৬৮০ খ্রিস্টাব্দ।
আমীর মুয়াবিয়া মৃত্যুবরণ করেছেন। পিতার সিংহাসনে বসেছেন ইয়াযিদ। হযরত মুয়াবিয়া এবং ইয়াযিদ তাদের
শাসন কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমে ইসলামের খিলাফতকে প্রশ্নবিদ্ধ
করেছেন নানাভাবে। সাধারণের রাজকোষ –বাইতুল
মাল পরিণত হল ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে। ইয়াযিদের খলীফা পদে আসীন হওয়া একদিকে
ছিল স্বীকৃত চুক্তির খেলাফ, অন্যদিকে
ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় খলিফা তথা রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচনে
খিলাফতের নির্ধারিত নিয়ম এবং আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) সুন্নাহ ও সাহাবীদের
ইজমার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইয়াযিদ ইবন মুয়াবিয়ার এই আচরণের তীব্র প্রতিবাদ
করলেন হযরত হুসাইন। এত বড় অন্যায়কে, ইসলামী আদর্শের এই ভূলুণ্ঠিত দশাকে বরদাশত করা যায় কি করে?
মদীনায় অলসভাবে বসে
থেকে ইসলামের এই অবস্থা মুসলিম জাতির এই দৃশ্য তিনি সহ্য করতে পারেন না।
পারেন না বলেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কুফা থেকে সেখানকার অধিবাসীরা জানালঃ আসুন,
আমরা আপনাকে এ
ন্যায়ের সংগ্রামে সাহায্য করব। তাদের আহবান মতে মুষ্টিমেয় সাথী ও নিজের আত্মীয়-পরিজন
নিয়ে রওয়ানা হলেন তিনি কুফার দিকে।
কুফার পথে হযরত
হুসাইন এসে উপস্থিত হলেন কারবালা মরু প্রান্তরে। সামনেই ইউপ্রেটিস-ফোরাত নদী। তিনি দেখলেন,
ফোরাত নদী ঘিরে
রেখেছে ইয়াযিদ সৈন্যরা। তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনীকেও ঘিরে ফেলা
হয়েছে। সামনে পিছনের সব দিকের পথ বন্ধ। বাধ্য হয়ে হযরত হুসাইন তাঁবু গাড়লেন
ফোরাত নদীর তীরে।
প্রস্তাব এল ইয়াযিদের
সেনাপতি আবদুল্লাহ ইবন যিয়াদের কাছ থেকে, “বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে হবে।”
আত্মসমর্পণ? অন্যায়ের কাছে, অত্যাচারের কাছে আত্মসমর্পণ? একজন জিন্দাদিল মুসলমান, একজন জিন্দাদিল মুজাহিদের পক্ষে এমন
আত্মসমর্পণ কি জীবন থাকতে সম্ভব? সম্ভব নয়। নবীর (সাঃ) দৌহিত্র হযরত
হুসাইনের পক্ষেও তা সম্ভব হলোনা।
হযরত হুসাইনকে
আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য সে ক্ষুদ্র দলের উপর চললো নিপীড়ন। ফোরাতের তীর বন্ধ করে দেয়া হলো।
কোথাও থেকে এক কাতরা পানি পাবারও কোন উপায় রইলনা। শুরু হলো খন্ড যুদ্ধ।
অদ্ভুত এক অসম যুদ্ধ।
একদিকে সত্তরজন,
অন্যদিকে বিশ হাজার।
হযরত হুসাইনের জানবাজ সব সাথীই একে একে শাহাদাত বরণ করেছেন। ক‘দিন থেকে পানি বন্ধ। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে
যাচ্ছে সকলের।
দুধের বাচ্চা মায়ের দুধ পাচ্ছে না। অবোধ শিশুদের ক্রন্দনে আকাশ যেন বিদীর্ণ
হচ্ছে। হযরত হুসাইন সবই দেখছেন, শুনছেন।
নীরব-নির্বিকার তিনি। জীবন যেতে পারে, কিন্তু অন্যায়ের কাছে তো নতি স্বীকার
চলেন না!
সংগ্রামী সাথীদের
সবাই একে একে চলে গেছে জান্নাতে। একা হযরত হুসাইন। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, ফোরাত থেকে পানি আনার একবার শেষ চেষ্টা
করে দেখা যাক। তিনি দুলদুল নিয়ে চললেন ফোরাতের দিকে। নদীর তীরে পৌঁছলেনও তিনি।
কিন্তু অজস্র তীরের
প্রাচীর এসে তাঁর গতি রোধ করল। তাঁবুতে ফিরে এলেন হযরত হুসাইন। এসে দেখলেন
স্ত্রী শাহারবানু শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পানির অভাবে মুমূর্ষ
তাঁর শিশুপুত্র। হুসাইন সহ্য করতে পারলেন না এ দৃশ্য। শিশুপুত্রকে কোলে
নিয়ে তিনি ছুটলেন আবার ফোরাতের দিকে। পানির কাছে পৌঁছার আগেই শত্রুর নির্মম
তীর এসে বিদ্ধ করল পুত্রের কচি বুক! ফোরাতের কূলে আর নামা হলো না। মৃত
শিশু পুত্রকে নিয়ে ফিরে এলেন তিনি। মৃত শিশুকে স্ত্রী শাহারবানুর হাতে তুলে
দিয়ে শ্রান্ত-ক্লান্ত হুসাইন বসে পড়লেন। রক্তে ভেজা তাঁর দেহ। তারপর হযরত
হুসাইন হাত দু‘টি
তাঁর উর্ধে তুললেন। দু‘হাত
তুলে তিনি জীবিত ও মৃত সকলের জন্য দোয়া করলেন। তারপর স্ত্রী
শাহারবানুকে বিদায় সালাম জানিয়ে মর্দে মুজাহিদ সিংহ বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন
ইয়াযিদ বাহিনীর উপর। সে বিক্রম বিশ হাজার সৈন্যের পক্ষেও বরদাশত করা সম্ভব
হলো না। নদীকূল ছেড়ে পলায়ন করল ইয়াযিদ সৈন্যরা। কি শক্তি বিশ্বাসীর,
সত্যাশ্রয়ীর!! বহুর
বিরুদ্ধে একের সংগ্রাম, তবু
সে অজেয়-অদম্য।
কিন্তু অবিরাম
রক্তক্ষরণে দুর্বল হয়ে পড়লেন নবী দৌহিত্র হুসাইন। সংজ্ঞাহীন
হয়ে লুটিয়ে পড়লেন তিনি ফোরাতের তীরে, কারবালার মরু বালুতে। শত্রুর নির্মম খঞ্জর এসে স্পর্শ করল তাঁর
কণ্ঠ। পবিত্র
রুধির ধারায় প্লাবিত হলো কারবালার মাটি।
হযরত হুসাইন প্রাণ দিলেন,
কিন্তু সত্যের উন্নত
শিরকে আকাশস্পর্শী করে গেলেন। সত্যের সে উন্নত শির আনত হয়নি কখনও, একনও নয়, হবেও না কোনদিন। শহীদের এই লহুতে স্নান
করেই পতনের
পংক থেকে বার বার গড়ে উঠছে জাতি, দেশ,
স্বাধীনতা এবং সত্যের শক্তি-সৌধ।
লেখকঃ আবুল আসাদ (আমরা সেই সে জাতি-প্রথম খন্ড)
No comments:
Post a Comment