ওহোদ যুদ্ধের মর্মন্তুদ ও মহোত্তম
দৃশ্য।
যুদ্ধে বিপর্যয় ঘটেছে। বিপর্যয়ের
মধ্যে বিপর্যয়। খবর রটল যে, মহানবী
(সাঃ) নিহত হয়েছেন।
মুসলিম বাহিনীর পতাকাধারী মুসয়াব
নিহত হওয়ার থেকেই এই খবর রটে। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) চেহারার সাথে তাঁর চেহারার
বাহ্যিক কিছুটা সাদৃশ্য দর্শনে মক্কার মুশরিক ইবনে কামিয়া এই খবর রটিয়ে দেয়।
মুহূর্তেই খবরটি যুদ্ধক্ষেত্রে
আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল। বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রে এই খবরটি যাচাই করা অধিকাংশের পক্ষে
সম্ভব ছিল না। ফলে এই খবর মক্কার মুশরিক সৈন্যদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা ও নতুন
শক্তির সঞ্চার করলো। বিপর্যয়ের মধ্যে মুসলিম বাহিনীকে ধ্বংসের জন্যে তারা বন্যার
তীব্র স্রোতের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল। অন্যদিকে বিপর্যয় ও মহা দুঃসংবাদ একসাথে হয়ে অনেক
মুসলিম সৈন্যের সব শক্তি ও সাহস কেড়ে নিল। তারা হতাশ হয়ে পড়ল যে, মহানবী (সাঃ) না
থাকলে কি হবে এই যুদ্ধ দিয়ে।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে মক্কার মুশরিক
সৈন্যরা যখন জানতে পারল যে, মহানবী
(সাঃ) জীবিত আছেন, তখন
তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালেন মহানবী (সাঃ)।
মুসলিম বাহিনীর বিশৃঙ্খল ও
বিপর্যয়কর অবস্থায় পরিস্থিতিটা অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াল।
যুদ্ধক্ষেত্রের একটি স্থানে
সাহাবীদের একটি ক্ষুদ্র দল তাদের দেহ দিয়ে মহানবীকে আড়াল করে চারদিক থেকে
বন্যাবেগের মত ছুটে আসা মুশরিক সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করছিল। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত
হয়ে এক এক করে তারা ঢলে পড়ল। অবশিষ্ট থাকলো মাত্র তালহা এবং সাআদ।
দু’জনেই মদীনার অব্যর্থ-লক্ষ্য তীরন্দাজ।
তাঁরা ঘুরে ঘুরে তাঁদের দেহ দিয়ে মহানবীর দেহকে আড়াল করে অবিরাম তীর ছুড়ে কাফেরদের
হত্যা করছিল ও তাদের ঠেকিয়ে রাখছিল। সাআদ একাই সেদিন দু’খানা ধনুক ভেঙ্গেছিলেন এবং
সহস্রাধিক তীর ছুড়েছিলেন। এক কঠিন মুহূর্তে তালহা তীর ধনুক বাদ দিয়ে নিজের ঢাল ও
নিজের দেহ দিয়ে মহানবীকে আচ্ছাদন করতে লাগলেন। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়ল তাঁর
দেহ। এ সময় দূর থেকে আবু দোজানা ছুটে এলেন এ দৃশ্য দেখে। যোগ দিলেন তিনি তালহা ও
সাআদের সাথে। দেখলেন আবু দোজানা শত্রুর একটা বর্শা ছুটে আসছে মহানবীকে লক্ষ্য করে।
আবু দোজানা বুক দিয়ে মহানবীকে আচ্ছাদন করে পৃষ্ঠদেশ এগিয়ে দিলেন বর্শার দিকে।
বর্শা তার পৃষ্ঠদেশ বিদ্ধ করল।
উম্মে আমারা আহত মুসলিম সৈন্যদের
পানি পান করাচ্ছিলেন। তিনি শুনতে পেলেন মহানবী (সাঃ)-এর আক্রান্ত হওয়ার কথা। সঙ্গে
সঙ্গেই তিনি পানির মশক ফেলে দিয়ে ছুটলেন মহানবীর কাছে। যোগ দিলেন মহানবীর কয়েকজন
সাথীর দলে। প্রথমে অবিরাম তীর বর্ষণ। তীরে যখন কুলালো না, তখন তিনি তলোয়ার
নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুর উপর। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হচ্ছে তার দেহ, কিন্তু সেদিকে
বিন্দুমাত্রও ভ্রূক্ষেপ নেই তাঁর। এ সময়ের অবস্থা সম্পর্কে স্বয়ং মহানবী (সাঃ)
বলেছেন, “সেই বিপদের সময়
দক্ষিণে, বামে যেদিকে তাকাই
সেদিকেই দেখি উম্মে আমারা আমাকে রক্ষার জন্যে যুদ্ধ করছে।”
সোনার মানুষেরা যখন তাঁকে ঘিরে
এভাবে লড়াই করছেন, তখন
এই সোনার মানুষগুলো যাঁর হাতে গড়া সেই মহানবী (সাঃ) অচঞ্চল পর্বতের মত দণ্ডায়মান।
ভয় নেই, ভীতি নেই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই, শোচনীয় অবস্থা
দর্শনে অবসাদ নেই, বিষণ্ণতা
নেই। পর্বতের মত দাঁড়িয়ে ক্ষুদ্র বাহিনীকে তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন, পরিচালনা করছেন।
এক শত্রুর আঘাতে তার লৌহ
শিরস্ত্রাণের দুই কড়া যখন তার মাথায় ঢুকে গেল, রক্তের দরবিগলিত ধারায় তাঁর মুখমণ্ডল ও দেহ যখন রঞ্জিত
হচ্ছিল তখন তিনি প্রার্থনা করলেন, “হে আমার প্রভু, আমার জাতিকে তুমি ক্ষমা কর। কারণ তারা অজ্ঞ।”
সেদিন মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয়
পরাজয় পর্যন্ত পৌঁছেনি অকুতোভয় ঐ সব সোনার মানুষদের কারণেই। মুসলিম বাহিনী হামজা, মুসয়াব প্রমুখের মত
৭০ জনের জীবন বিসর্জনের বিনিময়ে বিপর্যয় রোধ করেছিল। ৩ হাজার সৈন্যের বিশাল মুশরিক
বাহিনীকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল মক্কায়।
লেখকঃ
আবুল আসাদ
বইঃ
আমরা সেই সে জাতি [তৃতীয় খণ্ড]
No comments:
Post a Comment