নাম নাওফিল, কুনিয়াত বা ডাক নাম আবু হারেস। পিতা হারেস ইবন আবদিল
মুত্তালিব, মাতা গাযিয়্যা। কুরাইশ বংশের হাশেমী শাখার সন্তান। রাসূলুল্লাহর
(সাঃ) চাচাতো ভাই।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দাওয়াতী কাজ শুরু করতেই
নিকটতম আত্মীয়রাও তার শত্রু হয়ে যায় এবং বিরোধিতায় কোমর বেঁধে লেগে যায়।
তবে নাওফিলের অন্তরে সব সময় ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা বিদ্যমান ছিল। এ কারণে
পৌত্তলিক থাকা অবস্থায়ও তিনি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বিরোধিতা মনে প্রাণে মেনে নিতে
পারেননি। মক্কার মুশরিকদের চাপে বাধ্য হয়ে তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই
করার জন্য বদরে যান। কিন্তু তখন তাঁর মুখে এই পংক্তিটি বারবার উচ্চারিত
হচ্ছিলঃ ‘আহমাদের সাথে যুদ্ধ করা আমার জন্য হারাম, আহমাদকে আমি আমার নিকট আত্মীয় মনে করি।’
বদরে মক্কার পৌত্তলিক বাহিনীর পরাজয় হলে অন্যদের সাথে তিনিও বন্দী হন। এই
বন্দী অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করেন। যখন রাসূল (সাঃ) তাকে বললেনঃ নাওফিল,
ফিদিয়া বা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত হয়ে যাও। নাওফিল বললেনঃ মুক্তিপণ দেওয়ার
সামর্থ আমার নেই। রাসূল (সাঃ) বললেনঃ তাহলে জিদ্দায় রেখে আসা তোমার তীরগুলি
মুক্তিপণ হিসেবে দান কর। নাওফিল বলে উঠলেনঃ আল্লাহর কসম, এক আল্লাহ ছাড়া
জিদ্দার তীরগুলির কথা আর কেউ জানেনা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর
রাসূল। জিদ্দায় তার এক হাজার তীর ছিল। অবশ্য অন্য একটি মতে তিনি খন্দক
যুদ্ধের বছর ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদীনায় চলে যান। [টীকাঃ সীরাতু ইবন হিশাম
২/৩. আল ইসাবা-৩/৫৭৭]।
নাওফিল ছিলেন একজন ভাল কবি। ইসলাম গ্রহণের পর স্বীয় অনভূতি অনেক কবিতায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপঃ
‘দূরে যাও, দূরে যাও, আমি আর তোমাদের নই।
কুরাইশ নেতাদের দ্বীনের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
আমি সাক্ষ্য দিয়েছি, মুহাম্মাদ নিশ্চয়ই নবী।
তিনি তার প্রভুর কাছ থেকে হিদায়াত ও দিব্যজ্ঞান নিয়ে এসেছেন।
তিনি আল্লাহর রাসূল─তাকওয়ার দিকে আহবান জানান,
আল্লাহর রাসূল কোন কবি নন।
এই বিশ্বাস নিয়ে আমি বেঁচে থাকবো।
কবরেও আমি এই বিশ্বাসের ওপর শুয়ে থাকবো।
আবার কিয়ামতের দিন এই বিশ্বাস নিয়ে ওঠবো।’
খন্দক অথবা মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে হযরত আব্বাসের (রাঃ) সাথে আবার তিনি
মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আবওয়া পৌঁছে রাবীয়া ইবন হারেস ইবন আবদিল
মুত্তালিব আবার মক্কায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। নাওফিল তাকে বলেনঃ যে
স্থানের মানুষ আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে লড়াই করে, যেখানের অধিবাসীরা তাকে
অস্বীকার করে─ সেই পৌত্তলিক ভূমিতে তুমি কোথায় ফিরে যাবে? এখন আল্লাহ তাঁর
রাসূলকে সম্মান দান করেছেন, তাঁর সঙ্গী সাথীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তুমি আমাদের সাথেই চলো। অতঃপর কাফিলাটি হিজরত করে মদীনায় পৌঁছে।
ইসলাম গ্রহণের পূর্ব থেকেই নাওফিল ও আব্বাসের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। এ
কারণে রাসূল (সাঃ) তাদের দু’জনের মধ্যে দ্বীনী ভাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে
দেন এবং দুজনের বসবাসের জন্য দু’টি বাড়ীও বরাদ্দ করেন। বাড়ী দু’টির একটি ছিল
মসজিদে নববী সংলগ্ন ‘রাহবাতুল কাদা’ নামক স্থানে এবং অন্যটি ছিল
বাজারে─ ‘সানিয়্যাতুল বিদা’র রাস্তায়।
মদীনায় আসার পর সর্ব প্রথম
মক্কা বিজয়ে অংশগ্রহণ করেন। তায়েফ ও হুনাইনসহ বিভিন্ন অভিযানে যোগ দিয়ে
বিশেষ যোগ্যতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বিশেষতঃ হুনাইনে তিনি চরম সাহসিকতা
দেখান। মুসলিম বাহিনী যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে
উপনীত হয় তখনও তিনি শত্রুর মুকাবিলায় পাহাড়ের মত অটল থাকেন। এই যুদ্ধে তিনি
মুসলিম বাহিনীকে প্রভূত সাহায্য করেন। যাত্রার প্রাক্কালে তিন হাজার নিযা
তিনি রাসূল (সাঃ) এর হাতে তুলে দেন। রাসূল (সাঃ) মন্তব্য করেনঃ ‘আমি যেন
দেখছি, তোমার তীরগুলি মুশরিকদের পিঠসমূহ বিদ্ধ করছে। [টীকাঃ সীরাতু ইবন
হিশাম-২/৩]।
হযরত নাওফিল (রাঃ) হিজরী ১৫ সনে মদীনায় ইনতিকাল করেন
এবং খলীফা হযরত উমার (রাঃ) তাঁর জানাযার নামাযের ইমামতি করেন। মদীনার ‘বাকী’
গোরস্তানে তাঁকে দাফন করা হয়।
হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ) সব সময়
নাওফিলের খোঁজ খবর নিতেন, মদীনার এক মহিলার সাথে রাসূল (সাঃ) তাঁর বিয়ে দেন।
তখন তাঁর ঘরে কোন খাবার নেই। রাসূল (সাঃ) স্বীয় বর্মটি আবু রাফে ও আবু
আইউবের হাতে দিয়ে এক ইয়াহুদীর নিকট পাঠান। তারা বর্মটি সেই ইয়াহুদির নিকট
বন্ধক রেখে বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ত্রিশ সা’ যব খরীদ করে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট নিয়ে আসেন। তিনি তা নাওফিলকে দান করেন।
লেখকঃ ড. মুহাম্মাদ আবদুল মাবুদ
আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
(বইঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – দ্বিতীয় খন্ড)
No comments:
Post a Comment