ড]
No comments:
Post a Comment