মহানবী হিজরত করছেন
মদিনা। চলছেন পথ ধরে। পূর্ব দিগন্ত তখনও সফেদ হয়ে উঠেনি। তিনটি উট এবং চার জন মানুষের
(মহানবী, আবুবকর
এবং আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকাত ছাড়াও আমের এই কাফেলায় শামিল ছিলেন।) ছোট্ট কাফেলা
মদিনার পথে চলছে।
আবু বকরের কাছ থেকে কেনা ‘কাছওয়া’
নামক উটে মহানবী
(সাঃ), আমের
এবং হযরত
আবু বকর আসীন আবু বকরের উটে এবং আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকাত তাঁর নিজস্ব উটে।
দ্রুত পথ অতিক্রম করছে কাফিলাটি। ডাইনে লোহিত সাগর, বামে অন্তহীন পাহাড়ের শ্রেণী, মাঝখানের মরুপথ ধরে এগিয়ে চলছে কাফেলা।
যথেষ্ট সাবধানতা
অবলম্বন করা সত্ত্বেও মহানবীর (সাঃ) কাফেলা সাওর গিরিগুহা থেকে বের
হলে যাত্রার দৃশ্য একজন পল্লিবাসী আরবের চোখে পড়ে গেল। ঐ আরব তার গোত্রের
এক জমায়েতে গিয়ে এই খবর দিয়ে বলল, “আমার
মনে হচ্ছে কুরাইশরা ওদেরকেই খুঁজছে। মহানবী ও আবু বকরকে হত্যা করতে পারলে একশ উট
পাওয়া যাবে।” এ খবর
এ পল্লীতেও এসেছিল। সুতরাং ঐ খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত সুরাকা
নামক জনৈক যুবক গোটা পুরষ্কার নিজে হাত করার লোভে বলল, ‘না না তারা সে লোক নয়। আমি জানি তারা অমুক অমুক লোক,
উট খুঁজতে বেরিয়েছে।’
সুরাকার কথা সকলে
সত্য বলে ধরে নিয়ে যখন অন্য আলোচনায় মশগুল হয়ে পড়ল, তখন সুরাকা ধীরে ধীরে মজলিস থেকে বের হয়ে এলো। তারপর
অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে বলবান ঘোড়া নিয়ে মহানবী (সাঃ) এবং আবু বকরকে হত্যার জন্য
বেরিয়ে পড়ল।
দেরী সহ্য হচ্ছিল
না সুরাকার। উঁচু নিচু পাথর পথে তীর বেগে ঘোড়া ছুটাল সুরাকা। দূরে দেখতে
পেল সেই কাফেলাকে। সুরাকার ঘোড়ার গতি আরও বেড়ে গেল। কিন্তু ঘোড়া মারাত্মকভাবে
পা পিছলে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। সুরাকার মনে ভীষণভাবে খোঁচা লাগল। লক্ষ্যের সাফল্য সম্পর্কে তার মনে
সন্দেহের দোলা লাগলো। সে আরবীয় রীতি অনুসারে তীর দিয়ে লটারি করলো। তাতে
না সূচক জবাব পেয়ে সে ভীষণ দমে গেল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। তারপর
লটারি ভুল হয়েছে ধরে নিয়ে সে আবার তীরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
আবু বকরের সন্ধানী
চোখ এই সময় সুরাকাকে দেখতে পেল। তিনি উদ্বিগ্নভাবে নবীকে বললেন, “দেখুন, আততায়ী এবার আমাদের ধরে ফেলেছে।”
নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে
আবু বকরকে সান্ত্বনা দিয়ে মহানবী (সাঃ) বললেন, “ভীত হয়ো না আবু বকর, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।”
তীর বেগে ছুটছে
সুরাকার ঘোড়া। কাফেলাকে সে ধরে ফেলেছে প্রায়। বাঁধনহীন উৎসাহ উত্তেজনায় সুরাকা তখন উন্মত্ত।
চলার পথে সুরাকার ঘোড়া আবার দুর্ঘটনায় পড়ল। এবার ঘোড়ার দুটি পা মাটিতে দেবে
গেল। পা দু'টি
তোলার অনেক চেষ্টা করল সুরাকা, কিন্তু পারল না। এই সময় আগের লটারির ফল
তার মনে পড়ল। মনটা তার ভীষণ দমে গেল। আবার তীর বের করে
সতর্কতার সাথে সেই লটারিই পুনরায় করল। কিন্তু এবারো সেই উত্তর ‘না’।
সুরাকার মন এবার ভীতি
অনুভব করল। অপর দিকে মহানবীর অবিচল, নিরুদ্বিগ্ন এবং শান্ত সৌম্য অবস্থা সুরাকাকে বিহবল করে
তুলল। সুরাকা নিজেই বলেছে, তখনকার
অবস্থা দেখে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, মুহাম্মাদ নিশ্চয়ই জয়যুক্ত হবেন।
সুরাকা যখন
ভীত-বিহবলতায় কাতর,
তখন তার ঘোড়া নিজেকে
উদ্ধারের জন্য অবিরাম চিৎকার করছে ও পা ছুড়ছে। এই অবস্থায় সুরাকা নবীর কাফেলাকে
উদ্দেশ্য করে বলল, “হে
মক্কার সওয়ারগণ, একটু
দাঁড়াও। আমি সুরাকা, আমার
কিছু কথা আছে, কোন
অনিষ্টের ভয় নেই।”
সুরাকা অতঃপর নবীর
কাছে পৌঁছে নিজের সব কথা খুলে বলে আরজ করল, আমার খাদ্য সম্ভার ও অস্ত্র-শস্ত্র আপনারা গ্রহণ
করুন। মহানবী (সাঃ) তার দান গ্রহণ না করে মিষ্টি কথায় বললেন, “এ সবের কোন আবশ্যকতা আমাদের নেই। আমাদের
কথা কাউকে বলে
না দিলেই উপকৃত হব।”
সুরাকা তখন আরজ করলো,
“আমার জন্য আপনি একটা
পরওয়ানা লিখে দিন, যা
প্রদর্শন করে আমি উপকৃত হতে পারব।” মহানবী
(সাঃ) আমেরকে
বলে চামড়ায় ঐ ধরণের একটি পরওয়ানা লিখে দিলেন।
অতঃপর সুরাকা ফিরে
গেল। মহানবীর কাফেলা আবার যাত্রা করলো মদিনার পথে।
লেখকঃ আবুল আসাদ (আমরা সেই সে জাতি-দ্বিতীয় খন্ড)
No comments:
Post a Comment