নাম উবাইদাহ, কুনিয়াত আবুল হারিস বা আবু মুআবিয়া। পিতা আল হারিস এবং
মাতা সুখাইলা। দাদা আবদুল মুত্তালিব ইবন আবদে মান্নাফ। কুরাইশ গোত্রের
সন্তান।
উবাইদাহ ইবনুল হারিস, আবু সালামা ইবনে আবদিল আসাদ, আল আরকাম
ইবন আবিল আরকাম এবং উসমান ইবন মাজউন হযরত আবু বকরের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে এক
সাথে ঈমান আনেন। হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ) তখন আল আরকাম ইবন আবিল আরকামের
গৃহে আশ্রয় নেননি। হযরত উবাইদাহ যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তিনি বনী আবদে
মান্নাফের একজন নেতা। মক্কায় হযরত বিলালকে তিনি দ্বীনী ভাই হিসাবে গ্রহণ
করেন।
মদীনায় হিজরতের নির্দেশ হলো। হযরত উবাইদাহ তার দুই ভাই
তুফাইল, হুসাইন এবং মিসতাহ ইবন উসাসাহকে সাথে করে মদীনায় রওয়ানা হলেন। পথে
মিসতাহ হাঁটা চলা করতে একেবারে অক্ষম হয়ে পড়লেন। অগ্রগামী কাফিলার লোকেরা
খবর পেয়ে ফিরে এসে তাকে উঠিয়ে মদীনায় নিয়ে যান। মদীনায় হযরত আবদুর রহমান
আজলানী (রাঃ) তাদের স্বাগত জানান এবং অত্যন্ত যত্নের সাথে তাদের আতিথেয়তা
করেন। হযরত রাসূলে কারীমের (সাঃ) মদীনায় আগমনের পর পর হযরত উমাইর ইবন হুমাম
আল আনসারীর সাথে তার ভাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথকভাবে বসবাসের জন্য
রাসূল (সাঃ) তাঁকে একখন্ড জমিও দান করেন। তাঁর পুরো খান্দান সেখানে বসতি
স্থাপন করে।
মক্কার মুশরিকদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য হিজরতের আট
মাস পরে ৬০ জন মুহাজিরের একটি দলের নেতৃত্ব দিয়ে রাসূল (সাঃ) তাঁকে রাবেগের
দিকে পাঠান। ইসলামের ইতিহাসে এটা ছিল দ্বিতীয় অভিযান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ বাহিনীর ঝান্ডা উবাইদার হাতে সমর্পণ করেন। তাঁরা রাবেগের নিকটে পৌঁছলে আবু
সুফইয়ানের নেতৃত্বে দুশো মুশরিকের একটি বাহিনীর সাথে তাদের সামান্য সংঘর্ষ
হয়। ব্যাপারটি যুদ্ধ ও রক্তপাত পর্যন্ত না গড়িয়ে কিছু তীর ও বর্শা
ছোঁড়াছুঁড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
এ ঘটনার পর তিনি হক ও বাতিলের
প্রথম সংঘর্ষ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কাতারবন্দী হওয়ার পর মুশরিকদের
পক্ষ থেকে উতবা, শাইবা ও ওয়ালীদ বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলতে থাকে─ আমাদের
সাথে লড়বার কেউ আছে কি? ইসলামী ফৌজ থেকে কয়েকজন নওজোয়ান আনসারী এগিয়ে
গেলেন। তখন তারা চেঁচিয়ে বললোঃ ‘মুহাম্মাদ, আমরা অসম লোকদের সাথে লড়তে
পারিনে। আমাদের যোগ্য প্রতিদ্বন্ধীদের পাঠাও।’ রাসূল (সাঃ) আলী, হামযা ও
উবাইদাহকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাঁরা এ আদেশের অপেক্ষায় ছিলেন। এ
তিন বীর আদেশ পাওয়া মাত্র আপন আপন নিযা দোলাতে দোলাতে তিন প্রতিপক্ষের
সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হযরত উবাইদাহ ও ওয়ালীদের মধ্যে দীর্ঘ সময় লড়াই চললো।
তারা দু’জনই মারাত্মক যখম হলেন। তবে আলী ও হামযা উভয়েই প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী
করে ফেলেছিলেন। তারা একসাথে ওয়ালীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করেন এবং
হযরত উবাইদাহকে রণাঙ্গণ থেকে আহত অবস্থায় তুলে নিয়ে আসেন।
হযরত
উবাইদাহর একটি পা হাঁটুর নীচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি আপাদমস্তক রক্তে
রঞ্জিত হয়ে পড়েন। রাসূল (সাঃ) তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাঁর হাঁটুর ওপর
স্বীয় মাথাটি রেখে দেন। এ অবস্থায় উবাইদাহ বলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, এ সময়
আবু তালিব জীবিত থেকে আমার এ অবস্থা দেখলে তাঁর প্রত্যয় হতো যে, তাঁর একথা
বলার অধিকতর যোগ্য ব্যক্তি আমি। এই বলে তিনি আবু তালিবের একটি কবিতার এই
পংক্তি আবৃত্তি করেন, “আমরা মুহাম্মাদের হিফাজত করবো। এমনকি চারপাশে মরে
পড়ে থাকবো এবং আমাদের সন্তান ও স্ত্রীদের আমরা ভুলে যাব।” [সীরাতু ইবন
হিশাম-২]।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে সাথে করে
মদীনার দিকে রওয়ানা হন। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। পথে ‘সাফরা’ নামক
স্থানে ৬৩ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। সাফরার বালুর মধ্যে তাঁকে দাফন করা হয়।
হযরত রাসূলে কারীমের (সাঃ) কাছে তাঁর উঁচু মর্যাদা ছিল। রাসূল (সাঃ) তাঁকে
অত্যন্ত সম্মান দেখাতেন। একবার রাসূল (সাঃ) ‘সাফরায়’ তাঁর কবরের কাছে তাবু
স্থাপন করেন। সাহাবীরা আরজ করেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এখান থেকে মিশকের
ঘ্রাণ আসছে। তিনি বললেনঃ “এখানে তো আবু মুআবিয়ার কবর ছিল। সুতরাং আশ্চর্য
হওয়ার কি আছে?”
হযরত উবাইদার (রাঃ) মৃত্যুতে হিন্দা বিনতু উসাসা ও কা’বসহ বহু কবি শোকগাথা রচনা করেছিলেন। [সীরাতু ইবন হিশাম-২/২৪, ২৫, ৪১]।
লেখকঃ ড. মুহাম্মাদ আবদুল মাবুদ
আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
(বইঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – দ্বিতীয় খন্ড)
No comments:
Post a Comment