Sunday, January 6, 2019

হযরত আবু বকরের অন্তিম অসিয়ত ও উপদেশ

ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ) এর জীবনের অন্তিম ও প্রধান কাজ হলো পরবর্তী খলীফা হিসেবে হযরত উমারকে নিযুক্তি দান। আহলে রায় অনেকের সাথে তিনি এ ব্যাপারে পরামর্শ করেন এবং অবশেষে হযরত উসমান (রাঃ) কে ডেকে এ সম্পর্কে ওসিয়ত ও উপদেশ লিপিবদ্ধ করেন। সেই ঐতিহাসিক দলিলটি এইঃ

পরম দয়ালু ও মেহেরবান আল্লাহর নামে, আল্লাহর দাস ও মুসলমানদের নেতা আবু কুহাফার পুত্র আবু বকর তাঁর ইন্তিকালের মুহূর্তে তাঁর পরবর্তী খলীফা ও মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এই ওসিয়তনামা লিপিবদ্ধ করছেন এবং স্মরণ করাচ্ছেন যে, মৃত্যুকাল এমনই এক কঠিন সময় যে সময়ের কষ্ট ও ভয়াবহতায় অভিভূত হয়ে কাফেরও মুমিন হতে চায়, চরিত্রহীন ব্যক্তি চরিত্রবান হতে চায় এবং মিথ্যাচারী সত্যের আশ্রয় গ্রহণের জন্যে হয়ে ওঠে ব্যাকুল।

মুসলমানগণ! আমি আমার পরে খাত্তাবের পুত্র উমারকে তোমাদের জন্য খলীফা নিযুক্ত করছি। তিনি যতদিন কুরআন ও রাসূলের নীতি অনুযায়ী চলবেন ও তোমাদের সেই আদর্শ অনুযায়ী পরিচালিত করবেন, তোমরা দ্বিধা শূন্য চিত্তে তাঁর আনুগত্য করবে। আল্লাহ ও রাসূল এবং তাঁদের মনঃপূত ইসলাম ও মুসলমান এবং মানবজাতি সম্বন্ধে আমার উপর যে গুরুদায়িত্ব অর্পিত ছিল, তা আমি উপযুক্ত ব্যক্তির উপর ন্যস্ত করে কর্তব্য সম্পাদনের চেষ্টা করেছি। আমার বিশ্বাস, উমার নিরপেক্ষভাবে শাসনদণ্ড পরিচালনা করে ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি করবেন। কিন্তু এর ব্যতিক্রমের দায়িত্ব তাঁর নিজের, কারণ আমি তাঁর বর্তমান ও অতীত জীবনের পরিচয়ের উপর নির্ভর করে তাঁকে আমার স্থলাভিষিক্ত করেছি, কিন্তু ভবিষ্যতের দায়িত্ব আমার নয়। কারণ আমি অন্তর্যামী নই।

তবে এ কথা তাঁকে আমি অবশ্যই স্মরণ করাচ্ছি যে, যদি তিনি নিজের রূপ ও আচরণের পরিবর্তন করেন যা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর ও গ্লানিকর হতে পারে, তবে তার বিষময় ফল অবশ্যই তাঁকে ভোগ করতে হবে। তোমাদের সকলের কল্যাণ হোক।

ওসিয়তনামা লেখা শেষ হলে তা সীলমোহর করে হযরত উমারকে ডেকে আবু বকর (রাঃ) তাঁকে এই উপদেশ দিলেনঃ

"খাত্তাবের পুত্র উমার! আমি তোমাকে যাঁদের জন্য খলীফা মনোনীত করছি তাঁদের মধ্যে আল্লাহর প্রিয় নবীর সাহাবাবৃন্দও রয়েছেনআশা করি এর গুরুত্ব তুমি সম্যক উপলব্ধি করবে। এই গুরুদায়িত্ব পালনে আমি তোমাকে আল্লাহভীতি সম্বল করতে উপদেশ দিচ্ছি। কারণ যার অন্তর সর্বদা আল্লাহর নিকট জওয়াবদিহির দায়িত্ব স্মরণ করে ভীত হয়, সে ব্যক্তি কখনই অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে পারে না। মানুষের মধ্যে সেই ব্যক্তিই ভাগ্যবান যিনি লোভমুক্ত হয়েছেন এবং স্বীয় কর্তব্য নির্ধারণপূর্বক যথা সময়ে তা পালন করতে তৎপর হয়েছেন। সুতরাং তুমি কখনই দিনের করনীয় রাতের জন্য অথবা রাতের করনীয় দিনের জন্য ফেলে রাখবে না এবং কাজের গুরুত্ব ও লঘুত্ব উপলব্ধি করে সর্বাগ্রে গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী সমাধা করবে। মনে রেখো, যে ব্যক্তি ফরজ কাজ ফেলে রেখে নফলকে গুরুত্ব দান করে, তার কাজ ততক্ষণ আল্লাহ কর্তৃক গৃহীত হয় না, যতক্ষণ সে ফরযের গুরুত্ব বুঝে তা সম্পাদন না করে। সকল মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখা এবং শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে নিরপেক্ষভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাতেই ইসলামের মহিমা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি। আরও জেনে রাখো, যে ব্যক্তি সত্য ও ন্যায় বিচারকে প্রাণাপেক্ষাও ভালবেসে ইহলোকে কর্তব্য সম্পাদন করেছে, কিয়ামতের দিন তাঁরই পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে। কিন্তু যারা ইহলোকে মিথ্যার তাঁবেদারী করে অন্যায়, অত্যাচার ও অনাচারে লিপ্ত হয়েছে, পরলোকে তাদের পুণ্যের পাল্লা শোচনীয়ভাবে হালকা হয়ে পড়বে।"

"হে উমার! আল্লাহ কি কারণে কুরআনে এক সঙ্গে অনুগ্রহ ও নিগ্রহ এবং পুরস্কার ও শাস্তির বর্ণনা করেছেন, তার মর্ম উপলব্ধির চেষ্টা করবে। এর মর্ম হচ্ছে এই যে, মুমিনরা আশা ও নিরাশার মধ্য থেকে কর্তব্য নির্ধারণ করতে সমর্থ হবে। সুতরাং তুমি এরূপ কোন অন্যায় লোভ এবং আশায় কখনই অভিভূত হবে না, যে আশা তোমাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে। আবশ্যকের অতিরিক্ত বস্তুর আকাঙ্ক্ষা কখনই করবেনা। আবার নিজের জন্যে যা অপরিহার্য তা কখনই বিনা কারণে ত্যাগ করবে না।"

"হে উমার! আল্লাহ সেই সব অসৎ লোকদের জন্য জাহান্নামের ব্যবস্থা করেছেন, যাদের দুষ্কর্ম এতদূর সীমা লংঘন করেছে যে, আল্লাহ তাদের সৎকর্মসমূহ দূরে নিক্ষেপ করেছেন। অতএব তুমি যখন দোযখ বাসীদের সম্পর্কে আলোচনা করবে, তখন নিজের সম্বন্ধে এটুকুই বলবে যে, ‘আশা করি আল্লাহর অনুগ্রহে আমি তাদের (জাহান্নাম বাসীদের) দলভুক্ত হব না।আল্লাহ সৎকর্মশীলদের জন্যই অনন্ত সুখের জান্নাতের ব্যবস্থা করেছেন। অতএব তুমি যখন পুণ্যাত্মা জান্নাতবাসীদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করবে, তখন নিজের সম্বন্ধে এই ভাব প্রকাশ করবে যে, হে আল্লাহ, তুমি আমার অন্তরে এরূপ সৎকর্মের প্রেরণা দান কর, যার দ্বারা আমি জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি।"

"হে উমার, যদি তুমি আমার এই উপদেশগুলি কার্যকর করতে চাও, তবে যে মৃত্যু প্রত্যেক জীবের জন্য এবং তোমার জন্যও অবধারিত রয়েছে ,তাকেই সর্বাপেক্ষা প্রিয়জ্ঞানে সব সময় স্মরণে রাখবে। মনে রেখো, খোদাপ্রেমিক পুণ্যাত্মা ব্যক্তিরাই সর্বদা মৃত্যুভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। কিন্তু অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে কারুরই রেহাই নেই।"

উপদেশ শ্রবণের পর উমার (রাঃ) বিদায় নিলে আবুবকর (রাঃ) রোগজীর্ণ দুর্বল দুটি হাত উর্ধ্বে উত্তোলন করে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করলেনঃ

হে দয়াময় অন্তর্যামী আল্লাহ, তোমার কাছে কিছুই গোপন থাকার কথা নয়। সুতরাং আমি কোন প্রেরণায় চালিত হয়ে উমারকে মুসলমানদের খলীফা মনোনীত করেছি, সে সবই তুমি অবগত আছ। আমার পরে মুসলমানরা যাতে কোন প্রকার অন্তবিপ্লবে ধ্বংস হয়ে না যায় , সেজন্য অনেক ভাবনা চিন্তার পর সবচেয়ে সত্যানুরাগী ও চরিত্রনিষ্ঠ, সর্বাপেক্ষা ধর্মপরায়ণ, সর্বাপেক্ষা কর্তব্যনিষ্ঠ, সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ ও শক্তিবান এবং মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা হিতাকাঙ্ক্ষী উমারকে তাঁদের জন্য খলীফা নিযুক্ত করেছি। হে আল্লাহ, তোমার সমন আমার কাছে পৌঁছে গিয়েছে এবং ইহলোক হতে বিদায় গ্রহণের পূর্বে যথাসম্ভব সতর্কতার সাথে নিজের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে মুসলমানগণ ও তাদের নেতা উমারকে এবং তাদের ভবিষ্যতকে ও মাখলুককে তোমারই কাছে সমর্পণ করছি। তুমি উমারকে এমনভাবে পরিচালনা করো যেন সে আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে মুসলমানের ও মাখলুকের (সৃষ্টির) কল্যাণ সাধনে সমর্থ হয় এবং তাঁকে তুমি মুসলমানদের নিকট অতি প্রিয় করে তুলো। পক্ষান্তরে উমার যাতে তোমার আনুগত্য ও সৃষ্টির প্রতি তোমার মূর্ত অনুগ্রহস্বরূপ শেষ নবীর সুন্নাত (নীতি) এবং তাঁর অন্তে প্রত্যেক ন্যায়াচারী সৎকর্মশীল মুত্তাকী লোকের নীতি পালন করে তোমার প্রীতিভাজন খিলাফায়ে রাশেদীনের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, সেই ব্যবস্থা করো এবং তাঁর প্রজাসাধারণ সৎ ও সাধুস্বভাব লাভ করে যাতে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে জীবন-যাপন করতে পারে সেই ব্যবস্থা করো- আমি এই প্রার্থনা জানাচ্ছি।

লেখকঃ আবুল আসাদ (আমরা সেই সে জাতি-দ্বিতীয় খন্ড)

No comments:

Post a Comment