Thursday, January 31, 2019

গর্ব করার মত এক ইতিহাস !!

ওসমানীয় খেলাফত[১] চলছে তখন, ১৮৪৫ সাল। খলিফা প্রথম আব্দুল মাজিদ[২] ইস্তাম্বুলের মসনদে।

এসময়ে এসেও ইউরোপের অবস্থা খুব একটা সুবিধার ছিলনা। বিভিন্ন আর্থিক-সামাজিক সমস্যা বিপর্যস্ত ছিল অনেক ইউরোপীয় দেশ। আয়ারল্যান্ডে এসময় দেখা দেয় এক ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ। ক্ষুদার বিধ্বংসী তরঙ্গ দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে আয়ারল্যান্ড দ্বীপটিতে।
The Star and crescent flag of the 
Ottoman Khilafah, a late 18th century 
design officially adopted in 1844
মহামারী টাইপের রোগও ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ডের প্রতিবেশী রাজ্যে, মারা যেতে থাকে হাজার হাজার আদম সন্তান। চারিদিকে শুধু ক্ষুদার্ত রোগাক্রান্ত মানুষের হাহাকার। এই দূর্ভিক্ষে প্রায় ১০ লাখ লোক মারা যায় এবং জীবন রক্ষার তাগিদে ও ভালো জীবনের অনুসন্ধানে অন্যান্য দেশে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ পালিয়ে যায়। আয়ারল্যান্ডের এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ফলস্বরূপ আয়ারল্যান্ড দ্বীপটির জনসংখ্যা ১৮৪৫ থেকে ১৮৫২ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশের মত হ্রাস পায়।

আইরিশদের এই চরম দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায় বিশ্বের বেশীরভাগ দেশই তাদের পরিত্যাগ করে। ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ শক্তিধর লুটেরা দেশগুলো প্রহসনমূলক সাহায্য পাঠায়।[৩]

আয়ারল্যান্ডের এই দূর্দশা দেখে এগিয়ে আসেন খলিফা প্রথম আব্দুল মাজিদ।

Coat of arms of the Ottoman
Empire (1882 design)
তিনি জরুরীভাবে ১০ হাজার স্টার্লিং (sterling) (২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ৮.০০ মিলিয়ন স্টার্লিং অথবা ১.৭ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার) ও কিছু জাহাজ ভর্তি করে খাবার এবং ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন আয়ারল্যান্ডবাসীর জন্য।

কিন্তু বাধ সাধে ইউরোপের মোড়ল ইংল্যান্ড। গোটা দুনিয়ায় লুণ্ঠন করে বেড়ানো ইংল্যান্ড নিজেদের অধিনস্ত রাজ্যকে এই দূর্যোগেও মাত্র ২০০০ স্টার্লিং এর বেশী সাহায্য দেয়নি সেখানে কেন মুসলিম খলিফা তার ৫ গুণ টাকা দিবে! এ তো ইংল্যান্ডের মান-ইজ্জতের ব্যাপার।

রানী ভিক্টোরিয়া ইস্তাম্বুলকে এই বলে সাবধান করে দেন যে, কেউ যেন আয়ারল্যান্ডকে রাণীর চেয়ে বেশি সাহায্য না দেয়। ইংল্যান্ডকে ডিংগিয়ে আয়ারল্যান্ডকে সাহায্য দিতে যাওয়াটা রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে বিপদজনক হতে পারে। সাথে সাথে খলিফাকে এ পরামর্শও দেওয়া হয় যে, সে চাইলে রানী ভিক্টোরিয়ার প্রদানকৃত সাহায্যের অর্ধেক সমমূল্যের সাহায্য দিতে পারে।

Drogheda United Football Club
বাধ্য হয়ে খলিফা সাহায্যের পরিমাণ ১ হাজার স্টার্লিং এ নামিয়ে আনেন। এর পরেও এই অর্থের মূল্য ছিল ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ৮,০০,০০০ (আট লক্ষ) স্টার্লিং অথবা ১,৭০,০০০ (এক লক্ষ সত্তর হাজার) মার্কিন ডলার।

খলিফা আব্দুল মাজিদ এতে সন্তুষ্ট হতে পারলেননা। বারবার মনে হচ্ছিল, তার এ অর্থে মৃত্যুর কূপে পড়ে যাওয়া মানুষগুলোর কিছুই হবেনা। তিনি গোপনে ৩টি অথবা ৫টি জাহাজ ভর্তি করে খাবার এবং ত্রাণ পাঠালেন আয়ারল্যান্ডের দিকে।

গোপনে বহু মাধ্যমে পাঠালেন নগদ অর্থ। মুসলিম ত্রানবহরকে বৃটিশ সৈন্যরা আটকে দিল ডাবলিন এবং বেলফাস্টের ঢোকার পথে। ওসমানীয় সৈন্যরা দমে না গিয়ে ফেরার পথে ডাবলিনের উত্তরে গোপনে ড্রগেডা নামের এক ছোট্ট শহরের পাশে নোংগর করে গোপনে ত্রান সামগ্রী সেই শহরের মেয়রের মাধ্যমে আয়ারল্যান্ডবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়।[৪]

Drogheda Coat of Arms
ইউরোপের বাঘা বাঘা লুটেরা দেশ থাকতে মুসলিম এক শাসকের এই ভালবাসা আর সাহায্য অভিভূত করে আয়ারল্যান্ডের মানুষকে।

১৯৯৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ড্রগেডা শহরের মেয়র গডফ্রে খলিফা আব্দুল মজিদের এই সাহায্য এবং অকৃত্রিম বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করেন এবং তৎকালীন মুসলিম খেলাফতের সম্মানে একটি স্মৃতিফলক উদ্ধোধন করেন।

এখনো যদি সেই ড্রগেডা শহরে যান তো দেখবেন সেখানকার বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব ‘ড্রগেডা ফুটবল ক্লাব’ এর লোগোতে ওসমানীয় খেলাফতের প্রতি সম্মান জানানোর নিদর্শন হিসেবে মুসলমানদের প্রতীক অর্ধচন্দ্র বা হেলাল-সেতারা অংকিত আছে। এছাড়া ড্রগেডা কোর্ট অফ আর্মসের লোগোতেও অংকিত আছে মুসলিম খেলাফতের গৌরবান্বিত ইতিহাস।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------
[১] ওসমানীয় খেলাফতের সময়কাল ১৫১৭-১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ।

[২] খলিফা প্রথম আব্দুল মাজিদ, জন্মঃ ২৩/২৫ এপ্রিল ১৮২৩, মৃত্যুঃ ২৫ জুন ১৮৬১। শাসনকালঃ ২ জুলাই ১৮৩৯-২৫ জুন ১৮৬১। তিনি ছিলেন ৩১ তম উসমানীয় খলিফা।

[৩] Queen Victoria donated £2,000. U.S. President James K. Polk donated $50 and Congressman Abraham Lincoln donated $10

Wikipedia Link: https://en.wikipedia.org/wiki/Great_Famine_(Ireland)

[৪] ২০০৭ সালে দ্যা ফাউন্টেইন ম্যাগাজিনের (The Fountain magazine) একটি নিবন্ধে আবদুল্লাহ আইমাজ (Abdullah Aymaz) উল্লেখ করেছিলেন যে ব্রিটিশ প্রশাসন উসমানীয় খলিফা কতৃক প্রেরিত তিনটি রসদ ভর্তি জাহাজকে বেলফাস্ট বা ডাবলিনের প্রবেশদ্বারগুলিতে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। তবে জাহাজগুলি গোপনভাবে ডাবলিনের প্রায় ৭০ মাইল উত্তরে ড্রগেডা শহরে পৌঁছে  ত্রান সামগ্রী শহরের কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেয়।

রেফারেন্স বুকস এবং ওয়েবপেজ লিংকসঃ

১. Charity and the Great Hunger in Ireland : The Kindness of Strangers;  Written by : Christine Kinealy (2013)

২. https://en.wikipedia.org/wiki/Abdulmejid_I

৩. https://www.irishcentral.com/roots/history/little-known-tale-of-generous-turkish-aid-to-the-irish-during-the-great-hunger

৪. https://web.archive.org/web/20131017094035/http://www.todayszaman.com/newsDetail_getNewsById.action?newsId=269871

৫. https://en.wikipedia.org/wiki/Ireland%E2%80%93Turkey_relations

সম্পাদনাঃ মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম।

No comments:

Post a Comment