মক্কা ও মদীনার
মধ্যবর্তী হুনাইনের পার্বত্য অঞ্চল আওতাস। আরবের বিখ্যাত হাওয়াযেন ও সাকিফ গোত্র তাদের অন্যান্য
মিত্র গোত্রসহ বিরাট এক বাহিনী নিয়ে সেখানে এসে শিবির গেড়েছে। তারা চায়,
মক্কা জয়ী ইসলামী
শক্তির উপরে শেষ এবং চূড়ান্ত আঘাত হানতে। তারা সাথে করে নিয়ে এসেছে তাদের নারী,
শিশু এবং বৃদ্ধদেরকেও।
উদ্দেশ্য, এদের
বিপদ ও ভবিষ্যত চিন্তা করে যাতে কেউ যুদ্ধের ময়দান পরিত্যাগ না করে। হাওয়াযেন ও
সাকিফ গোত্রের বিখ্যাত তিরন্দাজরা গিরিপথ ও গিরিখাতগুলোতে গোপন অবস্থান
গ্রহন করেছে।
অষ্টম হিজরী। শাওয়াল
মাস। মহানবীর (সাঃ) নেতৃত্বে ১২ হাজার সৈন্যের মুসলিম বাহিনী
হাওয়াযেন ও সাকিফ
বাহিনীর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। মহানবী (সাঃ) এই প্রথমবারের মত একটি মিশ্র বাহিনীর নেতৃত্ব দিলেন।
মুসলিম বাহিনীতে সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী নও মুসলিম ছাড়াও প্রায় দু’হাজারের মত এমন লোক শামিল ছিল যারা তখনও
ইসলাম গ্রহণ করেনি। বিশেষ করে মুসলিম সৈন্যদলের অগ্রবর্তী বাহিনীর নেতৃত্বে
ছিলেন খালিদ ইবন ওয়ালিদ। তাঁর অধীনের অধিকাংশই ছিল অতিমাত্রায় উৎসাহী
নব্য দীক্ষিত তরুণের দল। সুসজ্জিত ও বিশাল মুসলিম বাহিনীর মনে সেদিন এমন
একটি ভাবের সৃষ্টি হলোঃ "আজ আমাদের সাথে যুদ্ধে জয়ী হয় এমন সাধ্য কার?"
যুদ্ধ শুরু হলো।
হাওয়াযেনদের তীর বৃষ্টি গোটা প্রান্তরকে ছেয়ে ফেলল। অগ্রবর্তী বাহিনীতে বিশৃংখলা দেখা
দিল। সে বিশৃংখলা সংক্রামক হয়ে ছড়িয়ে পড়ল গোটা বাহিনীতে। যুদ্ধক্ষেত্র
থেকে সবাই ছুটে পালাতে লাগল। সমগ্র যুদ্ধের ময়দানে শুধু এক ব্যক্তি তাঁর
জায়গায় স্থির ও অটল ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি মহানবী (সাঃ)। ময়দানের এক
প্রান্তে তখন হযরত উমার (রাঃ)। তলোয়ার থেকে একজন কাফিরের রক্ত মুছতে মুছতে আবু
কাতাদাহ (রাঃ) তাঁর সমীপবর্তী হয়ে বললেন, “মুসলমানদের অবস্থা কি?” সিংহ হৃদয় হযরত উমার (রাঃ) অবনত মুখে শান্ত
কন্ঠে বললেন, “এটাই
আল্লাহর ফায়সালা ছিল।”
বৃষ্টির অবিরাম ধারার
মত তীর ছুটে আসছে। এই তীরবৃষ্টির মধ্যে যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে আছেন মহানবী
(সাঃ)। তিনি চারদিকে চোখ ফিরিয়ে দেখলেনঃ শূণ্য মাঠ, কেউ কোথাও নেই। তিনি ধীরে ধীরে দক্ষিন দিকে চোখ
ফিরালেন। তাঁর দরাজকন্ঠে ধ্বনিত হলোঃ "হে আনসারবৃন্দ!" সঙ্গে সঙ্গে সে শূণ্য
প্রান্তর পেরিয়ে উত্তর এলঃ "আমরা উপস্থিত আছি।" মহানবী (সাঃ) বাম
দিকে তাকিয়ে সেই একই আহবান জানালেন। দক্ষিনের সে উত্তর এল বাম দিক থেকেও।
এরপর মহানবী (সাঃ) তাঁর বাহন থেকে নেমে পড়লেন। এ সময় হযরত আব্বাস (রাঃ)
এসে পড়লেন। মহানবীর (সাঃ) নির্দেশে হযরত আব্বাসের (রাঃ) সুউচ্চকন্ঠে ধ্বনিত
হলো, “হে আনসারবৃন্দ! হে
বৃক্ষতলে শপথকারীগন।”
এই মর্মস্পর্শী আহবান
কর্ণকুহরে পৌছার সাথে সাথে ঝড়ের বেগে মুসলিম সৈন্যদল যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে
এল। সর্বাগ্রে পৌছার আকাঙ্ক্ষায় এমন ভিড় জমে গেল যে, অনেকের পক্ষে ঘোড়ায় চড়ে আসা সম্ভব হলো
না। তারা ঘোড়া ফেলে রেখে আবার অনেকে শরীরটাকে হালকা করার জন্য গায়ের বর্ম
ছুড়ে ফেলে দিয়ে পাগল প্রায় ছুটে এল যুদ্ধক্ষেত্রে। অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যায় কিছু
নিখাদ হয়ে ফিরে
আসা মুসলিম বাহিনী বদর, উহুদ
ও খন্দকের সেই রূপ আবার ফিরে পেল। মুহূর্তে ঘুরে গেল যুদ্ধের মোড়। সমগ্র
আরবের অদ্বিতীয় দুর্ধর্ষ তীরন্দাজ হাওয়াযেন ও সাকিফদের তীরের প্রাচীরও আর
মুসলমানদের অগ্রগতি রোধ করতে পারলো না। সাকীফ গোত্রের প্রধান সেনানায়ক
উসমান ইবন আবদুল্লাহ নিহত হলো। শত্রুপক্ষ রণে ভংগ দিয়ে পালাল। যারা
পালাতে পারল না তারা বন্দী হলো। এই হুনাইনের যুদ্ধে ছ’হাজার শত্রু বন্দী হল এবং চব্বিশ হাজার
উট, চল্লিশ হাজার ছাগ-ছাগী
ও চার হাজার উকিয়া চান্দী মুসলমানদের হাতে এসে পড়ল।
লেখকঃ আবুল আসাদ (আমরা সেই সে জাতি-প্রথম খন্ড)
লেখকঃ আবুল আসাদ (আমরা সেই সে জাতি-প্রথম খন্ড)
No comments:
Post a Comment